বীজগণিতের জনক কে

মুসা আল-খোয়ারিজমিবায়াত আল ফান

দুটি সংখ্যার যোগফল ১৫। একটি সংখ্যা ৭ হলে অপরটি কত? স্কুলে এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর করতে গিয়ে ‘ধরি’ বা ‘মনে করি’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। কোনো অজানা সংখ্যা বের করতে হলে হরহামেশা আমরা ‘x’, ‘y’ বা ‘z’ ধরে নিয়েছি। অঙ্কের এই বিশেষ শাখার নাম বীজগণিত। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কোথা থেকে এই বীজগণিতের শুরু হলো? কে আবিষ্কার করল বীজগণিত? এর জনক কে?

বীজগণিতের জনককে খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে ১২০০ বছর আগে। তখন ইউরোপ অন্ধকারে ডুবে থাকলেও আরব বিশ্ব ছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোয় ঝলমলে। সেই সময়ের সবচেয়ে উন্নত শহরগুলোর একটা ছিল বাগদাদ। বর্তমানের ইরাক। খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে গড়ে উঠেছিল এক বিখ্যাত লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র। নাম ‘বায়তুল হিকমাহ’ বা জ্ঞানের ঘর। ইংরেজিতে বলে হাউজ অব উইজডোম। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে জ্ঞানী-গুণীরা সেখানে যেতেন জ্ঞানচর্চা করতে। সেই জ্ঞানের ঘরেই কাজ করতেন আমাদের আজকের গল্পের নায়ক মুসা আল খোয়ারিজমি। তাঁকেই বলা হয় বীজগণিতের জনক। কীভাবে তিনি বীজগণিতের জনক হলেন, চলুন তা জানার চেষ্টা করি।

আজ থেকে প্রায় ১২৫০ বছর আগে খোয়ারিজমি নামে অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন মুসা আল খোয়ারিজমি। তাঁর পুরো নাম মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি। এই স্থানের নামানুসারেই তাঁর নাম হয় খোয়ারিজমি। এর মানে, খোয়ারিজমি থেকে আগত ব্যক্তি। এই অঞ্চলটি তখন বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। বর্তমানে এটি তুর্কমেনিস্তান আর উজবেকিস্তানের অংশ। খোয়ারাজমি ছিল সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বাস করত। গ্রিক, পারসিয়ান, আরবীয় আর ভারতীয়দের আনাগোনা ছিল। ছোট্ট মুসা এই বৈচিত্র্যময় পরিবেশে বেড়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

বড় হয়ে মুসা খোয়ারিজমি অঞ্চল ছেড়ে বাগদাদে চলে যান। আগেই বলেছি, সেখানে ছিল বায়তুল হিকমাহ বা জ্ঞানের ঘর। মুসা গিয়ে সেখানে যোগ দেন। তিনি এখানে গ্রিক দার্শনিক ইউক্লিডের জ্যামিতি পড়তেন। ভারতীয় গণিতবিদদের সংখ্যা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করতেন। পারসিয়ান জ্যোতির্বিদদের নক্ষত্র গণনার পদ্ধতিও শিখতেন। এভাবে বছরের পর বছর কাজ করে তিনি বায়তুল হিকমার পরিচালক হয়ে ওঠেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রিক আর ভারতীয় বই আরবিতে অনুবাদ হয়। কিন্তু শুধু অনুবাদ করেই থেমে থাকেননি মুসা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর শেখা নানা ধরনের জ্ঞান একসঙ্গে করে নতুন কিছু তৈরি করা যেতে পারে। তাই নিজেই নতুন কিছু তৈরি করতে চাইলেন। 

মুসা দেখলেন, মানুষের প্রতিদিনের জীবনে অনেক জটিল হিসাব-নিকাশের করতে হয়। যেমন, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ভাগাভাগি করা, জমির মাপজোখ নেওয়া, ব্যবসার লাভ-লোকসানের হিসাব রাখাসহ আরও কত কাজ। এই সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য তিনি একটি নতুন এবং সহজ পদ্ধতির কথা ভাবলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ৮২০ সালে আল-কিতাব আল-মুখতাসার ফি হিসাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা নামে একটি বই লিখলেন। নামটা বেশ বড় আর কঠিন, তাই না? তবে এর অর্থ সহজ—পূর্ণতা আর ভারসাম্যের হিসাব নিয়ে সংক্ষিপ্ত বই। এই বইটিই পরে বীজগণিতের ভিত্তি হয়ে উঠে। আসলে বইয়ের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বীজগণিতের মূল রহস্য। 

