দ্য ম্যান হু কাউন্টেড ২

চিন্তার জন্যে খাবার

এক ধনী শেখের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটল। আট টুকরো রুটি সম্পর্কে সে যে প্রস্তাব দিল। আমাদের পাওয়া আটটি মুদ্রার বণ্টন যে সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলো। বেরেমিজের তিন ধরনের ভাগ পদ্ধতি: সরল, প্রকৃত ও নিখুঁত বিভাজন। গণনাকারীর প্রতি মহান উজিরের প্রশংসা।

আগের পর্ব: দ্য ম্যান হু কাউন্টেড ১

তিন দিন পরের কথা। আমরা সিপ্পুর নামে ছোট একটি ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাছাকাছি হলাম। দেখলাম, হাত-পা মাটিয়ে ছড়িয়ে একজন মুসাফির বসা। জামা-কাপড় ছেঁড়া-ফাটা। গায়ে ভাল আঘাতও আছে। অবস্থা খুব নাজুক। হতভাগ্য মানুষটার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলাম আমরা। তিনি পরে আমাদেরকে তার দূর্ভাগ্যের গল্প শোনালেন।

তার নাম সালিম নাসির। বাগদাদের অন্যতম বিত্তশালী বণিক। কয়েক দিন আগে বসরা থেকে আল-হিল্লাহ যাওয়ার পথে ইরানি মরু ডাকাত তার কাফেলায় হামলা চালায় ও লুট করে। প্রায় সবাই তাদের হাতে মারা পড়েছে। তিনি ছিলেন কাফেলার নেতা। বালুর মধ্যে অন্য লাশের ভিড়ে লুকিয়ে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।

দুঃখের কাহিনি শেষ করে কাঁপাকাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনাদের কাছে কি খাবার কিছু হবে? আমি খিদেয় মরে যাচ্ছি।'

'আমার কাছে তিনটে টুকরো রুটি আছে।' উত্তর দিলাম।

'আমার কাছে আছে পাঁচটা।' বলেন গণনাকারী।

'খুব ভাল,' বললেন শেখ। 'আমাকে একটু দেওয়া যাবে কি? আমি এর প্রতিদান দেব। বাগদাদে পৌঁছলে আমি রুটির বদলে আট টুকরো স্বর্ণ দেব।'

আমরা তাই করলাম।

পরের দিন পড়ন্ত বিকেলে আমরা প্রাচ্যের মুক্তো, বিখ্যাত বাগদাদ শহরে প্রবেশ করলাম। কর্মব্যস্ত চত্বর পার হতেই সুন্দর পোশাকের একদল মানুষ আমাদের সামনে পড়ল। অভিজাত পিঙ্গল বর্ণের এক ঘোড়ায় চেপে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অন্যতম ক্ষমতাশালী উজির ইব্রাহিম মালুফ। আমাদের সঙ্গে শেখ সালিম নাসিরকে দেখে তিনি বহর থামালেন। শেখকে বললেন, 'কী হয়েছে তোমার, বন্ধু? কেন তুমি ছিন্ন পোশাকে দুই আগন্তুকের সাথে বাগদাদে এসেছ?'

হতভাগা শেখ ভ্রমণের আদ্যোপান্ত বললেন। আমাদের প্রশংসা করলেন পঞ্চমুখে।

'এখনই এদের দাম দিয়ে দাও,' উজির নির্দেশ দিলেন। পকেট থেকে আটটি স্বর্ণমুদ্রা বের করে সালিম নাসিরকে দিলেন। তাকে বললেন, 'আমি এক্ষুণি তোমাকে দরবারে নিয়ে যাব। বিশ্বাসীদের রক্ষক নতুন এই মরু ডাকাতদের কথা অবশ্যই জানতে চাইবেন, যারা খলিফার এলাকার ভেতরেই আমাদের বন্ধুদের আক্রমণ করে মালামাল লুটে নেয়।'

এরপর সালিম নাসির বললেন, 'বন্ধুগণ, তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি তাহলে। সাহায্যের জন্যে আবারও ধন্যবাদ। আর হ্যাঁ, প্রতিশ্রুতি অনুসারে তোমাদের মূল্য দিতে চাই।'

গণনাকারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এই নাও তোমার পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা, পাঁচ টুকরো রুটির জন্য।'

'আর হে বাগদাদের বন্ধু, এই নাও তোমার তিনটি স্বর্ণমুদ্রা।' বললেন আমাকে।

আমাকে অবাক করে দিয়ে গণনাকারী সশ্রদ্ধ আপত্তি জানালেন। 'মাফ করবেন, শেখ, এই বণ্টনকে দেখে সরল মনে হলেও গাণিতিকভাবে ভুল। আমি পাঁচ টুকরো রুটি দিয়েছে হিসেবে সাতটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া উচিত। আমার বন্ধু, যে তিনটি টুকরো দিয়েছে, তার পাওয়া উচিত একটি স্বর্ণমুদ্রা।'

'বলো কী!' উজির আকাশ থেকে পড়লেন। কৌতূহলভরে প্রশ্ন করলেন, 'এমন অদ্ভুত ভাগের পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে?'

