প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য প্রমাণ বলে, একসময় পৃথিবীর সব ভূমি ছিল একসঙ্গে—একটি অখণ্ড মহাদেশ। বিজ্ঞানীরা একে বলেন প্যানজিয়া।
অ্যান্টার্কটিকা। নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভাসে ধবধবে সাদা বরফ। পুরো একটি মহাদেশে শুধু বরফ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই! বরফের নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত থেকে শুরু করে আগ্নেয়গিরি! কেউ কেউ বিশাল এই প্রাণহীন বরফভূমিকে বলেন বরফের মরু। অবশ্য একেবারে প্রাণহীন নয়। বরফের এ মেরুতে ঘুরে বেড়ায় পেঙ্গুইন বা সিলের মতো বরফচর প্রাণীরা।
অথচ একসময় এই বরফমরু প্রাণহীন শুভ্রতায় মোড়া ছিল না। ছিল আমাজনের মতো রেইনফরেস্ট। সবুজ। গাছপালা ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। কিন্তু তারপর কী হলো? সবুজ কীভাবে ছেয়ে গেল সাদা বরফের চাদরে?
গল্পের শুরুটা সেই পাঁচ কোটি বছর আগে। তখন অ্যান্টার্কটিকা সবুজ বটে, তবে গল্পটা শুধু অ্যান্টার্কটিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর সব ভূমি তখন কেবল দুটো মহাদেশে বিভক্ত। আরেকটু পেছনে ফিরলে বিষয়টা বোঝা যাবে ভালোভাবে।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য প্রমাণ বলে, একসময় পৃথিবীর সব ভূমি ছিল একসঙ্গে—একটি অখণ্ড মহাদেশ। বিজ্ঞানীরা একে বলেন প্যানজিয়া। সেই মহাদেশটি একসময় ভেঙে যায়, সৃষ্টি হয় দুটো (অতি)মহাদেশ। লরেশিয়া ও গন্ডোয়ানাল্যান্ড। এই গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামের মহাদেশটির অংশই ছিল অ্যান্টার্কটিকা। সেইসঙ্গে এতে আরও ছিল দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। একসময় ভারত ভেঙে যায়, ভেসে আসে পৃথিবীর অন্যপাশে, ধাক্কা খায় ইউরেশিয়ার সঙ্গে; যার ফলে গড়ে ওঠে হিমালয়। সে অন্য গল্প। আমাদের গল্পটি ভারত ভেঙে যাওয়ার কিছুকাল পরের।
সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগের সেই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর ফল টের পায় পৃথিবী। পুরো বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যায় প্রচণ্ডভাবে। সে সময়ের গড় তাপমাত্রাকে বলা হয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই সময়টাকে বিজ্ঞানীরা বলেন, প্যালিওসিন-ইওসিন থার্মাল ম্যাক্সিমাম। প্যালিওসিন আর ইওসিন দুটো যুগের নাম। থার্মাল ম্যাক্সিমাম কথাটির বাংলা ওটাই—সর্বোচ্চ তাপমাত্রার অবস্থা।
তখনো অ্যান্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকা রয়েছে একসঙ্গে। এ সময় দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ক্যাঙ্গারুর মতো প্রাণীরা শত-সহস্র মাইল পাড়ি দিয়ে চলে আসে অ্যান্টার্কটিকায়। পরে আবার জলবায়ু তুলনামূলক শীতল হয়ে এলে এগুলো ধীরে ধীরে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। এরপর শুরু হয় অ্যান্টার্কটিকার ভাঙন। ভেঙে অস্ট্রেলিয়ার পাশ থেকে সরে তো আসেই, একসময় চারপাশে সমুদ্রবেষ্টিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর সব স্থলভাগ থেকে।
অ্যান্টার্কটিকাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে মহাসমুদ্র। এই মহাসমুদ্রে অ্যান্টার্কটিকার চারদিকে বয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিস্রোত। সেকেন্ডে প্রায় ১৪ কোটি ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়।