মুসা আল-খোয়ারিজমি এই দুটি সহজ নিয়ম ব্যবহার করে সমীকরণ সমাধানের একটি গোছানো পদ্ধতি তৈরি করেন। তিনিই প্রথম দেখালেন, কীভাবে অজানা রাশিকে x বা y ধরে মান বের করা যায়। দ্বিঘাত সমীকরণের পদ্ধতিগত সমাধানও তিনিই প্রথম দেখান।

প্রথমটা হলো ‘আল-জাবর’। আরবি এই শব্দের মানে ‘ভাঙ্গা জিনিসকে জোড়া লাগানো’। গণিতের ভাষায় এর মানে, সমীকরণের একপাশে থাকা ঋণাত্মক সংখ্যাকে অন্য পাশে নিয়ে ধনাত্মক করা। একটা উদাহরণ দিই। 

x − 5 = 10 একটা সমীকরণ। এখানে আল-জাবর পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা -5 কে সমীকরণের ডান পাশে নিয়ে যাব। তখন এটি হয়ে যাবে +5। অর্থাৎ, x = 10 + 5। এভাবে ভাঙা সম্পর্কটা জোড়া লেগে গেল! আমরা x-এর মান পেলাম 15। এই ‘আল-জাবর’ শব্দ থেকেই পরে ইংরেজিতে ‘অ্যালজেবরা’ শব্দটি এসেছে। বাংলায় একে বলা হয় বীজগণিত।

এবার মুসার দ্বিতীয় রহস্যটা বলি। দ্বিতীয় শব্দটা হলো ‘আল-মুকাবালা’। এর মানে ঘ্যাচাং করে কেটে দেওয়া। বুঝিয়ে বলছি। আল-মুকাবালা শব্দের অর্থ ‘মুখোমুখি করা’ বা ‘ভারসাম্য রক্ষা করা’। অর্থাৎ, সমীকরণের দুই পাশে যদি একই জিনিস থাকে, তবে সেগুলো বাদ দিয়ে সমীকরণকে ছোট করে ফেলা যায়। এটাকেই বলছি ঘ্যাচাং করে কেটে দেওয়া।

ধরুন, x + 7 = y + 7 একটি সমীকরণ। এখানে সমান চিহ্নের উভয় পাশেই +7 আছে। আল-মুকাবালা পদ্ধতি অনুযায়ী, আমরা দুই পাশ থেকেই ঘ্যাচাং করে 7 বাদ দিতে পারি। তাহলে সমীকরণটি দাঁড়ায় x = y। অর্থাৎ, উভয় পাশ তেকে 7 বাদ দিয়ে সমীকরণে ভারসাম্য আনা হলো। 

আরও পড়ুন

মুসা আল-খোয়ারিজমি এই দুটি সহজ নিয়ম ব্যবহার করে সমীকরণ সমাধানের একটি গোছানো পদ্ধতি তৈরি করেন। তিনিই প্রথম দেখালেন, কীভাবে অজানা রাশিকে x বা y ধরে মান বের করা যায়। দ্বিঘাত সমীকরণের পদ্ধতিগত সমাধানও তিনিই প্রথম দেখান।

শুধু বীজগণিতই নয়, আরও নানা বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন খোয়ারিজমি। সেগুলো নিয়ে এখানে সংক্ষেপে কিছু আলাপ করছি। আল-খোয়ারিজমি নাম থেকে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ—‘অ্যালগরিদম’। তাঁর নামের ল্যাটিন শব্দ Algoritmi থেকেই এই শব্দের উৎপত্তি। অ্যালগরিদম মানে হলো কোনো কাজ ধাপে ধাপে সম্পন্ন করার পদ্ধতি। প্রযুক্তিবিদ মাত্রই এই শব্দের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন!

