সংখ্যাপদ্ধতি কীভাবে আমাদের চিন্তাভাবনা বদলে দেয়
২.৪ লিটার পানিতে কত মিলিলিটার পানি হয়? হয়তো এক সেকেন্ড ভেবেই উত্তর দেবেন ২ হাজার ৪০০ মিলিমিটার। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করি ২.৪ ঘণ্টায় কত মিনিট হয়? এবার হয়তো আপনাকে একটু ভাবতে হবে! চট করে ২৪০ মিনিট বললে কিন্তু ভুল হবে। কারণ, ২.৪ ঘণ্টা মানে ১৪৪ মিনিট।
প্রথম প্রশ্নটা সহজ লাগলো কেন? কারণ আমরা যে সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করি সেটা দশ ভিত্তিক। কিন্তু সময় মাপার পদ্ধতি ষাট ভিত্তিক। দুটো আলাদা পদ্ধতি একসঙ্গে মিশে গেলে আমাদের মাথায় একটু গোলমাল লেগে যায়। এই ছোট্ট ব্যাপারটাই আমাদের চিন্তাভাবনা, শেখা এবং সংস্কৃতিতে বড় প্রভাব ফেলে।
ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশনস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি জার্নালের একটা বিশেষ সংখ্যায় এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নৃতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান, দর্শন আর মনোবিজ্ঞান মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, মানুষ কীভাবে সংখ্যা বোঝে আর সংখ্যাপদ্ধতি তৈরি করে।
গণিতে বেস বা ভিত্তি কী?
আমরা প্রতিদিন সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার করি, কিন্তু এর ভেতরের গঠনটা নিয়ে হয়তো সেভাবে ভাবি না। বেস বা ভিত্তি হলো সংখ্যা পদ্ধতির একটা বিশেষ সংখ্যা। আমাদের স্মৃতিশক্তি তো সীমিত। প্রতিটা সংখ্যার জন্য আলাদা আলাদা নাম মনে রাখা সম্ভব না। তাই আমরা কয়েকটা মাত্র সংখ্যা দিয়ে বড় সংখ্যা তৈরি করি। যেমন তিনশ বিয়াল্লিশ।
বেশিরভাগ সংখ্যা পদ্ধতিতেই মূল ভিত্তি থাকে। ইংরেজি ভাষায় দশমিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। মানে দশের ঘাত দিয়ে তৈরি করা হয় সংখ্যা। যেমন তিনশ বিয়াল্লিশকে ইংরেজিতে লেখে থ্রি হান্ড্রেড অ্যান্ড ফোর্টি টু। মানে তিন গুণ দশের দুই ঘাত ৩০০, চার গুণ দশের এক ঘাত ৪০ এবং দুই গুণ দশের শূন্য ঘাত ২।
এই বেস সিস্টেমের কারণে আমরা যে কোনো আকারের সংখ্যা প্রকাশ করতে পারি। এতে মস্তিষ্কে বেশি চাপ পড়ে না। কিন্তু সময়ের হিসাবের বেস বা ভিত্তি তো ১০ নয়! ওটার বেস হলো ৬০। তাই ২.৪ ঘণ্টাকে ১০ দিয়ে গুণ করলে তো হিসাব মিলবে না! এখানেই বেঁধে যায় আসল গণ্ডগোল।
বেশিরভাগ সংখ্যা পদ্ধতিতেই মূল ভিত্তি থাকে। ইংরেজি ভাষায় দশমিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। মানে দশের ঘাত দিয়ে তৈরি করা হয় সংখ্যা।
ভাষা যেভাবে গণনাকে প্রভাবিত করে
সংখ্যাকে বিমূর্ত জিনিস মনে হলেও কোন ভাষায় সংখ্যা কীভাবে বলা হয়, তা বেশ বাস্তব প্রভাব ফেলে। যে ভাষায় সংখ্যা পদ্ধতি জটিল, সেখানে শিখতে বেশি সময় লাগে। হিসাব করতেও ভুল হয় বেশি।
ফরাসি ভাষার একটা উদাহরণ দেখুন। ফরাসিতে ৭০ থেকে ৯৯ বলার নিয়ম একটু অদ্ভুত। ওরা ৭০ বলতে গিয়ে ‘ছয় দশ যোগ দশ’ বলে। মানে ছয় দশে ষাট এবং যোগ দশ মিলে মোট ৭০। আশি বলতে বলে ‘চার বিশ’। আর ৯০ বলে ‘চার বিশ দশ’। বেশ গোলমেলে তাই না? এই অদ্ভুত ২০ ভিত্তিক সিস্টেমের কারণে ফরাসি শিশুদের অংক শিখতে অনেক কষ্ট হয়।
জার্মান ভাষাও কম অদ্ভুত না। ১০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যা বলার সময় এক আগে বলতে হয়, তারপর দশ। কিন্তু ১০০-এর পর আবার বড় সংখ্যা আগে বলতে হয়।
ইংরেজিতেও আছে সমস্যা। টুয়েলভ বলি, কিন্তু ‘টেন টু’ বলি না। ফলে দশমিক নিয়মটা লুকিয়ে থাকে। আবার বাংলায়ও আমরা ‘দশ এক’ বা ‘দশ দুই’ না বলে অদ্ভুত নাম দিয়েছি—এগারো ও বারো। এসব অনিয়ম শুধু ভাষায় সীমাবদ্ধ না, আরও গভীরে ছড়িয়ে আছে। কী সেই গভীরতা?