পরের প্রায় আড়াই কোটি বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কমে যায় প্রায় ১৫ ডিগ্রি। অ্যান্টার্কটিকা ধীরে ধীরে ঢাকা পড়তে থাকে পুরু বরফের চাদরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অ্যান্টার্কটিক সারকামপোলার কারেন্ট বা এসিসি। বাংলায় বলা যায়, অ্যান্টার্কটিক ঘূর্ণিস্রোত।
অ্যান্টার্কটিকাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে মহাসমুদ্র। এই মহাসমুদ্রে অ্যান্টার্কটিকার চারদিকে বয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিস্রোত। সেকেন্ডে প্রায় ১৪ কোটি ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এই ভয়ংকর তীব্র ঘূর্ণিস্রোত উষ্ণ পানিকে বয়ে নিয়ে যায় উত্তরদিকে। পাশাপাশি সমুদ্রের গভীর গহিন থেকে তুলে আনে লবণাক্ত শীতল পানি। এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে অ্যান্টার্কটিকাতেই। একদিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যাওয়া, আরেকদিকে এই স্রোতের প্রভাব—দুইয়ে মিলে অ্যান্টার্কটিকা পরিণত হতে থাকে বরফমেরুতে।
এক সময়কার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছ, পশু-পাখি এই শীতে আর টিকতে পারেনি। বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। শুধু টিকে যায় শীত সহ্য করতে পারে, এমন উদ্ভিদ ও প্রাণীরা। এভাবে ধীরে ধীরে প্রায় প্রাণহীন এক মহাদেশে পরিণত হয় অ্যান্টার্কটিকা। শেষ প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে এ বরফমেরু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে জীবনধারণের উপযোগিতা।
বর্তমানে পৃথিবীর সব বরফের মাত্র ১০ শতাংশ রয়েছে গ্রিনল্যান্ডে। বাকি প্রায় ৮৯ শতাংশই রয়েছে অ্যান্টার্কটিকায়। তবে পুরো অ্যান্টার্কটিকার সবটা কিন্তু বরফ নয়। ৯৮ শতাংশের মতো বরফে ঢাকা। বাকি অংশটুকু বরফহীন, শুষ্ক।
অ্যান্টার্কটিকার ব্যাপারে এসব তথ্য আমরা কীভাবে জানলাম? একটি হলো ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ। পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশ যে একসময় একসঙ্গে ছিল, তা বোঝা যায় খুব সহজেই। সবগুলো মহাদেশের কিনারা দেখলেই বোঝা যায়, একটি আরেকটির সঙ্গে মিলে যায় ঠিক জিগস পাজলের মতো। এ ছাড়াও, অ্যান্টার্কটিকার বরফের চাদরের নিচে খুঁড়ে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন ডাইনোসর, ক্যাঙ্গারু থেকে শুরু করে এমন সব প্রাণীর ফসিল, যেগুলো আজকের বরফ মোড়া অ্যান্টার্কটিকায় পাওয়ার কথা ভাবাও দুষ্কর।
বিজ্ঞানীরা বরফ কীভাবে বিশ্লেষণ করেন, সে বিষয়ে সংক্ষেপে বলা যাক। বরফের সিলিন্ডারকে ইংরেজিতে বলে কোর। এ ধরনের কোর সংগ্রহ করেন বিজ্ঞানীরা, গবেষণা করেন এবং জমিয়ে রাখেন সংরক্ষণাগারে। প্রতি স্তর বরফ যেন একেকটি টাইম ক্যাপসুল। যত নিচের স্তরে যাওয়া যায়, পাওয়া যায় অতীতের সন্ধান। এতে থাকে নানা ধরনের গ্যাস, বিভিন্ন ধরনের পদার্থ—এগুলো আমাদের বলে, এরা যখন মাটির বুকে জায়গা করে নিয়েছিল, ঠিক কেমন ছিল সে সময়কার তাপমাত্রা ও বায়ুমণ্ডলের গঠন। শক্তিশালী এক রেকর্ড বইয়ের মতো এগুলো। এসব বইয়ের পাতায় পাতায় বরফের শ্বেতশুভ্র কালিতে লেখা আছে শত সহস্র বছরের অজানা ইতিহাস। এই ইতিহাস পড়ে সহজেই জানা যায়, প্রাচীন পৃথিবী কেমন ছিল। জানা যায়, আজকের বরফমেরু অ্যান্টার্কটিকা এককালে ছিল সবুজ, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: উইকিপিডিয়া, বিবিসি ফোকাস, ভক্স, দ্য গার্ডিয়ান ও থিংক বাংলা