এভাবেই সারফগসে মমি সংরক্ষণ করত প্রাচীন মিসরীয়রা
বিভিন্ন কবরের দেয়ালে আঁকা চিত্রে এ ব্যাপারে অল্পস্বল্প তথ্য পাওয়া যায়। যেমন থেবসের এক কবরের দেয়ালচিত্রে দেখা যাচ্ছে, মমির শেষ ধাপ—মৃতদেহকে কাপড়ে মোড়ানো হচ্ছে।

প্রায় তিন হাজার বছর ধরে প্রাচীন মিসরীয়রা মানুষের মমি করেছেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এ রকম বহু মমি আমরা দেখেছি। দ্য মামি বা মমি নামেই বিখ্যাত অভিনেতা টম ক্রুজের একটি চলচ্চিত্র আছে। মিসর নিয়ে লেখা বিভিন্ন গল্পেও বারবার এসেছে মমির কথা। কিন্তু এই মমি সম্পর্কে আমরা কীভাবে জানলাম? শুনে হয়তো অবাক হবেন, মিসরে এত সব প্যাপিরাস পাওয়া গেছে, অথচ এর কোনোটিতেই মমিকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত কিছু লেখা ছিল না। তাহলে আধুনিক মানুষ মমি কীভাবে বানানো হতো, সে কথা জানলেন কেমন করে?

বিজ্ঞানীদের কাজের সঙ্গে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ যেকোনো গোয়েন্দা রহস্যের তুলনা করা যায়। তাঁরা একেকটি বিষয়ের গভীরে ঢুকতে চেষ্টা করেন। সম্ভাব্য একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেন তথ্য-উপাত্ত থেকে। এর নাম হাইপোথিসিস। তারপর সেটাকে পরীক্ষা করা হয়। মমি নিয়েও বিজ্ঞানীরা ঠিক তা-ই করলেন। তাঁরা মমি–সংক্রান্ত সব জ্ঞান এক করে, তারপর নিজেরাই হাতে-কলমে মমি বানিয়ে দেখলেন, সব ঠিকঠাক হলো কি না।

এই লেখায় আমরা প্রথমে জানব, মমি নিয়ে প্রাচীন মিসরীয়দের লেখা বিভিন্ন প্যাপিরাস ও দেয়ালচিত্র থেকে আমরা কী জানলাম। তারপর দেখব, বিজ্ঞানীরা সেটা কীভাবে হাতে-কলমে পরীক্ষা করলেন। তবে চমৎকার এই গোয়েন্দা রহস্য জানতে হলে আমাদের প্রথমে ফিরে যেতে হবে সেই প্রাচীন মিসরে।

পিরামিডের ভেতরে পাওয়া প্রাচীন মিসরের একটা মমি
আরও পড়ুন

পিরামিডের মমিও কি সর্দিতে ভুগেছিল?

আলেকজান্ডার রিন্ড আরও খোঁড়ার পর একটি অক্ষত কবর পেলেন। তাতে দেখা গেল, সারকোফ্যাগাস, অর্থাৎ কফিনের ভেতরে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া মমি এবং কিছু ক্যানোপি জার। স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়ার কারণ, এটি কখনো বিবর্ণ হয় না।

দুই

প্রথমে একটু ভেবে দেখা যাক, প্রাচীন মিসরীয়রা এত কিছু নিয়ে লিখলেন, কিন্তু মমি নিয়ে কেন তাঁরা বিস্তারিত লিখে গেলেন না। এর উত্তরে দুটো কারণ ভাবা যেতে পারে। এক, সে সময়েও মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করা এবং ভেতরের অঙ্গগুলো বের করে নেওয়াকে ঘৃণ্য কাজ বলে ভাবত মানুষ। সে জন্য যিনি মমির পেট কাটতেন, তিনি প্রয়োজনীয় পরিমাণ পেট কেটেই দৌড়ে বেরিয়ে যেতেন। এ সময় উপস্থিত মানুষ তাঁর দিকে প্রতীকীভাবে পাথর ছুড়ে মারতেন। উদ্দেশ্য, তাঁকে আঘাত করা নয়। সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, এটি একটি ঘৃণ্য কাজ।

কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক কারণ বলা যায় দ্বিতীয়টিকে। হাওয়ারা প্যাপিরিতে (প্যাপিরাসের বহুবচন) লেখা আছে, যেসব পরিবারের সদস্যরা মৃতদের দেখাশোনা করতেন, শুধু তাঁরাই বংশপরম্পরায় মমি বানানোর কাজ করতেন। অর্থাৎ এটা ছিল তাঁদের ব্যবসা। এই ব্যবসার গোপন বিষয়গুলো তাঁরা কাউকে জানাতে চাননি।

তবু বিভিন্ন কবরের দেয়ালে আঁকা চিত্রে এ ব্যাপারে অল্পস্বল্প তথ্য পাওয়া যায়। যেমন থেবসের এক কবরের দেয়ালচিত্রে দেখা যাচ্ছে, মমির শেষ ধাপ—মৃতদেহকে কাপড়ে মোড়ানো হচ্ছে। এই চিত্রে দেখা যাচ্ছে, দেহটি টেবিলে নয়, দুটি পাথরখণ্ডের ওপরে রাখা আছে। বোঝাই যাচ্ছে, কাপড়ে মোড়ানোর সুবিধার্থেই এমনটা করা হয়েছে।

একইভাবে হাওয়ারা প্যাপিরির চারটি প্যাপিরাস থেকে জানা যায়, যাঁরা মমি বানানোর কাজ করতেন, মিসরীয়রা তাঁদের বলতেন ‘আনুবিসের মানুষ’। ইংরেজিতে তাঁদের বলা হয় এম্বমার (Embalmer)। তাঁদের আনুবিসের মানুষ ডাকার কারণ জানা যায় প্রাচীন মিসরীয় কিংবদন্তি থেকে। এ কিংবদন্তি বলে, মিসরীয়দের শিয়ালমুখো দেবতা আনুবিস পৃথিবীর প্রথম মমি বানিয়েছিলেন। মমিটি ছিল মিসরীয়দের দেবতা ওসাইরিসের। বৈজ্ঞানিকভাবে এসব দেবতা বা কিংবদন্তির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি যদিও। তবু মিসরীয়রা এমনটাই ভাবতেন।

আলেকজান্ডার রিন্ড নামের এক স্কটিশ আইনজীবী ১৮৬০ সালে থিবসের গুরনা নামের এক জায়গায় কিছু অভিজাত মিসরীয় কবর খুঁড়তে গিয়ে দেখলেন, সমাধি ডাকাতেরা এগুলো আগেই লুটে নিয়েছে। কিন্তু সেই কবরস্থানে বেশ কিছু মমি পাওয়া গেল। এর মধ্যে ১৪টির পায়ের বুড়ো আঙুলে দেখা গেল ট্যাগ লাগানো। আমরা জামাকাপড়ে যে রকম প্রাইস ট্যাগ দিই, সে রকম নয়। কাঠের ট্যাগ। বোঝা গেল, এম্বমাররা একসঙ্গে যেহেতু অনেক মমি নিয়ে কাজ করতেন, তাই প্রতিটির গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে, তাতে নাম-পরিচয় লিখে রাখতেন। যাতে পরে চেনা যায়।

আলেকজান্ডার রিন্ড আরও খোঁড়ার পর একটি অক্ষত কবর পেলেন। তাতে দেখা গেল, সারকোফ্যাগাস, অর্থাৎ কফিনের ভেতরে স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া মমি এবং কিছু ক্যানোপি জার। স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়ার কারণ, এটি কখনো বিবর্ণ হয় না। মিসরীয়রা তাই স্বর্ণকে ভাবতেন অমরত্বের প্রতীক। এই কবরে মমির পাশে পাওয়া যায় একটি প্যাপিরাস। সেখান থেকে জানা যায়, মৃত ব্যক্তিকে প্রথমে গোসল দেওয়া হয়। তারপর ন্যাট্রন দিয়ে রাখা হয় ৩৫ দিন। ন্যাট্রনে দেহটি শুকিয়ে যায়। তারপর ১৭টি বিভিন্ন রীতি পালন করেন তাঁরা এবং ৭টি পবিত্র তেল ব্যবহার করা হয় মৃতদেহে। এভাবে মারা যাওয়ার ৭০ দিন পর তাঁকে কবরে শোয়ানো হয়।

ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি প্যাপিরাসেও মমি করা নিয়ে কিছু তথ্য আছে। যেমন মৃতদেহকে এম্বমারের কাছে নিয়ে যাওয়া হতো মারা যাওয়ার চার দিন পর। ৪৬তম দিনে মৃতদেহ কাপড়ে মোড়ানো শুরু করা হতো। এক তুতেনখামেন ছাড়া প্রায় সব মমিকেই তাঁদেরই পুরোনো কোনো কাপড় দিয়ে মোড়ানো হয়েছে, যেন মৃতের সঙ্গে তাঁর পরিচিত কিছু থাকে। পাশাপাশি ফ্রাঙ্কিনসেন্স নামে একধরনের গাছের রস (পোড়ালে সুগন্ধ বেরিয়ে আসে) দেওয়া হতো মাথার দিকে এবং মিরহ নামের একধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করা হতো মৃতের পেটের দিকে।

খেয়াল করে দেখুন, এত সব তথ্য পাওয়া গেলেও আসল বিষয়, অর্থাৎ মমি করার জন্য অস্ত্রোপচার কীভাবে হতো, তা কিন্তু এসব প্যাপিরাস থেকে জানা যায়নি। এই তথ্য পাওয়া যায় একজন অমিসরীয় থেকে। তাঁর নাম হেরোডোটাস।

মমি তৈরিতে ব্যস্ত প্রাচীন মিসরীয় মমি বিশেষজ্ঞরা
আরও পড়ুন

পবিত্র লিপির অন্বেষণে

হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে কিছু জিনিস জানা গেল সত্যি, তবু জানা বাকি রয়ে গেল অনেক কিছু। যেমন মমি শুকিয়ে ফেলার সময় কি মৃতদেহের সব রক্ত বের করে নেওয়া হতো? কী পরিমাণ ন্যাট্রন লাগত একটা দেহের জন্য?

তিন

গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস ৪৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিসরে গিয়েছিলেন। তিনি সরাসরি মমি বানানো দেখেছেন বলে মনে হয় না। তবে তিনি মমি বানানোর যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা অন্যান্য প্যাপিরাসের বর্ণনার সঙ্গে যেমন মিলে যায়, তেমনি এর চেয়ে বিস্তারিত আর কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।

তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, মিসরীয়রা কীভাবে মৃতকে নিয়ে শোক করতেন। তারপর এম্বমারদের কাছে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার আগে ঠিক করা হতো, মমি কেমন হবে। এম্বমারদের কাছে বিভিন্ন ধরনের কাঠের তৈরি নমুনা থাকত। তিন ধরনের মমিকরণ প্রক্রিয়া ছিল তাঁদের। মৃতের পরিবার আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী বেছে নিত, কী ধরনের মমি তারা চায়। তারপর একজন এসে মৃতের পেটের ওপরে, একটু বাঁয়ে একটা লাল রেখা টেনে যেতেন। এর দৈর্ঘ্য হতো আড়াই ইঞ্চির মতো। যিনি দাগ দিতেন, ধারণা করা যায়, তিনি চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত কেউই হবেন।

এরপর একজন স্লিটার (যিনি পেট কাটেন) ইথিওপিয়ান অবসিডিয়ান পাথরের ছুরি ব্যবহার করে পেটের ওই দাগ বরাবর চিরে ভেতরের অঙ্গগুলো বের করে আনতেন। পরের ধাপে নাক দিয়ে একটা লোহার হুক ঢুকিয়ে মাথার খুলির ভেতর থেকে মগজ বের করে নেওয়া হতো। তারপর মৃতদেহটিকে ৭০ দিন ন্যাট্রনে রেখে দিয়ে এরপর কবরস্থ করা হতো।

হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে কিছু জিনিস জানা গেল সত্যি, তবু জানা বাকি রয়ে গেল অনেক কিছু। যেমন মমি শুকিয়ে ফেলার সময় কি মৃতদেহের সব রক্ত বের করে নেওয়া হতো? কী পরিমাণ ন্যাট্রন লাগত একটা দেহের জন্য? এই ন্যাট্রন কি তরল হবে, নাকি কঠিন? এ রকম আরও নানা প্রশ্ন। উত্তর খুঁজতে ড. বব ব্রিয়ের একটি প্রকল্প হাতে নিলেন। তিনি ঠিক করলেন, নিজেই একটি মমি বানাবেন! আসুন, এবার তাঁর গল্পটা শোনা যাক।

এভাবেই সারফগসে মমি সংরক্ষণ করত প্রাচীন মিসরীয়রা
প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে মগজের কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাঁরা মগজ বের করে সংরক্ষণ করতেন না। ফেলে দিতেন।

চার

বব ব্রিয়ের লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ও বিখ্যাত মিসরতত্ত্ববিদ। একই সঙ্গে তিনি প্যালিওপ্যাথোলজি বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ বিভিন্ন ফসিল, মমি করা টিস্যু বা খুলির অবশেষ ইত্যাদি থেকে প্রাচীন বিভিন্ন রোগ ও জখম নিয়ে গবেষণা করেন।

প্রথমেই তিনি শুকিয়ে যাওয়া নীল নদের আশপাশের এলাকা থেকে ন্যাট্রন সংগ্রহ করলেন। বারবার এই যে ন্যাট্রন বলছি, জিনিসটা কী? এটা একধরনের প্রাকৃতিক লবণ। সোডিয়াম কার্বনেট ডেকাহাইড্রেট (Na2CO3·10H2O), ১৭ শতাংশ সোডিয়াম বাইকার্বনেট (NaHCO3), অল্প পরিমাণ সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) এবং সোডিয়াম সালফেটের (Na2SO4) মিশ্রণ। এটা তরলও হতে পারে। কিন্তু বব ও তাঁর দল ভাবলেন, একটা দেহকে তরল ন্যাট্রনে চুবিয়ে রাখতে যে পরিমাণ বড় গামলা বা টাব লাগবে, সে রকম কিছু প্রাচীন মিসরের কোনো ধ্বংসাবশেষেই পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের আগে মৃতদেহকে সরাসরি মরুতে কবর দেওয়া হতো। মরুর শুষ্ক বালু ও এর মধ্যে মিশে থাকা লবণের কারণে দেহগুলো অনেকটাই সংরক্ষিত থাকত। কাজেই মিসরীয়দের আসলে তরল নয়, মৃতদেহ শুকানোর জন্য ন্যাট্রন পাউডারই ব্যবহার করার কথা।

এরপর তিনি কায়রো বাজার থেকে ফ্রাঙ্কিনসেন্স ও মিরহ কিনে আনলেন। এরপর সংগ্রহ করলেন ইথিওপিয়ান অবসিডিয়ান পাথরে বানানো ছুরি। পাশাপাশি বিষয়টা পরীক্ষা করার জন্য একটি ব্রোঞ্জের ছুরিও বানিয়ে নিলেন তিনি।

এরপর শুরু হলো মমি বানানো। মৃতদেহের পেটে আড়াই ইঞ্চির মতো লাল দাগ দেওয়া হলো। তারপর ব্রোঞ্জের ছুরি দিয়ে পোঁচ দেওয়া হলো সেখানে। অনেক চেষ্টা করেও লাভ হলো না। কিন্তু ইথিওপিয়ান অবসিডিয়ান পাথরে বানানো ছুরি দিয়ে পোঁচ দিতেই চিরে গেল পেট। অর্থাৎ হেরোডটাসের বর্ণনা ঠিকই ছিল।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এটুকু জায়গা দিয়ে যকৃৎ বের হচ্ছিল না। তখন তাঁরা কাটা অংশটা আরও আধা ইঞ্চি বাড়িয়ে নেন। তারপর একটু চেষ্টা করতেই ৩ ইঞ্চি কাটা দিয়ে বেরিয়ে আসে যকৃৎ। এ ছাড়া অন্ত্র, ফুসফুস এবং পাকস্থলী বের করে আনেন তাঁরা। মিসরীয়রা এই চার অঙ্গকে চারটি ক্যানোপিক জারে সংরক্ষণ করতেন এবং সারকোফ্যাগাসের ভেতরে এই জারগুলো দিয়ে দিতেন।