ফরাসিতে ৭০ থেকে ৯৯ বলার নিয়ম একটু অদ্ভুত। ওরা ৭০ বলতে গিয়ে ‘ছয় দশ যোগ দশ’ বলে। মানে ছয় দশে ষাট এবং যোগ দশ মিলে মোট ৭০।
শেখা আর চিন্তার ওপর প্রভাব
এই বেস বা ভিত্তি সংক্রান্ত জটিলতা পুরো পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে। আর এর প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে, যে ভাষায় ভিত্তি স্পষ্ট না, সেখানে শিশুরা সংখ্যা শিখতে বেশি সময় নেয়। ভিত্তি কঠিন হলে শিশুদের গণনা শিখতেও দেরি হয়।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, যে ভাষায় ভিত্তি স্পষ্ট, সেখানকার শিশুরা দ্রুত গণনা বুঝতে পারে। একটা পরীক্ষায় শিশুদের ১০ ইউনিটের ব্লক দিয়ে ৩২ বানাতে বলা হয়েছিল। যাদের গণিতের ভিত্তি সহজ, তারা চট করে ৩টা দশ আর ২টা একের ব্লক দিয়ে ৩২ বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু যাদের ভাষায় ‘চার-বিশ’-এর মতো প্যাঁচ আছে, তারা ৩২ বানাতে গিয়েও ৩টা দশের ব্লক না নিয়ে, ৩২টা একের ব্লক গুনতে শুরু করেছে! অর্থাৎ, তারা ১০ ভিত্তির ধারণাটাই ধরতে পারেনি।
সোজা কথা হলো, বেস কীভাবে প্রকাশ করা হয় তার বাস্তব জ্ঞানগত প্রভাব আছে। আমরা কত সহজে সংখ্যা পদ্ধতি শিখব, কোন ধরনের পদ্ধতি কোন প্রসঙ্গে ব্যবহার হবে, এর ওপর নির্ভর করে।
সাংস্কৃতিক স্তরে প্রভাব
সাংস্কৃতিক স্তরে ভিত্তি আমাদের সহযোগিতার ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন বিষয়ের বিজ্ঞানীরা যখন একসঙ্গে কাজ করেন, তখন এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৯৯৯ সালে মার্স ক্লাইমেট অরবিটার নামে একটা মহাকাশযান মঙ্গল গ্রহে বিধ্বস্ত হয়েছিল। কেন জানেন? এই ভিত্তির সমস্যার কারণে। কারণ, মহাকাশযানের একটা অংশ বানাচ্ছিল একদল বিজ্ঞানী, যারা হিসাব করছিলেন মিটারে। অর্থাৎ বেস ১০ ধরে। কিন্তু অন্য আরেকদল বিজ্ঞানী হিসাব করছিলেন ইঞ্চিতে, মানে ইম্পেরিয়াল সিস্টেমে! এই দুই ভিত্তির গণ্ডগোলের কারণে ৩২৭ মিলিয়ন ডলারের মহাকাশযানটা সেকেন্ডে ছাই হয়ে গেল!
এটাই বাস্তবতা। বেস বোঝা শুধু গণিতের ক্লাসের জন্য না, জীবনযাপনের জন্যও জরুরি।
১৯৯৯ সালে মার্স ক্লাইমেট অরবিটার নামে একটা মহাকাশযান মঙ্গল গ্রহে বিধ্বস্ত হয়েছিল। কেন জানেন? এই ভিত্তির সমস্যার কারণে।
সংখ্যাজ্ঞান কেন গুরুত্বপূর্ণ
সংখ্যাজ্ঞান মানে সংখ্যা বোঝা আর ব্যবহার করার ক্ষমতা। আধুনিক জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই সংখ্যাজ্ঞান। এটা আমাদের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেও সাহায্য করে।
ভেবে দেখুন, আপনি রিটায়ারমেন্টের প্ল্যান করছেন। কোন হিসেবে কত টাকা রাখতে হবে, তা যদি ঠিকভাবে হিসেব করতে না পারেন, তাহলে অল্পদিনেই ধরা খেতে হবে। আবার কোন ওষুধটা দিনে কতবার খেতে হবে, তা যদি হিসাব না রাখতে পারেন, তাতেও ক্ষতি। টাকা দিয়ে টাকা বাড়াতে চাইলে বুঝতে হবে বিনিয়োগে সম্ভাবনা। এসবের জন্যই লাগে সংখ্যাজ্ঞান।
কিন্তু অনেকে সংখ্যা শিখতে হিমশিম খায়। লাখো মানুষ গণিত নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। তাই মানুষকে আরও ভালোভাবে সংখ্যা শেখানোর পদ্ধতি তৈরি করতে পারলে মানুষের জীবন উন্নত হবে।
সংখ্যা পদ্ধতি শুধু একটা হাতিয়ার নয়। এটা আমাদের চিন্তাভাবনা, শেখার ক্ষমতা, এমনকি আমাদের সংস্কৃতিকেও দরকার। যত ভালোভাবে আমরা এই পদ্ধতি বুঝব, তত ভালোভাবে সংখ্যাকে কাজে লাগাতে পারব। আর তত সহজ হবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন।
