সবচেয়ে জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের কতটা কাছাকাছি আমরা পৌঁছাতে পেরেছি

মৌলিক সংখ্যা নিয়ে আছে ১০ লাখ ডলারের রহস্য

পদার্থবিজ্ঞানে যেমন পরমাণু আছে, তেমনি গণিতে আছে মৌলিক সংখ্যা। এই সংখ্যাগুলোই গণিতের মূল ভিত্তি। এদেরকে ১ এবং ওই সংখ্যা ছাড়া আর কোনো ছোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় না।

আমরা যখন স্কুলে প্রথম মৌলিক সংখ্যা শিখি, তখন মনে হয় এটা বুঝি গণিতের এক অদ্ভুত জিনিস। মাঝেমধ্যে ভাগ করতে গিয়ে একটু ঝামেলা পাকায়, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু সত্যিটা ঠিক উল্টো!

ব্রিটেনের ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির গণিতবিদ অ্যাডাম হার্পারের মতে, ‘গুণের জগতে মৌলিক সংখ্যাই সবচেয়ে মৌলিক, সবচেয়ে খাঁটি সংখ্যা।’ এ কথার মানে, পৃথিবীর সব ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যাকে ভেঙে শেষ পর্যন্ত শুধু মৌলিক সংখ্যার গুণফলই পাওয়া যায়। এককথায়, যেকোনো সংখ্যাকেই মৌলিক সংখ্যাগুলোর গুণফল হিসেবে লেখা যায়। যেমন ১২ একটি সংখ্যা। একে ২ × ২ × ৩ আকারে লেখা যায়। এখানে ২ ও ৩ মৌলিক সংখ্যা। 

হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই সংখ্যাগুলো নিয়ে গবেষণা করছে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এদের সম্পর্কে এখনো এমন সব সহজ প্রশ্ন আছে, যার উত্তর আমরা আজও জানি না!

আরও পড়ুন
ব্রিটেনের ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির গণিতবিদ অ্যাডাম হার্পারের মতে, ‘গুণের জগতে মৌলিক সংখ্যাই সবচেয়ে মৌলিক, সবচেয়ে খাঁটি সংখ্যা।’

প্রাচীন রহস্যের খোঁজে

মৌলিক সংখ্যার ধারণা এত সহজ যে, গণিতের শুরু থেকেই মানুষ এদের নিয়ে মেতে আছে। প্রায় বাইশ শ বছর আগে ইরাটোস্থেনিস নামে এক গ্রিক গণিতবিদ মৌলিক সংখ্যা বের করার একটা উপায় বের করেছিলেন। এটাকে বলা হয় ইরাটোস্থেনিসের চালুনি বা Sieve of Eratosthenes। ছোট ছোট মৌলিক সংখ্যা খুঁজে বের করতে আজও আমরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করি। 

কিন্তু এই চালুনি পদ্ধতি নিয়েও একটা বড় সমস্যা আছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ফিল্ডস মেডেলজয়ী জেমস মেনার্ডের মতে, ‘ইরাটোস্থেনিসের চালুনি বড্ড বেশি ভালো কাজ করে!’

মৌলিক সংখ্যা গণিতের মূল ভিত্তি, কিন্তু এদের নিজস্ব কোনো নিখুঁত কাঠামো বা প্যাটার্ন নেই।
প্রতীকী ছবি

মানে এই পদ্ধতি একদম ঠিক ঠিক বলে দেয়, কোনটা মৌলিক সংখ্যা আর কোনটা নয়। কিন্তু এটা কোনো প্যাটার্ন ব্যাখ্যা করে না। তাই এই চালুনিকে বোঝাটাও ঠিক মৌলিক সংখ্যার মতোই কঠিন।

আর এখানেই মৌলিক সংখ্যার আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। এরা গণিতের মূল ভিত্তি, কিন্তু এদের নিজস্ব কোনো নিখুঁত কাঠামো বা প্যাটার্ন নেই। অন্তত এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। গণিতের জগতে খামখেয়ালিভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৌলিক সংখ্যা।

আরও পড়ুন
প্রায় বাইশ শ বছর আগে ইরাটোস্থেনিস নামে এক গ্রিক গণিতবিদ মৌলিক সংখ্যা বের করার একটা উপায় বের করেছিলেন। এটাকে বলা হয় ইরাটোস্থেনিসের চালুনি বা Sieve of Eratosthenes।

