যেভাবে করবেন বিজ্ঞান প্রজেক্ট

সামিয়া বিজ্ঞান নিয়ে একটু বেশিই উৎসাহী। ছোটবেলা থেকে সে বাতিল জিনিসপত্র দিয়ে আজব আজব জিনিস বানানোর চেষ্টা করে। কখনও মায়ের পুরোনো প্রেসার কুকার দিয়ে রকেট বানাতে গিয়ে রান্নাঘরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, আবার কখনও চেষ্টা করেছে বাবার টর্চলাইট খুলে নতুন লাইট সিস্টেম তৈরি করতে। এসব করার একটা ভালো সুযোগও পেয়ে গেছে সামিয়া। স্কুলের বিজ্ঞান মেলা! 

স্কুলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে দুই সপ্তাহ পর বিজ্ঞান মেলা। পুরস্কার মাইক্রোস্কোপ! সামিয়া খুব উত্তেজিত। মাইক্রোস্কোপ মানেই তো খুঁজে খুঁজে জীবাণু দেখা!  কিন্তু সামিয়ার আনন্দ বেশি সময় স্থায়ী হলো না। ওর বন্ধুদের দারুণ দারুণ আইডিয়া আছে প্রজেক্ট নিয়ে। কেউ রোবট বানাবে, কেউ বানাবে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টসহ কত কী! কিন্তু সামিয়া কী বানাবে? মাথায় তো কিছুই আসছে না।

সামিয়ার হতাশা দেখে মা বললেন, ‘তোর তো সবসময় কোনো না কোনো নতুন কাণ্ড থাকে। এবার মাথা খাটিয়ে কিছু বের কর। আশপাশ থেকে কিছু বেছে নে।’

কিন্তু কী বাছাই করবে ও। বললেই কী একটা কিছু বাছাই করা যায়! আনমনে ভাবতে ভাবতে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল সামিয়া। ফেরার পথে দেখল, ওদের পাড়ার এক বিশাল গাছ মরে যাচ্ছে। গাছটার পাতা হলুদ হয়ে গেছে, ডালপালাও গেছে শুকিয়ে। বাসায় ফিরে মায়ের কাছে এর কারণ জানতে চাইল। মা জানালেন, গাছের গোড়ায় হয়তো পর্যাপ্ত পানি বা পুষ্টি নেই।’

হঠাৎ সামিয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে ভাবল, এমন কিছু একটা তৈরি করতে হবে যাতে গাছ মাটি থেকে পুষ্টি পাবে এবং পানি ধরে রাখবে, বেঁচে যাবে গাছগুলো। এরকম কি তৈরি করা যায়, তা জানতে কিছুক্ষণ গুগল করল। তারপর ইউটিউবের সাহায্য নিল। সে শিখল, কীভাবে বায়োফার্টিলাইজার তৈরি করা যায়।

আরও পড়ুন

এবার শুরু হলো কাজ। গাছের পুষ্টি চাহিদা নিয়ে পড়াশোনা করে প্রয়োজনীয় উপাদানের একটি তালিকা তৈরি করল। পুরোনো আঁখের আঁটি, শুকনো গাছের পাতা, সবজির খোসা আর ডিমের খোসা সংগ্রহ করে একসঙ্গে মিশিয়ে একটি কম্পোস্ট তৈরি করল। এগুলো দিয়ে একটা প্রাথমিক পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিল সামিয়া।

প্রথমে দুটি বড় টব নিল। একটায় রাখল সাধারণ মাটি, অন্যটায় মাটির সঙ্গে নিজের তৈরি করা বায়োফার্টিলাইজার। এরপর একই জাতের দুটি গাছ লাগাল। প্রতিদিন পানি দিয়ে সে খেয়াল রাখল এবং নিয়মিত নোট লিখে রাখত।

এক সপ্তাহের মধ্যে বায়োফার্টিলাইজারের গাছটা অনেক সবুজ আর সতেজ হলো, কিন্তু সাধারণ মাটির গাছটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল। তার মানে, সামিয়ার পরীক্ষা সফল। তার তৈরি ফার্টিলাইলাইজার কাজ করছে।

