প্রযুক্তি
উইকিমিডিয়া: বিশ্বজুড়ে জ্ঞান উন্মুক্ত করার এক চলমান আন্দোলন
জ্ঞান কি উন্মুক্ত? আমরা কি চাইলেই মানবসভ্যতার সব জ্ঞান অর্জন করতে পারি? পৃথিবীর সব জ্ঞান উন্মুক্ত করে দিতে কাজ করে চলেছে উইকিমিডিয়া। এ এক চলমান আন্দোলন। কী লক্ষ্য তাদের? কীভাবে কাজ করে উইকিমিডিয়া? উইকিপিডিয়া আর উইকিমিডিয়ার সম্পর্কই-বা কী?
জ্ঞান কি উন্মুক্ত? আমরা কি চাইলেই মানবসভ্যতার সব জ্ঞান অর্জন করতে পারি? এককথায় উত্তর, না। চাইলে সবাই সব বই পড়তে পারে না। কিছু বই নাগালের বাইরে, আবার কিছু লাইব্রেরি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। বেশির ভাগ বিজ্ঞান জার্নাল পড়তে অর্থ খরচ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে টাকার অঙ্কটা অনেকেরই নাগালের বাইরে। তাই জ্ঞানার্জন করতে গেলে মাঝেমধ্যে কিছু বাধার মুখে পড়তে হয় আমাদের।
এই ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করে উইকিমিডিয়া আন্দোলন। উইকিমিডিয়া শুধু তথ্যের ভান্ডারই নয়, বরং এখানে থাকা যেকোনো তথ্য যেকোনো প্রয়োজনে, এমনকি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্যও উন্মুক্ত। কয়েকটি শর্ত মেনে চললেই যেকোনো কাজে উইকিমিডিয়া প্রকল্পে থাকা তথ্য ও ছবিসহ সব উপকরণ ব্যবহার করা যায়। উইকিমিডিয়ানরা বিশ্বাস করেন, জ্ঞান হতে হবে উন্মুক্ত। জ্ঞানের প্রবেশাধিকারে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। এই উইমিডিয়ার বিশাল কার্যক্রমের একটি অংশ উইকিপিডিয়া। বর্তমানে উইকিপিডিয়ার বহুল ব্যবহার, গুগল করলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে উইকিপিডিয়ার লিঙ্কের উপস্থিতি এ ধারণাকেই সমর্থন করে।
উইকিপিডিয়ার পথচলা শুরু ২০০১ সালের ১৫ জানুয়ারি, ইংরেজি উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে। একই বছরের মার্চ-জুনে জার্মান, কাতালান, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, জাপানি, রাশিয়ান, সুইডিশ, ডাচ, পোলিশ, সিম্পল ইংলিশ, এস্পেরেন্তো, আফ্রিকানস, নরওয়েজিয়ানস ও বাস্ক (স্পেনের একটা রাজ্য) ভাষায় উইকিপিডিয়ার যাত্রা শুরু হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট ‘বাজাউ সামা’ ভাষায় উইকিপিডিয়া যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ৩৩০টির বেশি ভাষায় উইকিপিডিয়ার সংস্করণ রয়েছে। নিস্ক্রিয় উইকিপিডিয়া ভাষা সংস্করণ আছে প্রায় ১৭টি। প্রতিটি ভাষা সংস্করণের পেছনে রয়েছে আলাদা কমিউনিটি। এ কমিউনিটির সদস্যরা নিজেদের ভাষার উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ তৈরিতে কাজ করেন। প্রতিটি ভাষার কমিউনিটি উইকিপিডিয়ার মূল আদর্শ বজায় রেখে ইংরেজি উইকিপিডিয়াকে অনুসরণ করে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি করে। নিজস্ব নীতিমালা মেনেই সব ভাষার উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে বাংলা, সাঁওতালী এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী—এই তিন ভাষায় উইকিপিডিয়া রয়েছে। তিন ভাষার উইকিপিডিয়াতেই বাংলাদেশিরা ভারতীয় উইকিপিডিয়ানদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেন।
অনলাইনে উন্মুক্ত কনটেন্ট তৈরির কাজ ছাড়াও বিশ্বজুড়ে অনেক উইকিমিডিয়ান শত শত ঘণ্টা ব্যয় করেন এর পেছনে। তাঁরা নানা ধরনের কাজ করেন
শুরুতে ইংরেজি উইকিপিডিয়া নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে উইকিমিডিয়া কমন্স, উইকি স্পেশিস, উইকিসোর্স, উইকিডেটা, মেটা উইকির মতো সহপ্রকল্পের জন্ম হয়। উইকিপিডিয়া শুধু উন্মুক্ত লাইসেন্সের আওতায় থাকা টেক্সচুয়াল বা লিখিত জ্ঞানের জন্য পরিচালিত হয়। আর উইকিমিডিয়া কমন্স কাজ করে উন্মুক্ত লাইসেন্সে থাকা ছবি, অডিও, ভিডিও এবং অন্যান্য মিডিয়া ফাইল সংরক্ষণে। এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত মিডিয়া ফাইল রিপোজিটরি। বলা বাহুল্য, উইকিমিডিয়া প্রকল্পের সব মিডিয়া ফাইল ব্যবহৃত হয় উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে। উইকি স্পেশিস পৃথিবীর সব প্রজাতিকে উন্মুক্ত লাইসেন্সের আওতায় নথিবদ্ধ করতে কাজ করে। উন্মুক্ত লাইসেন্সের আওতায় ‘মেশিন রিডেবল’ ও ‘স্ট্রাকচার্ড ডেটা’ নিয়ে কাজ করে উইকিডেটা। আর উন্মুক্ত লাইসেন্সের আওতায় অভিধান তৈরির কাজ করে উইকশনারি।