যেসব সহজ প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি

মৌলিক সংখ্যা নিয়ে এমন অনেক সহজ প্রশ্ন আছে, যা হাজার বছর ধরে গণিতবিদদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। যেমন গোল্ডবাখ কনজেকচার এর মধ্যে অন্যতম। গোল্ডবাখের কনজেকচার শুনতে খুব সহজ। এর প্রস্তাবনা হলো—দুইয়ের চেয়ে বড় সব জোড় সংখ্যাকে দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল হিসেবে দেখানো যায়। যেমন, ১০ = ৭ + ৩ বা ৫০ = ৪৭ + ৩। কিন্তু বাস্তবে এই কনজেকচার কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। 

এরপর আছে টুইন প্রাইম কনজেকচার। ১১ ও ১৩ বা ২৯ ও ৩১ হলো টুইন প্রাইম কনজেকচার। মানে দুটি মৌলিক সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য ২। প্রশ্ন হলো, এমন অসীম সংখ্যক টুইন প্রাইম কি আছে? এ প্রশ্নের উত্তরও আজ পর্যন্ত মেলেনি।

লেজেন্ডার কনজেকচারও অমীমাংসিত। পরপর দুটি বর্গ সংখ্যার মধ্যে কি সবমসয় অন্তত একটি মৌলিক সংখ্যা থাকবেই? যেমন ৯ ও ১৬ দুটি পরপর বর্গ সংখ্যা। ৩ ও ৪-এর বর্গ করলে যথাক্রমে ৯ ও ১৬ পাওয়া যায়। এর মাঝে ১১ ও ১৩ দুটি মৌলিক সংখ্যা আছে। কিন্তু পরপর দুটি বর্গ সংখ্যার পর কি সবসময় এমন একটি মৌলিক সংখ্যা পাওয়া যাবেই? এ প্রশ্নের উত্তরও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন
গোল্ডবাখের কনজেকচার শুনতে খুব সহজ। এর প্রস্তাবনা হলো—দুইয়ের চেয়ে বড় সব জোড় সংখ্যাকে দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল হিসেবে দেখানো যায়। যেমন, ১০ = ৭ + ৩ বা ৫০ = ৪৭ + ৩।

সবচেয়ে বড় বাঁধা রিম্যান হাইপোথিসিস

তবে সব অমীমাংসিত সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রিম্যান হাইপোথিসিস নিয়ে। এই সমস্যাটা যেন গণিতবিদদের মোহিত করার জন্যই তৈরি হয়েছে! এর বর্ণনা খুব সহজ, কিন্তু বোঝা কঠিন। এই সমস্যা নিয়ে হলিউডে মুভিও বানানো হয়েছে। আর আপনি যদি এর সমাধান করে ফেলতে পারেন, তাহলে পাবেন ১০ লাখ  ডলার পুরস্কার!

কিন্তু কী এই রিম্যান হাইপোথিসিস? সহজ কথায়, মৌলিক সংখ্যার বিন্যাস নিয়ে এটি একটি প্রশ্ন। সহজে বোঝার চেষ্টা করি। ১০-এর নিচে কয়টি মৌলিক সংখ্যা আছে? ৪টি। ২, ৩, ৫ ও ৭। ১০০-এর নিচে এমন মৌলিক সংখ্যা আছে ২৫টি। এক হাজারের নিচে ১৬৮টি। আর ১০ হাজারের নিচে ১ হাজার ২২৯টি।

কোনো সংখ্যাকে ১ এবং ওই সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করা না গেলে তাকে মৌলিক সংখ্যা বলে
ফাইল ছবি

খেয়াল করলে দেখবেন, সংখ্যা যত বড় হচ্ছে, মৌলিক সংখ্যা তত দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা এই দূর্লভ হওয়ার হার দেখে একটা স্বাভাবিক অনুমান করার সূত্র তৈরি করেছেন। এই সূত্রটা আপনাকে মোটামুটি বলে দিতে পারে যে, একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার নিচে কয়টি মৌলিক সংখ্যা আছে। কিন্তু এই অনুমানটা মোটামুটি ঠিক, একদম নিখুঁত নয়। আসল উত্তরের সঙ্গে সবসময় একটুখানি ভুল বা ত্রুটি থেকেই যায়।

আরও পড়ুন
১০-এর নিচে কয়টি মৌলিক সংখ্যা আছে? ৪টি। ২, ৩, ৫ ও ৭। ১০০-এর নিচে এমন মৌলিক সংখ্যা আছে ২৫টি। এক হাজারের নিচে ১৬৮টি। আর ১০ হাজারের নিচে ১ হাজার ২২৯টি।