এখন পোস্টার তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে সামিয়া বেশি পারদর্শী নয়। ফলে বড় বোনের সাহায্য নিল। তবে বড় কিন্তু পোস্টার বানিয়ে দেয়নি। বরং তাঁর সাহায্য নিয়ে পোস্টার সামিয়া নিজেই বানিয়েছে। তৈরি হলো একটা রঙিন পোস্টার। পোস্টারে বড় অক্ষরে লেখা ‘বাসাবাড়ির সামগ্রী দিয়ে বায়োফার্টিলাইজার!’ সঙ্গে সম্পূর্ণ পরীক্ষার ছবি আঁকা হলো।

এতিমধ্যে বিজ্ঞান মেলার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সামিয়া তার প্রজেক্ট নিয়ে মেলায় গেল। চারপাশে অনেক প্রজেক্ট। বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং, পানি সংরক্ষণের প্রজেক্ট, প্লাস্টিক বোতল দিয়ে ইকো-ব্রিক, সোলার-ওভেনের মতো নানা নতুন নতুন উদ্ভাবন। এতকিছু দেখে সামিয়া একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল!

আমরা অনেকে বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারি না শুধু এই চিন্তা করে যে কি প্রজেক্ট বানাবো, বা বন্ধুরা তো অনেক ভালো প্রজেক্ট বানাচ্ছে, শুধু শুধু এর চেয়ে খারাপ প্রজেক্ট বানিয়ে লাভ কী!

বিচারকরা তার স্টলে এলে সে হাসিমুখে সবাইকে সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝিয়ে বলল। কীভাবে বায়োফার্টিলাইজার তৈরি করা যায়, কীভাবে এটা গাছের পুষ্টি জোগায়—সবকিছু। বিচারকরা তাকে কিছু প্রশ্ন করল। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে সামিয়া। কারণ, সে নিজে হাতে কলমে পরীক্ষা করে ফার্টিলাইজার বানিয়েছে। শুধু ইউটিউব দেখে বা বড় বোনের সাহায্য নিয়ে এটা বানায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, সামিয়া সম্পূর্ণ বিষয়টা নিজে বুঝে করেছে। এবার দেখা যাক, সামিয়ার এই গল্প থেকে আমরা কি শিখলাম?

আমরা অনেকে বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারি না শুধু এই চিন্তা করে যে কি প্রজেক্ট বানাবো, বা বন্ধুরা তো অনেক ভালো প্রজেক্ট বানাচ্ছে, শুধু শুধু এর চেয়ে খারাপ প্রজেক্ট বানিয়ে লাভ কী!

কিন্তু বিজ্ঞান মেলায় অংশ নেওয়া মানে শুধু একটি প্রজেক্ট তৈরি করা নয়, এটি নিজের কল্পনা, উদ্ভাবনীশক্তি এবং মেধা প্রকাশ করার সুযোগ। নতুন কিছু শেখার এবং নিজের চারপাশের সমস্যার সমাধান করার একটা সুযোগও বটে।

এই সুযোগটাকে আমরা কয়েকটি ধাপে আমরা বর্ণনা করতে পারি।

১. আকাশ কুসুম ভাবুন, কিন্তু পা রাখুন মাটিতে!

বিজ্ঞান মেলার প্রথম ধাপ হলো প্রকল্পের আইডিয়া। কিন্তু আইডিয়া আসবে কোথা থেকে? হতে পারে আমাদের চারপাশ থেকে। নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, অনেক সমস্যা দেখতে পাবেন। যেমন, পানির অপচয়, পরিবেশ দূষণ, ট্র্যাফিক জ্যাম, শব্দ দূষণ। অথবা আপনার আগ্রহ থাকতে পারে রোবট কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। তাহলে সে বিষয় নিয়েই কাজ করুন।

নতুন কিছুও ভাবতে পারেন। যেমন, কীভাবে বাসার ঝাড়ুতে মোটর লাগিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ময়লা পরিষ্কার করা যায়? অথবা মোবাইলের সাহায্যে বিদ্যুৎ বাঁচানোর উপায়। ভাবনা যাই থাকুক না কেন, সেগুলো যেন বাস্তবসম্মত হয়। একটা ঘোড়া কীভাবে আকাশে ওড়ানো যায় টাইপের কল্পনা করে সে অনুসারে প্রজেক্ট না বানানোই ভালো। কারণ, ঘোড়া মাটিতেই ঠিক আছে।

হয়তো আপনি ব্যর্থ হবেন, কিন্তু মাথায় রাখবেন, সেই ব্যর্থতার মধ্যেও নতুন কিছু শেখা হবে। এক্ষেত্রে ব্যর্থতাও একটা সফলতা!

