নক্ষত্রের সংখ্যা, প্রাণ-উৎপত্তির বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতি—এই তিনটি বিবেচনা করে বুদ্ধিমান প্রাণীর গতিপ্রকৃতি ও তা থেকে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতার বিকাশের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে আমাদের গ্যালাক্সিতে কী পরিমাণ উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতা থাকতে পারে, ড্রেক সমীকরণের সাহায্যে তার একটা গাণিতিক হিসাব কষা যায়। এখানে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতা (অ্যাডভান্সড টেকনিক্যাল সিভিলাইজেশন) বলতে ন্যূনতম বেতার জ্যোতির্বিদ্যা ব্যবহারে সক্ষম সভ্যতাকে বোঝানো হয়েছে, যদিও এই সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ।
অসংখ্য জগৎ থাকতে পারে। যার অধিবাসীরা দক্ষ ভাষাবিদ, অসাধারণ কবি-সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞ। কিন্তু বেতার জ্যোতির্বিদ্যায় অক্ষম। ফলে সেখানে না গিয়ে আমাদের পক্ষে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। এই হিসাবে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ, নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যু, গ্রহ বিবর্তনসম্পর্কিত জীববিদ্যা, ইতিহাস, রাজনীতি এবং অ্যাবনরমাল সাইকোলজি বিবেচনা করা হয়েছে। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে নিচের সমীকরণের আকারে প্রকাশ করা যায়:
N = N* x fp x ne x fl x fi x fc x fL...........(১)
এখানে ব্যবহৃত সবগুলো f হলো ভগ্নাংশ, যাদের মান ০ ও ১–এর মধ্যে। এগুলো ছাঁকনির মতো অল্প অল্প করে N-এর বিশাল মানকে কমিয়ে দেয়। একেই ড্রেক সমীকরণ বলে।
প্রায় ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র–অধ্যুষিত এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এই সংখ্যাকেই N* বলে অভিহিত করা হয়।
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রায় বেশির ভাগ নক্ষত্রের জীবনকাল শতকোটি বছর অথবা তার চেয়ে বেশি, যে সময় ধরে স্থিরভাবে এগুলো কিরণ দিয়ে যাচ্ছে এবং নিকটবর্তী গ্রহগুলোতে প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তনের জন্য শক্তি সরবরাহ করছে। দেখা যাচ্ছে, নক্ষত্রের উত্পত্তি হলে তার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেয় কিছু অনুষঙ্গী গ্রহ। এ ব্যাপারটি আমরা জানি বিভিন্ন উত্স থেকে, যেমন বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাসসহ সৌরজগতের বেশির ভাগ গ্রহের উপগ্রহমণ্ডল থাকা, যুগ্ম নক্ষত্র ও নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তনরত গ্যাসীয় পদার্থের পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি। এর ফলে ধারণা করা যায় যে বেশির ভাগ নক্ষত্রের গ্রহমণ্ডল আছে।
বর্তমানে প্রায় ২৭৮০টি গ্রহমণ্ডলে প্রায় ৩৭১০টি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা হয়েছে ২০ বছরের মধ্যে। গ্রহগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪৭ উরসা মেজরিস, ৭০ ভারজিনিস, ৫১ প্যাগাসি, গ্লিস ৫৩১সি, কেপলার ২২বি। এসব পর্যবেক্ষণ ও অনুমান থেকে বিজ্ঞানীদের ধারণা আরও জোরালো হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্রের এক-তৃতীয়াংশে (fp = ১/৩) গ্রহমণ্ডল রয়েছে। তাহলে মিল্কিওয়েতে ১৩ হাজার কোটিসংখ্যক গ্রহমণ্ডল রয়েছে। সৌরজগতের আদলে ধরে নিই, প্রতিটিতে ১০টি গ্রহ আছে। তাহলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি গ্রহ রয়েছে। জীবনের মহাজাগতিক নাটকের জন্য এ এক বিশাল ক্ষেত্র।