রিম্যান হাইপোথিসিস ঠিক এই ত্রুটি নিয়েই কাজ করে। এই হাইপোথিসিস বা অনুমানটি বলছে, এই ত্রুটিগুলো এলোমেলো নয়। এই ভুলগুলোও একটি অবিশ্বাস্য সুন্দর প্যাটার্ন মেনে চলে। কিন্তু আসলেই এটা প্যাটার্ন মেনে চলে কিনা, তার কেউ প্রমাণ করতে পারেনি।

হাজার হাজার বছরের গবেষণা শেষে আমরা কি এই সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান করতে পেরেছি? বেশিরভাগেরই উত্তর না। কিন্তু অগ্রগতি অবশ্যই হয়েছে।

যেমন ধরুন, টুইন প্রাইম কনজেকচার। ২০১৩ সালে ইতাং ঝাং নামে একজন গণিতবিদ প্রমাণ করেন, অসীমসংখ্যক টুইন প্রাইম জুটি আছে! তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য ঠিক ২ নয়, বড়জোর ৭ কোটি পর্যন্ত হতে পারে!

যদিও ৭ কোটি অনেক বড় ব্যবধান, কিন্তু গণিতবিদদের জন্য এটাই ছিল যুগান্তকারী। এরপর শুরু হয় এক পাগলাটে দৌড়। জেমস মেনার্ড, টেরেন্স টাও এবং বিশ্বের সেরা গণিতবিদেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন এই ব্যবধান কমাতে।

টেরেন্স টাও জানান, এমনো সময় গেছে যখন প্রতি ৩০ মিনিট পর পর এই ব্যবধান কমার নতুন রেকর্ড হচ্ছিল! কয়েক মাসের মধ্যে সেই ৭ কোটি থেকে ব্যবধান কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৮০ তে। মেনার্ড সেই ব্যবধান নামিয়ে আনেন ৬০০ তে। আর এখন, সবার সম্মিলিত চেষ্টায়, সেই ব্যবধান দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৪৬-এ! ২-এ হয়তো একদিন পৌঁছে যাবে মানবজাতি!

আরও পড়ুন
২০১৩ সালে ইতাং ঝাং নামে একজন গণিতবিদ প্রমাণ করেন, অসীমসংখ্যক টুইন প্রাইম জুটি আছে! তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য ঠিক ২ নয়, বড়জোর ৭ কোটি পর্যন্ত হতে পারে!

আরেকটা মজার জিনিস হচ্ছে, ১৯৭০-এর দশক থেকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মৌলিক সংখ্যার বিন্যাস অনেকটা কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের এলোমেলো ঘটনাগুলোর মতো। সম্প্রতি এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন আবিষ্কার হয়েছে। যদিও রিম্যান হাইপোথিসিস ১৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অমীমাংসিত। কিন্তু এটা কি কখনোই সমাধান হবে না?

অধ্যাপক মেনার্ড বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, রিম্যান হাইপোথিসিস অবশ্যই সত্য। এর পেছনে কোনো না কোনো জোরালো কারণ আছেই। শুধু সেই কারণটা বোঝার মতো গাণিতিক যন্ত্র বা হাতিয়ার আমরা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি।’

সবচেয়ে বড় পরিচিত মৌলিক সংখ্যাটিতে ২ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি সংখ্যা রয়েছে।
ছবি: গেটি ইমেজ

আসলে, রিম্যান হাইপোথিসিসের সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেয়ে এটা বনিয়ে গবেষণা করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর সমাধান খোঁজার এই যাত্রাপথেই গণিতবিদেরা নতুন নতুন সব আইডিয়া আবিষ্কার করছেন।

কে জানে, হয়তো কালই কোনো এক গণিতবিদ এর সমাধান করে ফেলবেন! যেমনটা হয়েছিল ফার্মার শেষ উপপাদ্য নিয়ে। সবাই ভেবেছিল এটা অসম্ভব। কিন্তু ১৯৯৩ সালে অ্যান্ড্রু ওয়াইলস হঠাৎ সেই সমস্যার সমাধান করেন!

অর্থাৎ, স্কুলে যে মৌলিক সংখ্যাকে আমরা ছোট একটা বিষয় ভেবেছিলাম, সেটা আসলে গণিতের সবচেয়ে গভীর রহস্যগুলোর একটা। আর এই রহস্য উন্মোচনের চেষ্টাই হয়তো গণিতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স ও সায়েন্টিফিক আমেরিকান

আরও পড়ুন