এই জার নিয়েও আবার কথা আছে। চারটি ক্যানোপিক জারের একটি দেখতে ছিল মানুষের মাথার মতো। এর নাম ইমসেটি। এখানে যকৃৎ রাখা হতো। বেবুনের মাথার মতো দেখতে একটি জারে রাখা হতো ফুসফুস। এর নাম ছিল হাপি। শিয়ালের মাথার মতো ডুয়ামেটেফ নামের একটি জারে রাখা হতো পাকস্থলী। আর কেবেহ্‌ সেনুয়েফ নামের বাজপাখির মাথার মতো দেখতে একটি জারে অন্ত্র রাখা হতো।

ববের দলের একজন এ সময় মজার একটা জিনিস খেয়াল করলেন। মিসরীয়দের বর্ণনায় কোথাও অগ্ন্যাশয়ের কথা নেই। সেটা কোথায়? তাঁরা খেয়াল করলেন, অগ্ন্যাশয়টি আসলে অন্ত্রের সঙ্গেই বেরিয়ে আসে। সে জন্যই এর আলাদা কোনো উল্লেখ নেই। এখন কথা হলো, ভেতরের বাকি অঙ্গগুলো কোথায়? সম্ভাব্য উত্তরটা বোঝা যায় চিন্তা করে। তাঁরা সম্ভবত বাকি অঙ্গগুলো বের করে ফেলে দিতেন।

শুধু হৃৎপিণ্ডটিতে তাঁরা কিছু করতেন না। মিসরীয়দের কাছে হৃৎপিণ্ড ছিল শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাঁদের ধারণা ছিল, মানুষ এই অঙ্গটি দিয়েই ভাবে, এ দিয়েই বিচার-বিবেচনা করে, ভালোবাসে এবং সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। আবার তাঁদের কিংবদন্তি অনুযায়ী, পরকালে এই হৃৎপিণ্ড একটি পাল্লায় মেপেই বিচার করা হবে মানুষের। সে জন্য তাঁরা এতে একদমই হাত দিতেন না।

বব ও তাঁর দল তাই হৃৎপিণ্ডটি যথাস্থানে রেখে, শরীরের বাকি অংশটা ছোট ছোট প্যাকেটে ন্যাট্রন দিয়ে ভর্তি করে দিলেন। এবার লোহার হুক দিয়ে নাকের ভেতর দিয়ে মগজ বের করতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁরা সেটা করতে পারছিলেন না। মগজ তো আর তরল না যে টান দিলেই ওটুকু জায়গা দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

বাধ্য হয়ে তাঁরা লোহার হুকটি ভেতরে ঢুকিয়ে ঘোরাতে লাগলেন। এভাবে ঘুঁটা দেওয়ার ফলে পুরো মগজ ধীরে ধীরে তরলে পরিণত হলো। তখন তাঁরা মৃতদেহটিকে উপুড় করে শোয়ালেন। এবার সব মগজ নাক দিয়ে বের হয়ে গেল। এরপর হুকের মাথায় কাপড় বেঁধে, খুলির ভেতরে ঘষে পরিষ্কার করে নিলেন তাঁরা।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে মগজের কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাঁরা মগজ বের করে সংরক্ষণ করতেন না। ফেলে দিতেন।