সৌরজগতে কয়েক ধরনের গ্রহ-উপগ্রহ আছে, যেগুলো হতে পারে কতগুলো শ্রেণির প্রাণীর জন্য অনুকূল। একটা নিশ্চিতভাবে পৃথিবী এবং ইদানীং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মঙ্গলে একসময় প্রাণের পরিবেশ ছিল। যদিও এখন পর্যন্ত সেখানে সরাসরি কোনো জীবাশ্ম–সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। টাইটানে জৈব মেঘ, বৃহস্পতির আবহমণ্ডলের পরিবেশ ও এর উপগ্রহ ইউরোপার কথাও বলা যায় তার পানির অস্তিত্বের কারণে। যদি একবার জীবনের উদ্ভব ঘটে তাহলে তা প্রাণপণে পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকার চেষ্টা করে। উত্তপ্ত সালফিউরিক অ্যাসিডের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ প্রাণ জীবিত থাকে। এতগুলো গ্রহে প্রাণ থাকার সম্ভাবনার পরও আমরা যদি প্রতিটি গ্রহমণ্ডলে দুটি করে (fp = 2) অনুকূল পরিবেশসহ গ্রহ আছে ধরে নিই, তাহলে আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি গ্রহে প্রাণের উদ্ভব সম্ভব।
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়, কোন সাধারণ মহাজাগতিক পরিবেশে প্রাণের আণবিক কাঠামোগুলো সহজে তৈরি হয়। এ কথা আমরা আগেও বলেছি। এরপরও বলা যেতে পারে, অনুকূল পরিবেশে প্রতি তিনটার ((fl = 1/3)) একটায় একবারের জন্য প্রাণের উদ্ভব ঘটে। যেমন মঙ্গলে ঘটেছিল। কিন্তু টিকে থাকেনি। তাহলে ১০ হাজার কোটি গ্রহে একবারের জন্য প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল।
আমাদের বর্তমান বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিবিদ্যা অর্জনের জন্য জীববিবর্তন ও মানবেতিহাসে স্বতন্ত্রভাবে অনেক অপ্রত্যাশিত ধারাবাহিক ঘটনার উদ্ভব হয়েছিল। নির্দিষ্ট সামর্থ্যের উন্নত সভ্যতা তৈরি হতে গেলে প্রতিটির ভিন্ন ভিন্ন বিবর্তনের ধারা থাকবে। কেউ কেউ মনে করেন, আর্থোপডা টাইপের ট্রাইলোবাইটের উত্পত্তি হতে গার্হস্থ্য জীবনে আগুনের ব্যবহার পর্যন্ত বিকাশটি হওয়ার জন্য বিভিন্ন গ্রহে অনুরূপ যে ঘটনাগুলো ঘটার দরকার, তা খুব সহজে ঘটে যাবে। আবার অনেকে ভাবেন, এমনকি ১ হাজার কোটি বছরেও প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতার বিকাশ ঘটা প্রায় অসম্ভব। বিভিন্ন প্রকার বৈজ্ঞানিক মতামতের মাঝামাঝি অবস্থান নিলে বলা যায়, ১০০ প্রাণের উদ্ভবের সম্ভাবনাময় গ্রহের মাত্র একটিতে (fifc = ১/১০০) প্রাযুক্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটতে পারে। এই হিসাবে বলা যায়, ১০০ কোটি গ্রহে অন্তত একবার প্রাযুক্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে।
fl = কোনো গ্রহে প্রাযুক্তিক সভ্যতার বয়স এবং গ্রহের বয়সের অনুপাত। এই হিসাবে গ্যালাক্সিতে বর্তমানে ১০০ কোটি গ্রহে প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতা আছে বলার চেয়ে উপরিউক্ত কথা ভিন্ন। উন্নত প্রযুক্তি করায়ত্ত করার পথে ওই সভ্যতায় নানা রকম সমস্যা হতে পারে। যেমন আমাদের সভ্যতায় ঘটছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অনেক ধরনের অনিশ্চয়তা আমাদের ঘিরে আছে। গ্রহাণু বা ধূমকেতুর আঘাত। ছোট ধূমকেতু বা গ্রহাণুর ধেয়ে আসা প্রতিরোধ করতে পারলেও বড় গ্রহাণু বা ধূমকেতুকে কতটা পারব, তা আমরা এখনো জানি না। জানি না অনেক মহাজাগতিক বিপর্যয়ের কথা, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছে জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি।
পরমাণু বা নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয়
উত্তর কোরিয়ার হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ থেকে বুঝতে পারি পরাশক্তি ছাড়াও অন্যান্য দেশের কাছে নিউক্লিয়ার শক্তি চলে যাচ্ছে। সবাই বলছে, পরাশক্তিগুলোর কাছে আমরা অনিরাপদ। সবাই তার নিজের দেশের জন্য ভাবছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে পৃথিবীর জন্য কারা ভাববে, পৃথিবীকে কারা বাঁচাবে?
