‘সমুদ্রের নীলের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা দুঃখ-কষ্ট মুহূর্তেই দূর করে দেয়।’—কথাটা বলেছেন ডাচ্ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। সত্যিই যেন তাই! প্রকৃতির এক অনন্য সৌন্দর্যের প্রতীক সমুদ্র। এর বিশালতায় হারিয়ে যায় নিত্যদিনের ক্লান্তি-ক্লেশ, জাগতিক সব দুশ্চিন্তা। নীল জলরাশির গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যের পেছনে ছুটে যায় মন, মেতে ওঠে অদ্ভুত আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। নিরন্তর ঢেউয়ের নৃত্য আর সমুদ্রের গর্জনের সুরে হৃদয়ে জাগে প্রাণের দোলা। কিন্তু কীভাবে! সমুদ্রের কাছে এলেই কেন আমাদের মন এত ভালো হয়ে যায়? এর পেছনে কি লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের নিগুঢ় কোনো বিষয়? চলুন, তা খুঁজে দেখা যাক।
প্রাচীনকালে ভিক্টোরিয়ান যুগে ইউরোপীয়রা যক্ষার মতো জটিল রোগের চিকিৎসা হিসেবে সমুদ্রে ঘুরে আসার পরামর্শ দিতেন। সে যুগে চিকিৎসকেরা সমুদ্র উপকূল পরিদর্শনের পরমার্শ দিতেন শ্বাসকষ্টজনিত রোগীদের। তখন এর কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি জানা না থাকলেও বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো প্রমাণ করেছে যে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার সময় পরিবেশে প্রচুর ঋণাত্মক আয়ন তৈরি হয়। যেমন আয়োডাইড আয়ন।
পিয়ার্স হাওয়ার্ডের বই ওউনারস ম্যানুয়াল ফর দ্য ব্রেইন-এর মতে, ঋণাত্মক আয়নের ঘনত্ব বাড়লে আমাদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। এই আয়নগুলো বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ করে এবং মানুষের শরীরে সেরোটোনিন হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়। সেরোটোনিনকে বলা হয় হ্যাপি হরমোন বা সুখানুভূতি প্রদানকারী হরমোন। এটি মানসিক চাপ কমিয়ে আমাদের সুখ ও আনন্দের অনুভূতি দেয়। পাশাপাশি ঋণাত্মক এই আয়নগুলো আমাদের অক্সিজেন গ্রহণের হার বাড়িয়ে দেয়। মস্তিষ্কে দ্রুত অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে।
এ ছাড়াও আয়নগুলো আমাদের কোষের বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। আবার অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী বস্তু (এলার্জেন), যেমন ধূলিকণা, পরাগরেণু, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি থেকেও রক্ষা করে আমাদের। পাশাপাশি সমুদ্রের কাছাকাছি বায়ুতে অক্সিজেনের মাত্রাও অনেক বেশি থাকে এবং এটি তুলনামূলকভাবে বিশুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক সার্ভিসের মতে, উদ্ভিদভিত্তিক সামুদ্রিক জীব যেমন প্ল্যাঙ্কটন, সামুদ্রিক শৈবাল এবং সমুদ্রের তলদেশে থাকা অন্যান্য উদ্ভিদ পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অক্সিজেনের জোগান দেয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) হিসাব অনুযায়ী, সমুদ্র পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এই বিশুদ্ধ বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বাড়ায়। ফুসফুসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছানোর ফলে শরীর আরও সতেজ হয় এবং মানসিক প্রশান্তি আসে।