মজার ব্যাপার হলো, এই সম্পূর্ণ উইকিমিডিয়া ইকোসিস্টেমের কোনো মালিক নেই। কেউ এর একচ্ছত্র আধিপত্য দাবি করতে পারে না। উইকিমিডিয়া আন্দোলনের মালিকানা পুরো মানবসভ্যতার হাতে
অনলাইনে উন্মুক্ত কনটেন্ট তৈরির কাজ ছাড়াও বিশ্বজুড়ে অনেক উইকিমিডিয়ান শত শত ঘণ্টা ব্যয় করেন এর পেছনে। তাঁরা নানা ধরনের কাজ করেন। যেমন উইকিভাইব্র্যান্স নামে একটি সংগঠন আফ্রিকান ইউনিয়নের সঙ্গে আফ্রিকার তরুণদের নিয়ে কাজ করেছেন। ‘রিডিং উইকিপিডিয়া ইন দ্য ক্লাসরুম প্রোগ্রাম’ নামে হাইস্কুল শিক্ষকদের একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আছে, যেখানে শিক্ষকেরা নিজেদের শ্রেণিতে উইকিপিডিয়া শিখন উপকরণ হিসেবে যথাযথভাবে ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ নেন। বিশ্বজুড়ে উইকি লাভস ফোকলোর, উইকি লাভস আর্থের মতো আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা হয়। ২০২৪ সালের উইকি লাভস ফোকলোরে পৃথিবীর ৩৯টি দেশের আলোকচিত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের আজিম খান রনি সেরা ফটোগ্রাফারের তকমা পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখে। গ্যালারি, লাইব্রেরি, আর্কাইভ ও মিউজিয়ামগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে উন্মুক্ত লাইসেন্সের আওতায় নতুন জ্ঞানের জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করেন উইকিমিডিয়ানরা। প্রতি বছর বেশ কিছু আন্তর্জাতিক উইকিমিডিয়া কনফারেন্স হয়, যেখানে বিভিন্ন দেশের উইকিমিডিয়ানরা নিজেদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এ ছাড়াও সব কমিউনিটিকে আন্তর্জাতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখা, নেতৃত্ব দেওয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করানোর জন্য একদল স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন।
মজার ব্যাপার হলো, এই সম্পূর্ণ উইকিমিডিয়া ইকোসিস্টেমের কোনো মালিক নেই। কেউ এর একচ্ছত্র আধিপত্য দাবি করতে পারে না। উইকিমিডিয়া আন্দোলনের মালিকানা পুরো মানবসভ্যতার হাতে। সাধারণ স্বেচ্ছাসেবীরাই অনলাইনে এর বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া, এর ভেতরের পলিসিমেকিং, সম্ভাব্য বিরোধ, তা সমাধানের উপায়—এসব নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের আগ্রহ রয়েছে। উইকিমিডিয়া আন্দোলন নিয়ে কাজ করা গবেষকদের নিয়ে প্রতিবছর ‘উইকিওয়ার্কশপ’ নামে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গবেষকেরা তাঁদের বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ জমা দিতে পারেন।
এভাবে প্রথমে উইকিপিডিয়া থেকে শুরু হলেও ধীরে ধীরে এটি একটি ‘ইউনিভার্স’ হিসেবে গড়ে ওঠেছে। অনেকে একে উইকিমিডিয়াভার্সও বলেন। পুরো জগতকে বলা হয় ‘উইকিমিডিয়া আন্দোলন’। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ শুধু বাংলা ও ইংরেজি উইকিপিডিয়া সম্পর্কে জানেন—বলা ভালো, মূলত এ দুটিই ব্যবহার করেন। ইংরেজি উইকিপিডিয়া অবশ্যই উইকিমিডিয়া আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল প্রকল্প। এখান থেকেই পুরো বৈশ্বিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। তবে এটিই শেষ নয়। জ্ঞান সবার জন্য উন্মুক্ত করার এক চলমান প্রক্রিয়া বা আন্দোলনের নাম আজ উইকিমিডিয়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োইনফরমেটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়