সংখ্যা নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। এর আগে আরবীয় আর ইউরোপীয়রা রোমান সংখ্যা ব্যবহার করত। রোমান সংখ্যায় লেখা হতো এভাবে: I, II, III, IV, V। এই পদ্ধতিতে বড় সংখ্যা দিয়ে হিসাব করা খুব কঠিন ছিল। আল-খোয়ারিজমি দেখালেন, ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি অনেক সহজ আর শক্তিশালী। তিনি এই সংখ্যা পদ্ধতি নিয়ে একটি বই লিখলেন। এই বইয়ের মাধ্যমে ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি প্রথমে আরবে, পরে ইউরোপে ছড়িয়ে যায়। পাশাপাশি তিনি বড় সংখ্যার গুণফল বের করতে ‘জাল পদ্ধতি’ নামে একটি কৌশল তৈরি করেছিলেন। এই পদ্ধতিতে একটি জালের মতো ছক কেটে তার মধ্যে সংখ্যা বসিয়ে গুণফল বের করা যেত। এই পদ্ধতি পরে ইতালীয় গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি ইউরোপে পৌঁছে দেন।

আল-খোয়ারিজমির জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও গণনায় সূর্যক্যালেন্ডার আরও নিখুঁত হয় এবং সময় গণনার যন্ত্র তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে
বায়াত আল ফান

জ্যোতির্বিদ্যায়ও খোয়ারিজিমির অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যা দিয়ে সূর্য আর অন্যান্য নক্ষত্র দেখে সময় নির্ণয় করা যেত। এই যন্ত্রের নাম ছিল ‘কোয়াড্রেন্ট’। তিনি ‘জিজ আল-সিন্ধিন্দ’ নামে জ্যোতির্বিদ্যার একটি সারণি তৈরি করেছিলেন। এই সারণিতে সূর্য, চাঁদ আর গ্রহদের অবস্থান নির্ণয় করার পদ্ধতি ছিল। কখন সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হবে, তাও এই সারণি থেকে বের করা যেত। সূর্যঘড়ি উন্নত করার কাজও করেছিলেন তিনি। তাঁর তৈরি সূর্যঘড়ি মসজিদে বসানো হতো নামাজের সময় নির্ধারণের জন্য। তিনি ইহুদি ক্যালেন্ডার নিয়েও কাজ করেছিলেন। এছাড়া ভূগোলেও তাঁর অবদান ছিল। তবে সেদিকে আজ আর না গিয়ে গণিতেই থাকি।

নানা বিষয়ে খোয়ারিজমির অবদান থাকলেও তাঁর মূল কাজ ছিল গণিত নিয়ে। আজও আমরা তাঁর কাজের সুফল ভোগ করছি। আপনি যখন স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তখন খোয়ারিজমির গণিত কাজে লাগে। কমিউটার, ইন্টারনেট, এমনকি এআইয়ের পেছনেও আছে বীজগণিত। একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাবেন, নতুন ওষুধ তৈরি করবেন কিংবা একটা নতুন মোবাইল অ্যাপ বানাবেন—সবখানে লাগবে বীজগণিত। এই সব কিছুর শুরু হয়েছিল মুসা আল-খাওয়ারিজমির হাত ধরে। তিনি শুধু গণিতের একটি শাখা তৈরি করেননি; তিনি দেখিয়েছেন, বিভিন্ন সংস্কৃতির জ্ঞান একসঙ্গে করে নতুন কিছু সৃষ্টি করা যায়। তিনি গ্রিক জ্যামিতি, ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি, পারসিয়ান জ্যোতির্বিদ্যা আর আরবীয় বাস্তবতাকে মিলিয়ে তৈরি করেছিলেন বীজগণিত। প্রমাণ করেছিলেন, জ্ঞানের কোনো সীমা নেই। মানুষের কৌতূহল আর পরিশ্রম দিয়ে পুরো পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব।

আজও যখন কোনো শিক্ষার্থী প্রথমবার বীজগণিত শেখে, সে আল-খোয়ারিজমির দেখানো পথেই চলে। যখন কোনো বিজ্ঞানী একটি নতুন কিছু আবিষ্কার করেন, তখন তিনি খোয়ারিজমির তৈরি করা হাতিয়ার ব্যবহার করেন। এভাবেই গণিতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন মুসা আল-খোয়ারিজমি।

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট, ম্যাথমেটিক্স হিস্টরি, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু