একটা বিজ্ঞানের আবিষ্কার কতটা ঠিক বা ভুল, তা বোঝার জন্য অদ্ভুত এক গণিত আছে। ইংরেজ লেখক টেরি প্র্যাচেট বলতেন, ‘মিলিয়নে একবার যা ঘটে, তা দশ বারের মধ্যে ন'বার ঘটে!’ মানে যে ঘটনাটা ১০ লাখের মধ্যে একবার ঘটবে, তা ১০ বারের মধ্যেও ৯ বার ঘটবে। কথাটা শুনে মনে হতে পারে অদ্ভুত, গাঁজাখুরি। কিন্তু তাঁর গল্পের জগতে, মানে ডিস্কওয়ার্ল্ডে কল্পনার নিয়ম চলে বাস্তবের চেয়ে বেশি। কারণ, গল্পে নায়করা সবসময় অসম্ভব কিছু করে জিতে যায়!
যাই হোক, কয়েক সপ্তাহ আগে একটা খবর মিডিয়া জগতে বেশ সাড়া ফেলেছিল। সৌরজগতের বাইরে একটা গ্রহে নাকি জীবনের সম্ভাবনা ৯৯.৭ শতাংশ! সে গ্রহের নাম কে২-১৮বি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী নিক্কু মধুসূদন ও তাঁর দল বলছেন, ওই গ্রহে তাঁরা এমন এক ধরনের গ্যাস খুঁজে পেয়েছেন, যা শুধু পৃথিবীতে জীবই তৈরি করে। সে গ্যাসের নাম ডাইমিথাইল সালফাইড। তাই তাঁদের দাবি, পৃথিবীর বাইরে জীবনের প্রমাণ পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এটি। তবে ডাইমিথাইল সালফাইড মানেই যে সেখানে প্রাণ আছে, তা নিশ্চিত বলা যায় না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: ডাইমিথাইল সালফাইড কি সত্যিই এলিয়েনের চিহ্ন।
শুনতে বেশ ভালো লাগলেও বাস্তবে এই সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছিও হতে পারে। মিলিয়ন-টু-ওয়ান চান্সের মতোই ৯৯.৭ শতাংশ চান্সও মাঝেমধ্যে দেখা যায়। তবে এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। সেটা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
ধরুণ, আপনাকে একটা কয়েন দিয়ে টস করতে বললাম। সাধারণভাবে হেড পড়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ, টেল পড়ার সম্ভাবনাও ৫০ শতাংশ। কিন্তু আমি যদি কয়েনটাকে এমনভাবে কারসাজি করি যাতে হেড পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি হয়? আপনি কি আমাকে ধরতে পারবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা হাইপোথিসিস টেস্টিং নামে একটা পদ্ধতির সাহায্য নেন। এই টেস্টিংয়ের মানে হলো, তাঁরা আগে একটা ‘ধারণা’ ঠিক করেন। সেই ধারণাকে বলে ‘নাল হাইপোথিসিস’। এই হাইপোথিসিস মানে কিছু বদলাবে না, সব স্বাভাবিক থাকবে। আর এর বিপরীতে ঠিক করেন একটা ‘বিকল্প হাইপোথিসিস’। এই হাইপোথিসিস অনুসারে কিছু একটা বদলে যাবে। যেমন একটু আগে কয়েন কারসাজির কথা বললাম।
এরপর আমাদের কাজ হলো, কয়েনটা কয়েকবার টস করে হেড ও টেলের সংখ্যা লিখে রাখা। যথেষ্ট সংখ্যকবার টস করলে একটা নিরপেক্ষ মুদ্রার হেড ও টেল পড়ার সংখ্যা প্রায় সমান হওয়া উচিত। কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যকবার মানে আসলে কতবার? যেমন, আপনি যদি পরপর তিনবার হেড পান, তাহলে ভাবতে পারেন আমি মুদ্রাটা পরিবর্তন করেছি। কিন্তু নিরপেক্ষ মুদ্রার ক্ষেত্রে এমন হওয়ার সম্ভাবনা (১/২)৩ বার। মানে ৮ বারের মধ্যে ১ বার। অর্থাৎ তিন বার হেড পড়ার সম্ভাবনা ৮ বারে ১ বার, দুবার হেড পড়ার সম্ভাবনা ৮ বারে ৩ বার, আর শুধু টেল পড়ার সম্ভাবনা ৮ বারে ১ বার।
এবার আপনি যদি চার বার কয়েন টস করেন এবং প্রত্যেকবার হেড পড়ে, তাহলে ভাবতেই পারেন, আমি কয়েনে কারসাজি করেছি। অথচ গাণিতিকভাবে চার বার হেড পড়ার সম্ভাবনা মাত্র মাত্র (১/২)৪ বা ৬.২৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে আপনি কি কয়েনটাকে নিরপেক্ষ বলবেন, নাকি বলবেন কারসাজি?