প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল
আধুনিক প্রযুক্তি ও পুরোনো ধারণা নিয়ে জীবনযাপন একধরনের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। পরিবেশদূষণ, জলবায়ু বিপর্যয় শুধু আমাদের শরীরের ওপর নয়, আচরণের ওপরও প্রভাব ফেলেছে।
সাংস্কৃতিক সংকট
দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে গড়ে ওঠা সমাজের অনমনীয় অবস্থান। আমারটাই শ্রেষ্ঠ বা এটাই একমাত্র, এ রকম অবস্থানে থাকা। অথচ প্রত্যেক সংস্কৃতির ধারাই সমান্তরালভাবে পরস্পরকে ক্ষতি না করে এগিয়ে যেতে পারে এবং সমৃদ্ধ হতে পারে।
জীববিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নৈতিকতার বিকাশ না ঘটিয়ে মানুষ অতিপ্রাকৃতিক বা কাল্পনিক এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার ওপর দাঁড় করিয়ে বিকাশ ঘটিয়েছে। ফলে আমরা যা নই, তা হতে গিয়ে একধরনের তীব্র মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি হচ্ছে।
গ্রহাণু, ধূমকেতুর আঘাত, পরমাণু যুদ্ধের ভয়, সাংস্কৃতিক সংকট, প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকাল, চাহিদা ও সরবরাহের মারাত্মক বিকাশ, নৈতিকতার মানদণ্ডের বিভ্রান্তি নিয়ে ৫০০ কোটি বছরের পৃথিবীতে মাত্র শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে একটি প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতা। উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর নিরিখে এ কথা প্রশ্নাতীত নয়, আগামীকাল আমরা আমাদের ধ্বংস করে ফেলব না। ধরি, এটা প্রায়ই ঘটে, এতটাই সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় যে আরেকটি প্রযুক্তিসম্পন্ন সভ্যতা মানবপ্রজাতি বা অন্য প্রজাতি ৫০০ কোটি বছর অথবা ওই সূর্যের ধ্বংসের আগপর্যন্ত নতুনভাবে উঠে আসতে পারবে না।
কার্ল সাগান ও ফ্রাঙ্ক ড্রেকের মতো বিজ্ঞানীরা এই আশাবাদী হয়ে বলেছেন, অল্প কিছু সভ্যতা উচ্চস্তরের প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে বাঁচতে শিখেছে। যেখানে মস্তিষ্কের বিবর্তনে উদ্দেশ্যহীনভাবে আরোপিত অসংগতিগুলো সচেতনভাবে দূর করে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে। অথবা বড় রকমের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সামর্থ্য হয়েছে। যেমন আমরা চেষ্টা করছি। যেসব সমাজ সফলভাবে দীর্ঘকাল টিকে থাকবে, সেসব সভ্যতার জীবনকাল পরিমাপ করা সম্ভব হবে। সম্ভবত ভূতাত্ত্বিক কাল অথবা নক্ষত্রের জীবন–মৃত্যুর সময়ের ব্যাপ্তিতে। যদি সভ্যতাগুলোর ১০০টির মধ্যে ১টিও তাদের প্রাযুক্তিক বিকাশের বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করতে পারে, ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে সঠিক পথটি বেছে নিতে পারে এবং পরিপক্বতা অর্জন করতে পারে, তাহলে অন্তত ১ কোটি গ্রহে একই সময়ে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত সভ্যতার টিকে থাকা সম্ভব এই গ্যালাক্সিতে। তবে ফ্রাঙ্ক ড্রেকের সমীকরণে জ্যোতির্বিদ্যা, জৈব রসায়ন ও বিবর্তন জীববিদ্যাসম্পর্কিত বিষয়গুলোর পরিমাপে যে সংশয় রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অনির্ভরযোগ্যতা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মানবপ্রকৃতি নিয়ে। রুশ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নিকোলাই কার্দাশেভ ৫০ বছর আগে কার্দাশেভ মহাজাগতিক সভ্যতার স্কেল প্রস্তাব করেছিলেন। সেখানে তিন ধরনের সভ্যতার অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, যথাক্রমে—টাইপ ১, টাইপ ২, টাইপ ৩।
টাইপ ওয়ান সভ্যতা
নক্ষত্র বা সূর্যের বিকীর্ণ সব শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারবে। সেই প্রাপ্তিযোগ্য শক্তি 1.74×1017 ওয়াট। এ ছাড়া বায়ুমণ্ডল, ভূত্বক, আবরণ, কেন্দ্রের মতো গ্রহের অন্যান্য শক্তির ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। টাইপ ওয়ান সভ্যতা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ুকে প্রভাবিত, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত প্রতিরোধে সক্ষম হবে। সবচেয়ে বড় কথা জ্বালানির সংকট থেকে মুক্তি পাবে।
পদার্থবিজ্ঞানী মিচিও কাকু আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, মানবজাতি ১০০ থেকে ২০০ বছরের মধ্যে টাইপ ওয়ান সভ্যতায় পৌঁছাবে। কিন্তু একাবিংশ শতাব্দীতে টুইন টাওয়ার ধ্বংস, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক নতুন মেরুকরণ ও নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিয়ে টানাপোড়েন এক অস্থিতিশীল বিশ্বে পৃথিবীকে নিয়ে যাচ্ছে; অর্থনৈতিক বৈষম্য আর জলবায়ু বিপর্যয় ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির ভবিষ্যদ্বাণীকেই যেন নিশ্চিত করছে।