আনাতলি দনেপ্রভের ‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পটি অসাধারণ এক সৃষ্টি। গল্পটি ‘গ্রহান্তরের আগন্তুক’ নামে একটি সংকলনের অন্তর্ভুক্ত। এই সংকলন সোভিয়েত লেখকদের লেখা বিজ্ঞান কল্পগল্পের চমৎকার উদাহরণ।
এগুলোর মধ্যে ‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পটির অভিনবত্ব ও গভীরতা মুগ্ধ করে। এটি কেবল একটি গতানুগতিক গল্প নয়, এর মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক এমন সব বর্ণনা রয়েছে, যা পড়তে গিয়ে মনে হয় যেন কোনো বিজ্ঞানী নিজের গবেষণাপত্র লিখছেন। বিশেষ করে মানব মস্তিষ্কের নিউরন এবং সেগুলোর কার্যকারিতা যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তা সত্যি অসাধারণ।
এই গল্প পড়ে মনে হয়, মানুষের স্বাভাবিকভাবে তৈরি মস্তিষ্ক যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত মস্তিষ্কের চেয়ে এখনো অনেক এগিয়ে। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও নিজেদের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এটা একদম প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য বলব না, বরং বলা যায় লেখকের, অর্থাৎ আমার একটা ধারণা। এর একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যায়। ধরুন, কেউ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কোনো মরুভূমিতে রয়েছেন। তিনি যদি গভীরভাবে কল্পনা করেন যে কোনো বরফের দেশে আছে, তাহল তাঁর শরীরে ঠান্ডার অনুভূতি হতে পারে। প্লাসিবো ইফেক্টের সঙ্গে এর সম্পর্ক হয়তো কেউ কেউ খুঁজে পাবেন। এই ক্ষমতা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে সম্ভবত দেখা যায় না।
গল্প পড়তে গিয়েই আমি প্রথম নিউরোসাইকোলজি বা মনোস্নায়ুবিজ্ঞান এবং কাইবারনেটিক্সবিদ্যা বা নিয়ন্ত্রণবিষয়ক বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারি। যদিও এই শব্দগুলোর অর্থ পুরো স্পষ্ট নয়, তবু আমার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়।
‘গ্রহান্তরের আগন্তুক’ গল্প সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) প্রগতি প্রকাশন থেকে। এই বইয়ে মোট পাঁচটি মনোমুগ্ধকর গল্প আছে। অ.কাজানৎসেভের ‘গ্রহান্তরের আগন্তুক’, আলেক্সান্দার বেলায়েভের ‘হৈটি টৈটি’, আনাতলী দনেপ্রভের ‘আইভা’, ভ. সাভচেঙ্কোর ‘প্রফেসর বার্নের নিদ্রাভঙ্গ’ এবং আনাতলী দনেপ্রভের ‘ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ’। পুরো সংকলনটি ভাষান্তর করেছেন ননী ভৌমিক। তাঁর অনুবাদের বিশেষত্ব হলো, ভাষা এত সহজ ও সাবলীল যে খুব সহজেই গল্পের মূল ভাব এবং জটিল ধারণাগুলো বোঝা যায়। আমি বুঝতে পেরেছি। এই সংকলনের ‘হৈটি টৈটি’ গল্পটিও খুব ভালো লেগেছে। তবে ‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ নিয়ে লিখতে আমি বিশেষভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। কারণ, গল্পটির বিষয়বস্তু আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে।
আমার মনে হয়, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র জীব, যারা নিজেদের কষ্টকর অনুভূতিগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে আরামদায়ক অনুভূতিগুলো গ্রহণ করতে চায়। যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত মস্তিষ্ক হয়তো কোনো নির্দিষ্ট কাজ করার ক্ষেত্রে মানব মস্তিষ্ককে আরও বেশি দক্ষ করে তুলতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক মস্তিষ্কের যে অসীম কল্পনা শক্তি এবং জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে, তা যন্ত্রের মধ্যে আনা সম্ভব নয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মনে করুন, আমি গণিতে খুব দক্ষ এবং দ্রুত যেকোনো জটিল অঙ্ক সমাধান করতে পারি। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি নির্দিষ্ট অঙ্ককে আমি কত ভিন্নভাবে দেখতে পারি, কত ভিন্ন উপায়ে সেই অঙ্ক সমাধান করতে পারি অথবা সেই অঙ্ক নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার বৈচিত্র্য কতখানি। এই বিশেষ ক্ষমতাগুলোর মাধ্যমেই মানুষের মস্তিষ্কে সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটে। মানুষ নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ক্রমাগত নতুন নতুন আবিষ্কার করে চলেছে। এভাবেই মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেদের নতুন নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচিত করে।
