জানা-অজানা
আজ পর্যন্ত কতগুলো পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে
১৯৪৫ সালে ট্রিনিটি টেস্টের মাধ্যমে শুরু। একই বছর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের বেশ কিছু দেশ নেমে পড়ে পরমাণূ শক্তি প্রতিযোগিতায়। সেই ধারাবাহিকতায় কতগুলো বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে এ পর্যন্ত?
ম্যানহাটন প্রকল্পের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। যাঁরা আগে শোনেননি, ক্রিস্টোফার নোলানের সাম্প্রতিক মুভি ওপেনহাইমার-এর কল্যাণে নামটা তাঁদেরও পরিচিত হয়ে গেছে। বাস্তবে এই প্রকল্পের অধীনেই প্রথম পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অবশ্যই, পরীক্ষার জন্য। সেটা ১৯৪৫ সালের কথা। সে বছরের ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর ইয়োর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমিতে ঘটানো হয় প্রথম পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ—ট্রিনিটি টেস্ট।
এর কিছুদিন পর, একই বছরের ৬ ও ৯ আগস্ট মানব ইতিহাসের ভয়ংকরতম কাজগুলোর একটি ঘটে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান নামে দুটি পরমাণু বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে অন্তত ৭টি দেশ নিজেদের পারমাণবিক শক্তির পরীক্ষা চালিয়েছে, পারমাণবিক বিকিরণের ভয়াল শক্তি উন্মুক্ত করেছে পৃথিবীতে। এই ঘটনা পরিক্রমায় ঠিক কয়টি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে এখন পর্যন্ত?
সাম্প্রতিক পরমাণু বোমার পরীক্ষাটি চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া, ২০১৭ সালে। দেশটি সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। তাদের বিস্ফোরিত বোমা পর্যক্ষণ করে সিটিবিটির স্টেশনগুলো জানায়, বোমাটি ছিল অন্তত ১৪০ কিলোটন—হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়েও ৮ গুণ বেশি শক্তিশালী
একদম সঠিক সংখ্যাটি হলফ করে বলার উপায় নেই। তবে বিজ্ঞানীদের হিসাবে ২ হাজার ৫৬টি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রই এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩০টি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে দেখেছে, যার মধ্যে দুটি ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধে—যে দুটির কথা বলেছি আগেই। সে কালের সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আজকের রাশিয়া এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করেছে ৭১৫টি পারমাণবিক বোমা। ফ্রান্স পরীক্ষা চালিয়েছে ২১০টি, যুক্তরাজ্য ও চীন পরীক্ষা করেছে ৪৫ বার, এদিকে উত্তর কোরিয়া ৬টি পরীক্ষা চালিয়েছে, ভারত পরীক্ষা করেছে তিনবার এবং পাকিস্তান দুবার।
সন্দেহ করা হয় আরও একটি পরীক্ষা চালানো হয়েছে। ‘ভেলা ইনসিডেন্ট’ নামের সেই পরীক্ষার দিনক্ষণ ধরা হয় ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। সেদিন আফ্রিকা ও অ্যান্টার্কটিকার মাঝামাঝি, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপে দুটো আলোর ঝলক ও বিকিরণ শনাক্ত করে মার্কিন ভেলা হোটেল স্যাটেলাইট। তবে সেটা আসলেই পরমাণু বোমার বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট কি না, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটিসহ হিসাব করলে সংখ্যাটা হবে ২ হাজার ৫৭।
১৯৯০ দশকের পর থেকে পরমাণু বোমা পরীক্ষার কথা সচরাচর জানা যায় না। এর রাজনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব আজও মানুষকে আতঙ্কিত করে, চিন্তিত করে। স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পরমাণু বোমা পরীক্ষার বিপক্ষে। তবে ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত সময়টা কিন্তু এমন ছিল না। সে সময় পরমাণু বোমার পরীক্ষা ছিল সাধারণ ঘটনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি তো টেনে দিল দুটি পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ, কিন্তু শুরু হয়ে গেল স্নায়ুযুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যকার টানাপোড়েনে এক ১৯৬২ সালেই পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালানো হয়েছে ১৭৮ বার! সে বছর ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস’ নামের এক ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক সংঘাত লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
বিশ্বজুড়ে তখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে মানুষ। ১৯৬৩ সালে ‘লিমিটেড টেস্ট ব্যান ট্রিটি’, অর্থাৎ পরমাণু বোমার পরীক্ষা সীমিত করে আনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মধ্যে। এভাবে ধীরে ধীরে কমে আসে পরমাণু বোমার পরীক্ষা। পরে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে মোট ১০৮টি দেশ। তবু এর পরো চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো কিছু পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে।
পরে, ১৯৯৬ সালে ‘কম্প্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার-টেস্ট-ব্যান ট্রিটি’ বা সিটিবিটি স্বাক্ষরিত হয়। ১৮৭টি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির আওতায় বিশ্বের ৩২১টি স্থানে স্টেশন বসানো হয়। এগুলোতে সিসমিক বা ভূকম্পন শনাক্তকারী, হাইড্রোঅ্যাকুইস্টিক তথা পানিতে শব্দ শনাক্তকারী, ইনফ্রারেড বা অবলাল ও রেডিওনিউক্লাইড তথা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শনাক্তকারী প্রযুক্তি রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে পরমাণু বোমা বিস্ফোরিত হলে যেন শনাক্ত করা যায়। এ ছাড়াও পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলা হাজারো কৃত্রিম উপগ্রহ তো রয়েছেই।
সাম্প্রতিক পরমাণু বোমার পরীক্ষাটি চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া, ২০১৭ সালে। দেশটি সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। তাদের বিস্ফোরিত বোমা পর্যক্ষণ করে সিটিবিটির স্টেশনগুলো জানায়, বোমাটি ছিল অন্তত ১৪০ কিলোটন—হিরোশিমায় ফেলা বোমার চেয়েও ৮ গুণ বেশি শক্তিশালী। এ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে। তবে এখন পর্্যন্ত বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
বর্তমান বিশ্বের নয়টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, ভারত, ইসরায়েল, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তান। এই দেশগুলোর কাছে মোট প্রায় ১৩ হাজার পরমাণু অস্ত্র রয়েছে বলে জানা গেছে
বর্তমান বিশ্বের নয়টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, ভারত, ইসরায়েল, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তান। এই দেশগুলোর কাছে মোট প্রায় ১৩ হাজার পরমাণু অস্ত্র রয়েছে বলে জানা গেছে। ইরানের পরমাণু প্রকল্পও যথেষ্ট উন্নত, তবে দেশটি এখনো পরমাণু বোমা বানিয়েছে—এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরমাণু বোমা নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, সাধারণ মানুষ যে এর পক্ষে না, তা স্পষ্ট। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিহন হিদানকায়োকে, ‘পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব অর্জনের প্রচেষ্টায়’ ভূমিকা রাখার জন্য। এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আছেন হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে ফেরা জীবন্ত সাক্ষীরা। (সূত্র: প্রথম আলো)
প্রযুক্তির উন্নতি, বিজ্ঞানের অগ্রগতির মূল লক্ষ্য মানুষের জীবনমানে উন্নতি ও পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখা। তাই আজও বহু মানুষ, হয়তো খানিকটা বোকার মতোই, বিশ্বাস করেন, একসময় পৃথিবী হবে পরমাণু বোমা মুক্ত। পারমাণবিক শক্তি ব্যবহৃত হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, মহাকাশযাত্রা বা এরকম প্রয়োজনীয় সব কাজে। মানুষের ক্ষতির জন্য পরমাণুশক্তি ব্যবহার হবে না।