ভূমিকম্প কেন হয়
দেখে যেমনই মনে হোক, আমাদের গ্রহ পুরোপুরি পাথরের গোলক নয়। প্রতিমুহূর্তে এর বিভিন্ন অংশ নড়ছে। পাতলা ভূত্বকের নিচেই ফুটন্ত গলিত লাভার রাজত্ব। একেবারে কেন্দ্রে উত্তপ্ত কঠিন গোলক ঘুরছে। একদম ওপরের ভূত্বককে বলা হয় লিথোস্ফিয়ার। ১৩টি ছোট-বড় টুকরায় বিভক্ত এই অংশ। প্রতি টুকরাকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ছোট প্লেট আছে। এই প্লেটগুলো পৃথিবীর ম্যান্টল স্তরের গলিত ম্যাগমার ওপর ভাসমান। এ কারণে এগুলো ক্রমাগত নড়ছে, সরছে, ধাক্কা খাচ্ছে একটি অন্যটির সঙ্গে। প্লেটে প্লেটে সংঘর্ষের কারণে তৈরি হয় পর্বতমালা, গভীর সমুদ্রের মধ্যে গিরিখাত ও আগ্নেয়দ্বীপ।
কল্পনা করুন, মহাদেশ আকারের দুটি টেকটোনিক প্লেট একে অপরকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে বা একটা আরেকটার নিচ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দুটো প্লেটের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা। এই ফাঁকা জায়গাকে বলা হয় ফল্টলাইন। দুটি প্লেটের একটি অন্যটির কিনারার খাঁজের ফাঁকে আটকে যায় কখনো কখনো। এই আটকে যাওয়া বা সংঘর্ষের ফলে ফল্টলাইন বরাবর প্রচুর শক্তি জমতে থাকে। যখন এখানকার কোনো পাথর কোনোভাবে মুক্ত হয়, তখন ফল্টলাইনে জমা পড়া প্রচণ্ড শক্তি সাইসমিক ওয়েভ বা তরঙ্গ রূপে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ভূপৃষ্ঠের ১০ থেকে কয়েক শ কিলোমিটার নিচে তৈরি হয় এ সাইসমিক তরঙ্গ। উচ্চ কম্পাঙ্কের প্রাথমিক তরঙ্গ কঠিন ও গলিত পাথরের মধ্য দিয়ে দ্রুত যেতে পারে। তবে এ তরঙ্গের শক্তি কম হয়, তাই ক্ষতিও হয় কম। ভূত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে নিম্ন কম্পাঙ্কের সেকেন্ডারি ওয়েভ বা দ্বিতীয় তরঙ্গ। প্রাথমিক তরঙ্গের কিছুটা পরে এ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। ভূত্বককে কাগজের মতো মুচড়ে টুকরা টুকরা করে দিতে পারে এটি।
মধ্য-অতলান্তিক শৈলশিরার মতো ডাইভারজেন্ট বাউন্ডারি বা বিভক্তিসীমায় আগ্নেয়গিরির লম্বা সারি দেখা যায়। এখানেই তৈরি হয় নতুন লিথোস্ফিয়ার।
অতিসংবেদনশীল সাইসমোগ্রাফ ব্যবহার করে ভূতাত্ত্বিকেরা ধারণা করেন, বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ভূমিকম্প হয় পৃথিবীজুড়ে। এর মধ্যে অন্তত ১০০টি ভূমিকম্প প্রাণ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি করতে পারে। শক্তিশালী ভূমিকম্প পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক ভূতাত্ত্বিক ঘটনা।
সমুদ্রের তলদেশে সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোর কারণে তৈরি হয় প্রলয়ংকরী সুনামি। এ ছাড়া অতিরিক্ত তুষারপাত, ভূমিধসের পেছনেও দায়ী ভূমিকম্প। মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে দুর্বল ভবনসহ মানুষের তৈরি নানা স্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে। প্রাণ ও সম্পদের হয় অপূরণীয় ক্ষতি।
টেকটোনিক প্লেটের নানা দিক
ভূমিকম্প কীভাবে ঘটে, তা বুঝে নিন।
১. ম্যাগমার প্রবাহ
ম্যান্টলের গভীরে পরিচলন স্রোত ম্যাগমাকে ওপরের দিকে ঠেলে দেয়। এই ম্যাগমা তখন ভূত্বক ভেদ করে লাভা হিসেবে বেরোয় অথবা টেকটোনিক প্লেটকে ধাক্কা দিয়ে এর গতির দিক ঠিক করে দেয়।
২. নিম্নগামী অঞ্চল
যখন দুটি প্লেট কাছাকাছি চলে আসে, তখন উচ্চ ঘনত্বের প্লেটটি (সাধারণত সামুদ্রিক প্লেট) অন্যটির নিচে ঢুকে যায়। এ সময় ম্যান্টলের পাথুরে উপাদানগুলো টুকরা হয়ে গলে যায়। ফলে নির্গত হয় সাইসমিক তরঙ্গ, সক্রিয় হয় আগ্নেয়গিরি।
