গুজব ছড়ানো কি মানুষের স্বভাব, নাকি মস্তিষ্কের বিশেষ দক্ষতা
আপনার চারপাশে কত মানুষ আছে, কখনো ভেবেছেন? পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী, পরিচিতজনসহ অনেক মানুষ। আর এই সব মানুষকে নিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি হয় একটা বিশাল জাল। কে কার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, কে কোন দলে, কে জনপ্রিয়, কে ক্ষমতাবান; এসব নিয়ে আমাদের মাথার মধ্যে তৈরি হয় এক অদৃশ্য মানচিত্র। যারা এই মানচিত্র ভালো বোঝেন, তারাই হয়ে ওঠেন সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী।
যারা গুজব ছড়ায়, তাদের নৈতিকতা নিয়ে সবসময় প্রশ্ন তোলা হয়। এটাই স্বাভাবিক। রূপকথা থেকে শুরু করে সবখানে বলা হয়েছে, চক্রান্তকারীদের থেকে দূরে থাকা ভালো। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, আমাদের এই ধারণাটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়। গুজব ছড়ানো মানুষের কোনো নৈতিক সমস্যা নয়, বরং এক ধরনের কগনিটিভ বা মস্তিষ্কের দক্ষতা। সহজ কথায়, তাদের মাথায় সমাজের একটা অদৃশ্য মানচিত্র আঁকা থাকে, যা আপনার বা আমার মাথায় নেই! চলুন, বিষয়গুলো আরও গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
অদৃশ্য মানচিত্রের খেলা
আমাদের মস্তিষ্ক একটা অদ্ভুত যন্ত্র। আমরা যখন কোনো নতুন জায়গায় যাই, তখন রাস্তাঘাট চেনার জন্য মাথায় যেমন একটা ম্যাপ তৈরি করি, ঠিক তেমনি মানুষের সঙ্গে মিশলেও আমাদের মস্তিষ্কে একটা সামাজিক ম্যাপ তৈরি হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় কগনিটিভ ম্যাপ।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই মানচিত্রগুলোই নির্ধারণ করে আমরা সামাজিকভাবে কতটা দক্ষ হবো। এই মানচিত্র ব্যবহার করে মানুষ প্রভাব বাড়ায়, নিজের ঘনিষ্ঠ মানুষদের মধ্যে শক্ত বন্ধন তৈরি করে।
তবে এই মানচিত্র তৈরি করা সহজ নয়। শুরুতেই বলেছিলাম, আপনার আশপাশে কত মানুষ থাকে, তা কি ভেবে দেখেছেন? এখনো না ভাবলে একটু সময় নিয়ে ভাবুন। দেখবেন আপনি কয়েকশ মানুষের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। আর এসব মানুষের মধ্যে আবার হাজার হাজার সম্ভাব্য সংযোগ থাকতে পারে। আপনার যেমন পাশের টেবিলের সহকর্মীর সঙ্গে জানাশোনা আছে, তেমনি পাশের সহকর্মী আবার অফিসের অন্য কারো সঙ্গে ভালো খাতির আছে। আসলে কে কার সঙ্গে যুক্ত, তা জানা অত্যন্ত কঠিন। তারপর আবার এই সম্পর্কগুলো প্রতিদিন পাল্টায়। নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়, পুরনো সম্পর্ক ভেঙে যায়। এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপনাকে মস্তিষ্কের ভেতরের মানচিত্রটাও আপডেট করতে হয়।
কে কার বন্ধু? কে কার শত্রু? কার সঙ্গে কার সম্পর্ক ভালো? কে আসলে দলের নেতা আর কে শুধু নেতার অনুসারী? অফিসে কে বসের সবচেয়ে কাছের মানুষ, কে সবচেয়ে গোবেচারা? এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর জানতে হয়। যারা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী, তাদের মস্তিষ্ক এই ম্যাপটা খুব নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারে। এটা আমার মনগড়া কথা নয়। সম্প্রতি এই বিষয়টা নিয়েই গবেষণা হয়েছে।
মানুষের সঙ্গে মিশলে আমাদের মস্তিষ্কে একটা সামাজিক ম্যাপ তৈরি হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় কগনিটিভ ম্যাপ।
কীভাবে হলো গবেষণা
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট অপূর্ব ভান্ডারি এবং তাঁর দল এই বিষয়টি বোঝার জন্য একটা দারুণ পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তাঁরা এই গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছেন কলেজের একদল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীকে। তারা কেবল কলেজে ভর্তি হয়েছে। কেউ কাউকে আগে থেকে চেনে না।