২. নিজেই গবেষণা করুন, প্রয়োজনে প্রযুক্তির সাহায্য নিন

আইডিয়া ঠিক করার পর সে ব্যাপারে গবেষণা করতে হবে। গুগলে খুঁজে দেখতে পারেন, আপনার আইডিয়া নিয়ে আগে কেউ কোনো কাজ করেছে কি না। লাইব্রেরিতে যান, বই পড়ুন। স্কুলের শিক্ষক, ভাই-বোন, পিতা-মাতা বা বড়দের সঙ্গে আলোচনা করুন।

৩. ভুল থেকে শিখুন

এবার শুরু হবে আপনার প্রকল্পের সবচেয়ে মজার অংশ—পরীক্ষা। হয়তো আপনি ব্যর্থ হবেন, কিন্তু মাথায় রাখবেন, সেই ব্যর্থতার মধ্যেও নতুন কিছু শেখা হবে। এক্ষেত্রে ব্যর্থতাও একটা সফলতা! আর প্রথমবার সফল হলে তো কোনো কথাই নেই। পরীক্ষা করে সবকিছু নোট করে রাখুন।

৪. ফলাফল বিশ্লেষণ করুন

এরপর নিজের পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে হবে। সেজন্য চার্ট বা গ্রাফ তৈরি করতে পারেন। এতে সহজে ডেটা বোঝা যাবে। আপনার মনে যে প্রশ্ন ছিল, তার উত্তর কী এই পরীক্ষা থেকে পাওয়া গেল? ভবিষ্যতে এই প্রজেক্ট থেকে কি পাওয়া যাবে, তা ভাবুন।

৫. পোস্টার তৈরি করুন

বিজ্ঞান মেলায় আপনার কাজ উপস্থাপন করতে সুন্দর পোস্টার তৈরি করা জরুরি। পোস্টার বানাতে হবে সহজ ও পরিষ্কারভাবে। জটিল কথা এড়িয়ে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা দিন। আপনার প্রকল্পের গল্প বলুন। রঙিন ও আকর্ষণীয় পোস্টার বানান যেন দেখলেই বিচারকদের মন ভরে যায়। ছবি ও গ্রাফ দিয়ে পোস্টার সাজান।

আপনি নিজেই যেহেতু সবকিছু ঘেঁটে প্রজেক্ট তৈরি করেছেন, তাই আত্মবিশ্বাসের অভাব হওয়ার কথা নয়। পাশাপাশি আপনার বন্ধুসুলভ আচরণ বিচারকদের মন জয় করতে সাহায্য করবে।

৬. আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলুন

মেলার দিন আপনার প্রকল্পের গল্প সবাইকে শোনানোর পালা। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রজেক্ট ব্যাখ্যা করুন। আপনি নিজেই যেহেতু সবকিছু ঘেঁটে প্রজেক্ট তৈরি করেছেন, তাই আত্মবিশ্বাসের অভাব হওয়ার কথা নয়। পাশাপাশি আপনার বন্ধুসুলভ আচরণ বিচারকদের মন জয় করতে সাহায্য করবে। সহজ ভাষায় উপস্থাপনা করলে বিচারকরাও খুশি হবেন।

এসব ধাপ মেনে কাজ করলে আপনার জন্য পুরস্কার পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। তারপরেও যদি কোনো কারণে পুরস্কার না পান, তাতেও সমস্যা নেই। নতুন অনেক কিছু শেখা হয়ে যাবে। পরের বছর একইভাবে আবার চেষ্টা করুন। পুরস্কার চলে আসবে আপনার হাতের মুঠোয়!

লেখক: শিক্ষার্থী, গভর্নমেন্ট কলেজ অফ অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স

সূত্র: নাসা