মানব সভ্যতা টাইপ টু সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?

এনার্জি বা শক্তি ছাড়া আমাদের আজকের জীবনের একটা দিনও কি কল্পনা করা যায়? যায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে যে পানি ব্যবহার করি, সেটা আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছাতেও প্রয়োজন বিদ্যুৎ শক্তি। রাতে আলোর জন্য প্রয়োজন শক্তি। চলাচলের জন্য শক্তি প্রয়োজন। বাসায় বসে কিছু করতে চাইলেও দরকার এই শক্তি। যা-ই করি না কেন, শক্তি ছাড়া বর্তমান সভ্যতা অচল।

বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষের মৌলিক উদ্দেশ্য এই মহাবিশ্ব, আমরা সবাই কোথা থেকে এলাম, কেন এলাম—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। আর এসব প্রশ্নের জবাবের জন্য মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া দরকার। নিজেদের শক্তি সংগ্রহ ও শক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। শক্তি ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে বুদ্ধিমান সত্ত্বার সভ্যতাকে তিনভাগে ভাগ করা হয় কার্দাশভ স্কেলে।

এই স্কেল অনুযায়ী মানব সভ্যতা এখনও টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশনে পৌঁছাতে পারেনি। আমরা এ মুহূর্তে টাইপ জিরোতে আছি। কিন্তু ক্রমাগত পৃথিবীর শক্তি পুরোপুরি ব্যবহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। কোনো সভ্যতা তার গ্রহের পুরো শক্তি ব্যবহার করতে পারলে তাকে টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন বলা হয়। আমরা ইতিমধ্যেই পৃথিবীর নানা শক্তি, যেমন জীবাশ্ম জ্বালানী, বায়ু, পানি, সৌরশক্তি এসব ব্যবহার করছি। টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন হতে তাই খুব বেশি দেরী নেই। টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন হলে মানব সভ্যতা কেমন হতো, নিয়ে আগে একটি লেখায় আলোচনা করা হয়েছে। আজ জানার চেষ্টা করব টাইপ টু সিভিলাইজেশন হলে মানব সভ্যতার রূপ কেমন হতো। আর এ ধরনের সভ্যতা হতে হলে কী কী করতে হবে আমাদের।

আরও পড়ুন
গ্রহাণুর কথা যখন উঠল, তখন একটা সুসংবাদ দেওয়া যাক। গ্রহাণু পৃথিবীর জন্য বরাবরই মহাজাগতিক দুর্যোগ ছিল। ধারণা করা হয়, লাখ লাখ বছর আগে প্রকাণ্ড কোনো গ্রহাণুর আঘাতেই বিলুপ্ত হয়ে যায় ডাইনোসরেরা।

কার্দাশভ স্কেল অনুযায়ী, কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বাকে টাইপ টু সিভিলাইজেশন হতে হলে আমাদের সূর্যের সমস্ত শক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা থাকতে হবে। শুনে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সূর্যের মতো নক্ষত্র থেকে কীভাবে শক্তি সংগ্রহ করা যায়, তা ভেবে বের করেছেন বিজ্ঞানীরা। এজন্য সূর্যের চারপাশে আমাদের তৈরি করতে হবে এক মহাকাঠামো। একে বলা হয় ডাইসন গোলক। এই মহাকাঠামোটি তৈরি হবে কোটি কোটি শক্তি সংগ্রাহক কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়ে। পুরো সূর্যকে ঘিরে থাকবে এই কাঠামো। সরাসরি নক্ষত্রের শক্তি সংগ্রহ করবে এই কৃত্রিম উপগ্রহগুলো, আর সেটা সরবরাহ করবে পৃথিবীতে। এ শক্তিকে আমাদের ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। এরপর সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাড়ি দেওয়া যাবে আন্তঃনাক্ষত্রিক দুরত্ব। করা যাবে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় কাজসহ আরও অনেক কিছু।

ডাইসন গোলক তৈরির আগে অবশ্য পৃথিবীতে আমাদের আরও অনেক উন্নতি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, মহামারি, এমনকি গ্রহাণুর মতো দুর্যোগ আমাদের এ যাত্রাপথে বড় বাধার সৃষ্টি করতে পারে। শুরুতেই তাই এসব দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বের করতে হবে।

গ্রহাণুর কথা যখন উঠল, তখন একটা সুসংবাদ দেওয়া যাক। গ্রহাণু পৃথিবীর জন্য বরাবরই মহাজাগতিক দুর্যোগ ছিল। ধারণা করা হয়, লাখ লাখ বছর আগে প্রকাণ্ড কোনো গ্রহাণুর আঘাতেই বিলুপ্ত হয়ে যায় ডাইনোসরেরা। যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন, গ্রহাণু পৃথিবীর জন্য মারাত্মক হুমকি। বিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকে পৃথিবীকে গ্রহাণুর আঘাত থেকে কীভাবে বাঁচানো যায়, তা নিয়ে কাজ করেছেন। অবশেষে ২০২১ সালে নাসার একদল বিজ্ঞানী সফলভাবে ডার্ট মিশন পরিচালনা করেন। এই মিশনের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বহুদূরে অবস্থিত একটি গ্রহাণুর কক্ষপথে চ্যুতি ঘটানো হয়। গ্রহাণুটিকে সরিয়ে দেওয়া যায় অন্যদিকে। এখন পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো গ্রহাণুকে মাঝপথে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম আমরা। অর্থাৎ মহাজাগতিক এই দুর্যোগ থেকে আমরা নিরাপদ। টাইপ ওয়ান বা টাইপ টু সিভিলাইজেশন হওয়ার পথে বড় একটি প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে এর মাধ্যমে।

যাহোক, সূর্যের সমস্ত শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে মহাজাগতিক প্রায় সব বিপদ আমরা মোকাবেলা করতে পারব। শুধু তাই নয়, তাত্ত্বিকভাবে তখন আমরা সৌরজগতের সমস্ত গ্রহ-উপগ্রহের কক্ষপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। এমনকি ডাইসন গোলকের কল্যাণে অন্যগ্রহগুলো বাসযোগ্য করেও তোলা সম্ভব হতে পারে। সূর্য থেকে আসা তাপমাত্রা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব আমরা। সূর্য হবে অনেকটা পারমাণবিক চুল্লির মতো একটি ব্যবস্থা। টাইপ টু সিভিলাইজেশনে পৌঁছালে সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহে আমাদের যাত্রা হবে সহজ। ছুটি কাটানোর জন্য দেশান্তরে যাওয়ার মতোই সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হবে গ্রহান্তরে ভ্রমণ। আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণও সম্ভব হবে তখন সূর্যের পুরো শক্তি ব্যবহারের কারণে।

আশার কথা হলো, তাত্ত্বিকভাবে ডাইসন গোলক তৈরি করা সম্ভব। তবে প্রযুক্তিগতভাবে সে সক্ষমতা অর্জন করতে মানুষকে পাড়ি দিতে হবে বহু পথ। শুধু প্রযুক্তিগত বা মহাজাগতিক সীমাবদ্ধতা কাটালেই হবে না, নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিবাদসহ আরও অনেক মানবীয় সমস্যার সমাধানও করতে হবে। তবেই মানুষ হয়ে উঠতে পারবে টাইপ টু সিভিলাইজেশন। তবে তার আগে টাইপ ওয়ান সভ্যতা হয়ে উঠে নিজেদের লোভের লাগামও টেনে ধরতে হবে যথার্থভাবে। মানুষ সেটা করতে পারবে কি না, তার ওপরেই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াইটইফশো, উইকিপিডিয়া