এক বছর ধরে গবেষকেরা এদের ওপর নজর রাখলেন। দেখলেন, কীভাবে বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে, কারা জনপ্রিয় হচ্ছে। ছাত্রদের ডেকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তুমি কি পার্টি করতে পছন্দ করো নাকি একা থাকতে ভালোবাসো?’ ক্লাসের কার সঙ্গে কার বন্ধুত্ব আছে, তাও শিক্ষার্থীদের থেকে নিয়মিত আপডেট নিয়ে জানতে থাকলেন গবেষকেরা।
ফলাফল যা এল, তা ছিল চমকে দেওয়ার মতো! আমরা সাধারণত ভাবি, যারা খুব মিশুক, হাসিখুশি আর বকবক করে, তারাই বুঝি সবার নেতা হয় বা প্রভাবশালী হয়। কিন্তু গবেষণা বলল ভিন্ন কথা। যারা সমাজে বা দলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, তারা সবচেয়ে মিশুক বা স্মার্ট ছিল না। তারা ছিল সেরা ম্যাপমেকার। অর্থাৎ, তারা খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিল, ক্লাসের ভেতরের অদৃশ্য সুতাটা কেমন। কে কার ভালো বন্ধু, কে ক্ষমতাবান, এই খবরটা যাদের কাছে নির্ভুলভাবে ছিল, তারাই শেষ পর্যন্ত রাজত্ব করেছে। আর যারা শুরুতে জনপ্রিয় হয়েও এই ম্যাপটা ঠিক রাখতে পারেনি, তাদের প্রভাব বেশিদিন টেকেনি।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, যারা সমাজে বা দলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, তারা সবচেয়ে মিশুক বা স্মার্ট ছিল না। তারা ছিল সেরা ম্যাপমেকার।
গুজবের গণিত
এবার আসি পরচর্চার কথায়। সমাজে পরচর্চাকে খারাপ চোখে দেখা হলেও তথ্য আদান-প্রদানের একটা শক্তিশালী মাধ্যম এটা। আমরা আমাদের কথাবার্তার ৬৫ শতাংশই ব্যয় করি অন্যের ব্যাপারে কথা বলে। কিন্তু সফলভাবে পরচর্চা করাও চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্যও অঙ্ক কষতে হয়!
আমরা অন্যের ব্যাপারে আলোচনা বা সমালোচনা করতে গিয়ে খুব কমই ধরা পড়ি। কারণ, আমরা যাকে সামনে পাই, তাকেই একটা কথা বলে ফেলি না। আমরা ঠিক জানি, কথাটা কাকে বলতে হবে। এটা কীভাবে সম্ভব হয়? কারণ, আমরা মস্তিষ্কের সেই অদৃশ্য মানচিত্রের সাহায্যে হিসাব করতে পারি, গুজব কোন পথে ছড়াবে। এই হিসাবটা জটিল। শুধু নিজের বন্ধুদের সংযোগ জানলেই হবে না, বন্ধুর বন্ধুদের সংযোগও জানতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মস্তিষ্ক গুজব করার সময় দুটি জিনিস হিসাব করে। এক, লোকটি কতটা জনপ্রিয়? দুই, যার নামে গুজব করছি, তার সঙ্গে এই মানুষটির সম্পর্ক কেমন। এই দুটি বিষয় মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারি, কোনো গোপন কথা কাকে বলা নিরাপদ। কথাটা বলার জন্য এমন কাউকে বেছে নিতে হয়, যে খবরটা ছড়াতে পারবে কিন্তু বিপদে ফেলবে না। আর এই পুরো হিসাবটা কষার জন্য ওই মস্তিষ্কের অদৃশ্য ম্যাপ থাকাটা জরুরি।
গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মস্তিষ্ক গুজব করার সময় দুটি জিনিস হিসাব করে। এক, লোকটি কতটা জনপ্রিয়? দুই, যার নামে গুজব করছি, তার সঙ্গে এই মানুষটির সম্পর্ক কেমন।
মস্তিষ্কে কীভাবে এই ম্যাপ তৈরি হয়
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, মস্তিষ্কের যে অংশটি ব্যবহার করে আমরা রাস্তাঘাট চিনি, ঠিক সেই অংশটিই ব্যবহার করে আমরা মানুষের সম্পর্কগুলো মনে রাখি। মস্তিষ্কের এই দুটি অংশের নাম হিপোক্যাম্পাস ও এন্টোরাইনাল কর্টেক্স। অর্থাৎ, মস্তিষ্কের কাছে অচেনা রাস্তা চেনা আর মানুষের সম্পর্ক চেনা প্রায় একই কাজ!
তবে আরও মজার ব্যাপার হলো, আমরা যখন বিশ্রাম নিই বা ঘুমাই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক এই ম্যাপটাকে আপডেট করে।
তাই আপনার চারপাশে যারা খুব সহজেই সবার সঙ্গে মিশে যায়, সব খবর রাখে এবং দ্রুত উন্নতি করে, তাদের শুধু চালাক বা সুবিধাবাদী ভাববেন না। তাদের মস্তিষ্কে হয়তো এমন এক শক্তিশালী জিপিএস আছে, যা তাদের সামাজিক ঝড়-ঝাপটা এড়িয়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এটা হয়তো তাদের দোষ নয়, মস্তিষ্কের এক দারুণ ক্ষমতা!