এই গল্প পড়তে গিয়েই আমি প্রথম নিউরোসাইকোলজি বা মনোস্নায়ুবিজ্ঞান এবং কাইবারনেটিক্সবিদ্যা বা নিয়ন্ত্রণবিষয়ক বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারি। যদিও এই শব্দগুলোর অর্থ পুরো স্পষ্ট নয়, তবু আমার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়। ইচ্ছে হয় এই নতুন জ্ঞান সম্পর্কে আরও জানতে। গল্পটিতে জীবনের একটি সুন্দর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে—জীবন হলো আমাদের স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে কোড আকারে প্রবাহিত সংবাদের গতি। এর কমও নয়, বেশিও নয়। আর চিন্তা হলো স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রস্থলে এবং সিন্যাপসগুলোতে নিয়ন্ত্রিত ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান। এই সংজ্ঞা জীবনের জৈবিক এবং তথ্যগত দিকটিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলে।
‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পটি তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। এই গল্পে তিনি নিউরোসাইবারনেটিক্স এবং মানব মস্তিষ্কের ক্ষমতা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন।
আনাতলি দনেপ্রভের ‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পে এক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী প্রাথমিকভাবে নিউরোসাইবারনেটিস্টদের দক্ষতার কাছে পরাজিত হন। গল্পের শুরুতে মনে হয় যন্ত্রমানব যেন মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পরে সেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীর গভীর জ্ঞান, যেকোনো বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা এবং অসীম কল্পনাশক্তির কাছে নিউরোসাইবারনেটিস্টরা হার মানে। ‘নিউরোকাইবারনেটিক্স’ হলো এমন এক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানব মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে এবং স্নায়বিক নিয়মাবলী ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অন্যভাবে বললে, নিউরোলজি এবং কাইবারনেটিক্সের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিষয় হলো নিউরোসাইবারনেটিক্স। বলে রাখি, কাইবারনেটিক্স কথাটি আসলে সাইবারনেটিক্স শব্দটিরই জার্মান প্রতিশব্দ।
আমরা জানি, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিজ্ঞানের একটি মৌলিক শাখা। আর নিউরোসাইবারনেটিক্স একটি অসাধারণ এবং বিশেষায়িত বিষয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, গণিতভিত্তিক মডেল এবং বিমূর্ত ধারণার সাহায্যে ভৌত বস্তু এবং যৌক্তিক নিয়মাবলী ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং ভবিষ্যৎবাণী করতে সাহায্য করে। এর বিপরীতে, পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের কাজ হলো তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রস্তাবনাগুলোকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরীক্ষা করে তাদের যথার্থতা প্রমাণ করা এবং কোনো ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে কোথায় ত্রুটি রয়েছে, তা পরীক্ষামূলক সরঞ্জামের মাধ্যমে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা।
আনাতলি দনেপ্রভের ‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পে এক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী প্রাথমিকভাবে নিউরোসাইবারনেটিস্টদের দক্ষতার কাছে পরাজিত হন। গল্পের শুরুতে মনে হয় যন্ত্রমানব যেন মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।
আনাতলি দনেপ্রভ ছিলেন বিখ্যাত সোভিয়েত কল্পবিজ্ঞান লেখক। তিনি লেখার মধ্যে প্রায়ই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মানব সমাজের ভবিষ্যতের চিত্র ফুটিয়ে তুলতেন। ‘ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ’ গল্পটি তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। এই গল্পে তিনি নিউরোসাইবারনেটিক্স এবং মানব মস্তিষ্কের ক্ষমতা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন।
গল্পটি অনেক বছর আগে লেখা হলেও এতে সাইবারনেটিক্স এবং নিউরোলজি সংক্রান্ত যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা বর্তমানকালের ধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি সত্যিই অসাধারণ এবং একটি নতুন অভিজ্ঞতা। গল্পটি একদিকে যেমন বিজ্ঞানভিত্তিক, তেমন অন্যদিকে মানব মন ও যন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে। এই বিষয়টি পাঠককে বিশেষভাবে আলোড়িত করে।