গবেষণায় সাধারণত ৫ শতাংশের নিচে সম্ভাবনা থাকলে সেটাকে স্টাটিস্টিক্যালি সিগনিফিসিয়ান্ট ধরা হয়। মানে পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মানে এটা কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনা এত কম যে আমরা ধরতে পারি, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটেছে। এখন আপনি যদি কয়েনটা পাঁচবার টস করে প্রতিবার হেড পান, তাহলে সম্ভাবনা হয় ৩.১২৫ শতাংশ, যা ৫ শতাংশের চেয়ে কম। এরকম হলে বলা যায়, এই আবিষ্কারকে সন্দেহ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণ নেই।
খেয়াল করলে দেখবেন, শুধু একবার টসের ফলাফল বদলে ফেললে অনের পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, তিনবার টস করলে সম্ভাবনা ৮-এর ওপরে থাকে। আবার চার বার টস করলে ৫-এর নিচে নেমে যায়। তাই অনেকে তথ্য সাজিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে সম্ভাবনা ৫ শতাংশের নিচে চলে আসে। এই পদ্ধতিকে বলে পি-হ্যাকিং। এটা অনেক সময় গবেষণাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে।
তবে বিজ্ঞানীরা শুধু পি-ভ্যালু দিয়েই সম্ভাবনা যাচাই করেন না। পদার্থবিদেরা আরও একধাপ এগিয়ে ‘সিগমা’ ব্যবহার করেন। সিগমা হলো একটা মাপকাঠি। কোনো আবিষ্কার কতটা নিশ্চিত হওয়া, তা সিগমা ব্যবহার করে পরিমাপ করা হয়। সাধারণভাবে কোনো বিষয়ে ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত হওয়া মানে ২ সিগমা। আর ১ সিগমা মানে ৬৮ শতাংশ নিশ্চিত। ওপরে আমরা যে ৯৫ শতাংশ সম্ভাবনার কথা বলছি, তা ২ সিগমা ধরা হয়। কিন্তু পদার্থবিদেরা কোনো আবিষ্কারের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইলে লাগবে ৫ সিগমা। মানে ৯৯.৯৯৯৯৪ শতাংশ নিশ্চিত হওয়া চাই। হিগস বোসন কণার আবিষ্কার ঘোষণার সময় বিজ্ঞানীরা ৫ সিগমা পর্যন্ত পৌঁছে তবেই ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এবার কে২-১৮বি গ্রহের কথায় ফিরে আসি। ৯৯.৭ শতাংশ নিশ্চিত হওয়া মানে ৩ সিগমা। অর্থাৎ, এই ডাটা নেহাত কাকতালীয় নয়। কিন্তু বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। ওই গ্যাস পাওয়া গেছে বলে বিজ্ঞানীরা যে নির্দিষ্ট মডেল বানিয়েছেন, সেখানে বলা হয়েছে গ্রহটার বায়ুমণ্ডলে ডাইমিথাইল সালফাইড আছে। কিন্তু অন্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেই একই ডাটা দিয়ে যদি অন্য মডেল ব্যবহার করা হয়, তাহলে কিছুই পাওয়া যায় না। সুতরাং, শুধু একটা মডেলের ওপর ভিত্তি করে ভিনগ্রহের প্রাণ আছে বলাটা ঠিক যুক্তিসঙ্গত নয়।
সুতরাং, ৯৯.৭ শতাংশ নিশ্চিত মানে এটা কোনো অলৌকিক ভবিষ্যদ্বাণী নয়। এটা একটা হিসাব, অনেকগুলো অনুমান, মডেল আর বিশ্লেষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা গল্প। গল্প যেমন বাস্তবতা বদলায় না, এই সংখ্যাও তেমনই।