আমরা যখন সমুদ্র বা সৈকত সম্পর্কে কথা বলি, তখন পানি ও আকাশের বিশাল বিস্তৃতির কারণে নীল রঙের কথা অবিলম্বে মনে আসে। ফ্যাবার বিরেন তাঁর কালার অ্যান্ড হিউম্যান রেসপন্স বইয়ে বলেছেন, ‘নীল রং রক্তচাপ কমায়, মনযোগ বাড়ায় এবং গভীর চিন্তা ও পড়াশোনায় উৎসাহী করে। লন্ডনের কালার ইফেক্টস নামে একটি সংস্থার মতে, নীল রং আমাদের মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিকভাবে নীল রং মস্তিষ্কে প্রশান্তি ও শীতলতার অনুভূতি সৃষ্টি করে, হৃদস্পন্দনের হার কমিয়ে শান্তির অনুভূতি দেয়। এ ছাড়া নীল রং চোখের জন্য আরামদায়ক। ফলে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কোনো ক্লান্তি বোধ হয় না।
সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ প্রাকৃতিক ‘হোয়াইট নয়েজ’ হিসেবে কাজ করে। এই শব্দ মস্তিষ্কে আলফা ওয়েভের কার্যক্রম উদ্দীপিত করে মানসিক শান্তি এবং ধ্যানের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে সমুদ্রের কাছে গেলে আমাদের প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের আলোয় বেশি সময় কাটে। সূর্যের আলো ভিটামিন ডির অন্যতম প্রধান উৎস। ভিটামিন ডি শরীরে সেরোটোনিন উৎপাদনেও সহায়তা করে। এটি যে সুখানুভূতি বাড়ায়, এ কথা তো আগেই বলেছি। এ ছাড়াও আমাদের ত্বকে সূর্যের আলো নাইট্রিক অক্সাইড (NO) নিঃসরণে সহযোগিতা করে। এই যৌগটি রক্তনালির প্রসারণকে সহজ করে রক্তচাপ কমায়। এমনকি সূর্যের আলো সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের (এসএডি) চিকিৎসায়ও সাহায্য করে।
সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ প্রাকৃতিক ‘হোয়াইট নয়েজ’ হিসেবে কাজ করে। এই শব্দ মস্তিষ্কে আলফা ওয়েভের কার্যক্রম উদ্দীপিত করে মানসিক শান্তি এবং ধ্যানের অনুভূতি সৃষ্টি করে। সাধারণত ৮-১৪ হার্জ কম্পাঙ্কের সমুদ্রের শব্দ আমাদের শিথিলতা বা রিলাক্সড হওয়ার অনুভূতি দেয় অ্যাকুস্টিক ক্যামোফ্লেজের কারণে। অ্যাকুস্টিক ক্যামোফ্লেজ হলো শব্দ শোষণের মাধ্যমে শব্দ লুকানোর একটি কৌশল। এটি আমাদের উদ্বেগ দূর করতে সাহায্য করে। অনেক থেরাপি সেশনে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ ব্যবহার করা হয়, কারণ এটি ঘুমের মান উন্নত করে।
আমরা যখন সমুদ্রের পানিতে গোসল করি, তখন সমুদ্রের পানিতে থাকা খনিজ উপাদান (যেমন ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম এবং সেলেনিয়াম) শরীরের ত্বকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া ঠান্ডা পানি স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে। ফলে মন এবং শরীর সতেজ হয়।
সমুদ্রের কাছে গেলেই এই যে মন হালকা হয়ে যাওয়া, ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হওয়া, এসব নিয়ে ২০১৪ সালের ২২ জুলাই জীববিজ্ঞানী ওয়ালেস নিকোলস তাঁর ব্লু মাইন্ড বইয়ে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তাঁর মতে, সমুদ্র বা পানির কাছাকাছি থাকা বা পানিতে থাকা কিংবা ডুব দেওয়া আমাদের মনে একধরনের শান্ত পরিবেশ তৈরি করে। এতে আমাদের মস্তিষ্কে শিথিল অবস্থা তৈরি হয়, ফলে আমরা একধরনের মেডিটেটিভ স্টেট বা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় চলে যাই। এতে আমাদের চাপ কমে, মনোযোগ বাড়ে এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানী ওয়ালেস এসবের নাম দিয়েছেন ‘ব্লু মাইন্ড থিওরি’।