সম্প্রতি কে২-১৮বি নামে একটি বহিঃসৌরগ্রহ খুঁজে পেয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একদল গবেষক এই গ্রহটির সন্ধান পেয়েছে। এই গ্রহের বাতাসে একধরনের রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পদার্থের নাম ডাইমিথাইল সালফাইড। গবেষকরা বলছেন, এটা হতে পারে ভিনগ্রহের প্রাণের ইশারা। কিন্তু ডাইমিথাইল সালফাইড আসলে কী? এটা কি সত্যিই জীবনের প্রমাণ?
ডাইমিথাইল সালফাইড কী
ডাইমিথাইল সালফাইড হলো একধরনের ছোট রাসায়নিক অণু। এর মধ্যে একটি সালফার পরমাণু দুটি মিথাইল গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকে। প্রতিটি মিথাইল গ্রুপে থাকে একটি কার্বন এবং তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণু। তবে এর গন্ধ বেশ শক্তিশালী, পচা ডিম বা কাঁচা রসুনের মতো তীব্র দুর্গন্ধ!
কে২-১৮বি গ্রহ সম্পর্কে আমরা এখনো খুব কম জানি। এই গ্রহের বাতাসে পৃথিবীর মতো নাইট্রোজেন নেই, বরং কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভরা। তাই এখানে ডাইমিথাইল সালফাইড ভেঙে যাওয়া মানেই যে প্রাণের সন্ধান, তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
পৃথিবীতেও এই ডাইমিথাইল সালফাইড রয়েছে। সাগরের ছোট ছোট প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন থেকে এই রাসায়নিক তৈরি হয়। তারপর তা মিশে যায় বাতাসের সঙ্গে। পৃথিবীর বাতাসে প্রতি এক বিলিয়ন অণুর মধ্যে মাত্র একটি ডাইমিথাইল সালফাইডের অণু থাকে। কিন্তু বাতাসের সংস্পর্শে সূর্যের আলো এবং অন্যান্য রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙে যায়। সর্বোচ্চ এক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এই ভেঙে যাওয়া প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় অ্যারোসল নামে ক্ষুদ্র কণিকা। এই কণাগুলো মেঘ তৈরিতে সাহায্য করে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন বা আবহাওয়া মডেল বোঝার জন্য ডাইমিথাইল সালফাইড গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবী থেকে কে২-১৮বি গ্রহে
পৃথিবীতে এই ডাইমিথাইল সালফাইড একমাত্র জীবিত প্রাণীর মাধ্যমেই তৈরি হয় এবং দ্রুত ভেঙে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলেন, যদি কোনো দূর গ্রহের বাতাসে এটা পাওয়া যায়, তাহলে তা জীবনের ইঙ্গিত হতে পারে। সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বার্নের রসায়নবিদ নোরা হ্যানি বলছেন, ‘পৃথিবীতে এই রাসায়নিক জীবনের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।’
নাসার শক্তিশালী টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এই গ্রহটি খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৫ সালে আবিষ্কৃত এই গ্রহটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে। গ্রহটির আকার পৃথিবী ও নেপচুন গ্রহের মাঝামাঝি ধরনের। বিজ্ঞানীরা আগে এমন আকারের গ্রহ দেখেননি।
২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ নিক্কু মধুসূদন জানান, ‘তাঁরা গ্রহটির বাতাসে ডাইমিথাইল সালফাইডের মতো কিছু একটা পেয়েছেন।’ তখনো অন্য বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে পারেননি। কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে মধুসূদন ও তাঁর দল দ্বিতীয়বার আরেকটি যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে আরও নিশ্চিত হন, ওই গ্রহটিতে ডাইমিথাইল সালফাইড বা এর কাছাকাছি কোনো জীবনের সম্ভাব্য চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন। তা ডাইমিথাইল ডিসালফাইডও হতে পারে।
পৃথিবীতেও এই ডাইমিথাইল সালফাইড রয়েছে। সাগরের ছোট ছোট প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন থেকে এই রাসায়নিক তৈরি হয়। তারপর তা মিশে যায় বাতাসের সঙ্গে। পৃথিবীর বাতাসে প্রতি এক বিলিয়ন অণুর মধ্যে মাত্র একটি ডাইমিথাইল সালফাইডের অণু থাকে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই গ্রহে এর পরিমাণ পৃথিবীর তুলনায় হাজার গুণ বেশি! মধুসূদন এ ব্যাপারে বললেন, ‘এত বেশি পরিমাণ ডাইমিথাইল সালফাইডের ব্যাখ্যা দিতে হলে ধরে নিতে হয়, গ্রহটি উষ্ণ মহাসাগর দিয়ে ঢাকা। আর তাতে আছে প্রচুর জীবন।’
তাহলে কি সত্যিই ভীনগ্রহে প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেল
সব বিজ্ঞানী এই কথার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এলেনর ব্রাউন ও নোরা হ্যানির সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ডাইমিথাইল সালফাইড জীবন ছাড়া অন্যভাবেও তৈরি হতে পারে। ব্রাউন তাঁর দল নিয়ে পৃথিবীর আদিম পরিবেশের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে কোনো জীবের উপস্থিতি ছাড়াই ডাইমিথাইল সালফাইড উৎপন্ন করতে পেরেছিলেন। একইভাবে হ্যানি তাঁর গবেষণায় দেখান, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির রোসেটা মিশনের মাধ্যমে ধরা পড়া ৬৭পি ধূমকেতুতে ডাইমিথাইল সালফাইড পাওয়া গেছে। কিন্তু সেখানেও কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই।
এই বিজ্ঞানীদের মতে, কে২-১৮বি গ্রহ সম্পর্কে আমরা এখনো খুব কম জানি। এই গ্রহের বাতাসে পৃথিবীর মতো নাইট্রোজেন নেই, বরং কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভরা। তাই এখানে ডাইমিথাইল সালফাইড ভেঙে যাওয়া মানেই যে প্রাণের সন্ধান, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। এ সম্পর্কে ব্রাউন বলেন, ‘এই গ্রহের পরিবেশ এত বিচিত্র যে প্রাণ ছাড়াই রাসায়নিকভাবে ডাইমিথাইল সালফাইড তৈরি হতে পারে।’
ডাইমিথাইল সালফাইড হলো একধরনের ছোট রাসায়নিক অণু। এর মধ্যে একটি সালফার পরমাণু দুটি মিথাইল গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকে। প্রতিটি মিথাইল গ্রুপে থাকে একটি কার্বন এবং তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণু।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস লিনটট বলেন, ‘ডাইমিথাইল সালফাইড যদি সত্যিকারে জীবন তৈরি করে, তাহলে তা ভেঙে যাওয়ার সময় হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো আরও কিছু মৌলিক পদার্থও বাতাসে থাকার কথা। কিন্তু দূরের ওই গ্রহে এমন কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি।’
ফলে ডাইমিথাইল সালফাইডের সন্ধান অবশ্যই দারুণ খবর। কিন্তু এর ওপর ভিত্তি করে এটা বলা সম্ভব নয় যে, সেখানে সত্যিই প্রাণ আছে। এটা নিশ্চিত হতে আরও গভীর গবেষণা আর পর্যবেক্ষণ দরকার। আসলেই কে২-১৮বি গ্রহে প্রাণ আছে কিনা, তা জানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।