গণনাকারী মন্ত্রীর কাছাকাছি হলেন। বললেন:

'জি, আমি দেখাচ্ছি। আমার কথা গাণিতিকভাবে সঠিক। সফরের সময় আমাদের ক্ষুদা লাগলে আমি এক টুকরো রুটি নিলাম। একে তিন ভাগ করে সবাই এক ভাগ করে খেলাম। এভাবে আমার পাঁচটি টুকরো পনের খণ্ড হলো, ঠিক? আমার বন্ধুর তিন টুকরো হলো নয় খণ্ড। মোট খণ্ড হলো চব্বিশটি। আমার পনের খণ্ড থেকে আমি খেয়েছি আট খণ্ড। ফলে আমি আসলে দান করেছি সাত খণ্ড। আমার বন্ধুও খেয়েছে আট খণ্ড। আর দান করেছে নয় খণ্ড। ফলে সে আসলে দান করেছে এক খণ্ড। আমার দান করা সাত খণ্ড আর আমার বন্ধুর এক খণ্ড নিয়ে মোট আট খন্ড খেলেন শেখ। অতএব ন্যায়সঙ্গত বণ্টন এটাই যে আমি পাব সাতটি মুদ্রা আর আমার বন্ধু পাবে একটি মুদ্রা।'

উজির গণনাকারীর ভীষণ প্রশংসা করলেন। তাঁর হিসাব অনুসারেই মুদ্রাগুলো ভাগ করে দিতে আদেশ দিলেন। গণিতবিদের যুক্তি সঠিক, নিখুঁত ও অকাট্য।

তবে এই বণ্টন যতই ন্যায়ানুগ হোক, বেরেমিজের নিজের তা পছন্দ হয়নি। উজিরের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, 'এই ভাগ, যেখানে আমি সাতটি মুদ্রা পাচ্ছি আর আমার বন্ধু একটি পাচ্ছে, এটা গাণিতিকভাবে সঠিক হলেও আল্লাহর কাছে এটি সুন্দর নয়।'

মুদ্রাগুলো একত্র করে তিনি সমান দুই ভাগ করলেন। এক ভাগ নিজে রেখে আরেক ভাগ আমাকে দিয়ে দিলেন।

'ইনি এক অসাধারণ মানুষ।' বললেন উজির। তিনি আট কয়েনের বণ্টন মেনে নেননি। প্রমাণ করলেন তিনি পাবেন সাতটি আর তার বন্ধু পাবেন একটি। পরে কী করলেন? সমান দুই ভাগ করেও বন্ধুকেও সমান অংশ দিলেন।'

'এই যুবকটি শুধু জ্ঞানী আর দক্ষ গণিতবিদই নয়, একজন উদারচিত্তের বন্ধুও বটে। আজ থেকেই তাঁকে আমার সচিব নিয়োগ করলাম।'

'সম্মানিত উজির,' বললেন গণনাকারী, 'দেখলাম, আপনি ৫৬ অক্ষরে আমার শোনা সবচেয়ে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল ও হেফাজত করুন।'

আমার বন্ধুর দক্ষতার কারিশমা শব্দ ও অক্ষর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এমন ঈর্ষণীয় মেধায় আমরা সবাই চমকপ্রদ হলাম।

লেখক পরিচিতি:

মালবা তাহান ব্রাজিলীয় গণিত লেখক হুলিও সিজার দা মেইয়ো এ সৌজার (১৮৯৫-১৯৭৪) ছদ্মনাম। গণিতের রহস্য ও আনন্দ মানুষের কাছে প্রকাশের জন্যে লেখক নামটি বেছে নিয়েছেন। মালবা তাহান ছদ্মনামে একশোর বেশি বই লিখেছেন। ছদ্মনাম সবাই জেনে ফেলার পরেও এই নামেই লিখেছেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লেখালেখি করে গেছেন তিনি।

অসাধারণ বইগুলোর জন্য তিনি ব্রাজিলিয়ান লিটারেরি একাডেমীর মর্যাদাজনক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৪ সালে তাঁর ছদ্মনাম দিয়ে তৈরি করা হয় দ্য মালবা তাহান ইনস্টিটিউট। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে রিও ডি জেনোরিও সংসদ ঠিক করে তাঁর মৃত্যুদিন ৬ মে দেশে গণিত দিবস হিসেবে পালিত হবে। দ্য ম্যান হু কাউন্টেড তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই। ২০০১ সালেই বইটির ৫৪তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়।