এবার শুকানোর পালা। ববের দল জানতেন, এম্বমাররা ঘরের বাইরে দেহ শুকাতেন। তাঁরা সে রকম পরিবেশ সৃষ্টি করলেন কৃত্রিমভাবে, একটি তাঁবুর ভেতরে। তাপমাত্রা রাখা হলো ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো, আর্দ্রতা রাখা হলো ২২ শতাংশের মতো। এরপর পুরো শরীর তাঁরা ন্যাট্রন দিয়ে ঢেকে দিলেন। এ জন্য দরকার হলো ৬০০ পাউন্ড বা ২৭২ কেজির মতো ন্যাট্রন। ৩৫ দিনের মতো এভাবে দেহটিকে শুকানোর পর তাঁরা দেখলেন, দেহটি মমি হয়ে গেছে। একেবারে আদি মিসরীয় পদ্ধতিতে বানানো আধুনিক মমি!

ঘটনা কিন্তু এখানে শেষ হয়নি। মৃতদেহ এক্স–রে করে তাঁরা দেখলেন, শরীরের ভেতরের কিছু অংশের মাংসে পানি রয়ে গেছে তখনো খানিকটা। সে জন্য তাঁরা মমিটিকে আরও দুই থেকে তিন মাস রেখে দেন। এবার কাপড় মোড়ানোর পালা।

কিন্তু কাপড় মোড়াতে গিয়ে তাঁরা টের পেলেন, মিসরের মমির হাত যে রকম বুকের ওপর ক্রস করে রাখা থাকে, সেভাবে রাখা যাচ্ছে না। হাত দুটি শক্ত হয়ে গেছে। তাঁরা বুঝতে পারলেন, সম্ভবত ৩৫ দিন শুকানোর পর মাংসে খানিকটা পানি থেকে যাওয়ার সুযোগ নিয়েই মিসরীয়রা মৃতের হাত ভাঁজ করে দিতেন বুকের ওপর।

যাহোক, ওভাবেই তাঁরা মমিটিকে কাপড়ে মোড়ালেন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাঁদের মমি–রহস্য গবেষণা।

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে যখন মিসরে খ্রিষ্টধর্মের প্রসার ঘটে, তখন মিসরীয়রা ধীরে ধীরে মমি বানানো বন্ধ করে দেন এবং খ্রিষ্টধর্মের নিয়মানুযায়ী লাশ দাফন করতে শুরু করেন।

পাঁচ

বলে রাখা ভালো, সংক্ষিপ্ত এ লেখায় আমি অনেক কিছু নিয়েই লিখিনি। যেমন মিসরীয়রা মমির দেহের কাটাছেঁড়াগুলো সেলাই করে ফেলতেন। মমির মুখের আদলে বানানো মুখোশ পরানো হতো মমির মুখে। তাদের পুরো দেহে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হতো। আবার কবরে দিয়ে দেওয়া হতো নানা জিনিস। এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে আরও অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আবার মমির মূল বিষয়টির সঙ্গে এগুলোর খুব বেশি যোগ নেই। সে জন্যই আর এসব বিষয় নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করছি না।

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে যখন মিসরে খ্রিষ্টধর্মের প্রসার ঘটে, তখন মিসরীয়রা ধীরে ধীরে মমি বানানো বন্ধ করে দেন এবং খ্রিষ্টধর্মের নিয়মানুযায়ী লাশ দাফন করতে শুরু করেন। সে জন্য একসময় ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় মমিশিল্প ও এর গোপন রহস্যগুলো।

কিন্তু ড. বব ব্রিয়ের ও তাঁর দল এসব রহস্যের সমাধান করেন ও মমিশিল্পের জ্ঞান পুনরুদ্ধার করেন। তাঁদের কাজ থেকে প্রথম জানা যায়, মিসরীয়রা নাকের ফুটো দিয়ে মগজ কীভাবে বের করে নিতেন বা পেট কাটার জন্য কেন ইথিওপিয়ান অবসিডিয়ান পাথরের ছুরিই ব্যবহার করতেন। এভাবেই জানা গেল মমি রহস্যের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্নের জবাব। এখানেই বিজ্ঞানের সার্থকতা।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ব্রিটানিকা, লাইভ সায়েন্স, খান একাডেমি; মিসরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত/নিয়াজ মাওলা, জাগৃতি প্রকাশনী