৩. বিভক্তিসীমা
মধ্য-অতলান্তিক শৈলশিরার মতো ডাইভারজেন্ট বাউন্ডারি বা বিভক্তিসীমায় আগ্নেয়গিরির লম্বা সারি দেখা যায়। এখানেই তৈরি হয় নতুন লিথোস্ফিয়ার। নতুন প্লেটগুলো শৈলশিরার বিপরীত দিকে, সমকোণে বাড়তে থাকে।
৪. পর্বতমালা
হিমালয়, আন্দিজ কিংবা রকি পর্বতমালার মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর পর্বতমালাগুলো টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে তৈরি হয়েছিল। একটি টেকটোনিক প্লেট যখন অন্যটির নিচে ঢুকে যায়, তখন অন্যটি ওপরের দিকে ঠেলে ওঠে—তৈরি হয় পর্বতমালা।
৫. লিথোস্ফিয়ার
গড়ে ১০০ কিলোমিটার পুরু এই স্তর। পাথুরে, ভঙ্গুর লিথোস্ফিয়ার স্তরটি অর্ধগলিত ম্যাগমার ওপর ভাসছে। এটাই টেকটোনিক প্লেটের আবাসস্থল।
দুটি প্লেট পরস্পরের কাছাকাছি চলে এলে একটি ধীরে ধীরে আরেকটির নিচে ঢুকে পড়তে থাকে। যেখানে একটি প্লেট আরেকটির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে, সেটাকে বলে সাবডাকশন জোন বা নিম্নগামী অঞ্চল।
ফল্টের ধরন
সাধারণ ফল্ট
পৃথিবীর দুর্বল ভূত্বক ফল্টলাইন বরাবর ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়া দুটি অংশ পরস্পর থেকে সরে যাওয়ার সময় ভূকম্পন অনুভূত হয়। ফল্টলাইনের ওপরে থাকা পাথরের খণ্ডগুলো প্লেট নড়াচড়ার সময় ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যায়। অনেকটা মধ্য-অতলান্তিক শৈলশিরার মতো।
থ্রাস্ট ফল্ট
২০১১ সালে টোহোকু ভূমিকম্পটি হয় নিম্নগামী অঞ্চলে থ্রাস্ট ফল্টের জন্য। এই ফল্টগুলোর কারণে ঘটে মারাত্মক শক্তিশালী ভূমিকম্প। সামুদ্রিক ভূত্বক মহাদেশীয় ভূত্বকের নিচে ঢুকে পড়তে শুরু করলে প্রচণ্ড ঘর্ষণ হয়। এ ধরনের ফল্ট থেকে প্রায় ১ হাজার হাইড্রোজেন বোমার সমপরিমাণ শক্তি নির্গত হতে পারে।
স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট
রাস্তা বা ভূপৃষ্ঠের যেকোনো অংশ পাশাপাশি সরে যেতে পারে এই ফল্টের কারণে। এখানে মূলত দুটি প্লেট অনুভূমিক বরাবর সরে যায়। প্রতিবার এই সরে যাওয়ার সময় ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
মহাদেশ আকারের দুটি টেকটোনিক প্লেট একে অপরকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে বা একটা আরেকটার নিচ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দুটো প্লেটের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা। এই ফাঁকা জায়গাকে বলা হয় ফল্টলাইন।
টেকটোনিক প্লেট
ভাসছে ম্যাগমার মহাসমুদ্রের ওপর
বিভক্তি সীমা
গভীর সাগরের তলদেশে আগ্নেয়গিরির লম্বা সারির মতো দেখা যায়। এ অঞ্চলে তৈরি হয় ক্রাস্ট বা ভূত্বক। আর প্রতিবছর একটি অন্যটির তুলনায় প্লেটগুলো ২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার করে দূরে সরে যায়।
নিম্নগামী অঞ্চল
দুটি প্লেট পরস্পরের কাছাকাছি চলে এলে একটি ধীরে ধীরে আরেকটির নিচে ঢুকে পড়তে থাকে। যেখানে একটি প্লেট আরেকটির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে, সেটাকে বলে সাবডাকশন জোন বা নিম্নগামী অঞ্চল। সক্রিয় ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে এ অঞ্চলে।
প্লেটের নড়াচড়া
পৃথিবী কেন্দ্রের গলিত ম্যাগমা পরিচলন প্রক্রিয়ায় ওপরে উঠে আসে, ভূত্বক ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে চায়। এই ম্যাগমা স্রোতে লিথোস্ফিয়ার ভেসে বেড়ায়।