মানব সভ্যতা টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?

কল্পনা করুন তো, আমরা যদি সুনামি বা ভূমিকম্পের শক্তিকে নিজের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারতাম, তাহলে কেমন হতো? শুধু তাই নয়, পৃথিবী ছাড়াও যদি অন্যান্য গ্রহের শক্তিগুলো আমরা ব্যবহার উপযোগী করে সংগ্রহ করতে পারতাম, তাহলে? ভাবছেন আকাশকুসুম কল্পনা করছি? হতে পারে। অন্তত বর্তমানের প্রেক্ষিতে আপনি এসব কল্পনাকে আকাশকুসুম ভাবতেই পারেন। তবে, মানব সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে এই অসম্ভব বিষয়গুলোর মতো আরও বিস্ময়কর অনেক কিছু হয়তো সম্ভব হতে পারে ভবিষ্যতে।

সেই পর্যন্ত কীভাবে যেতে পারে মানুষ? আর মানুষ সেই ক্ষমতা অর্জন করলেই-বা কী ঘটবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, কেনই-বা এই আজগুবি চিন্তা করছি?

বুদ্ধিমত্তা আছে, এমন কোনো সভ্যতা কত উন্নত হতে পারে, তা নিয়ে ভেবেছিলেন রাশিয়ার জ্যোতিঃপদার্থবিদ নিকোলাই কারদাশেভ। কোনো সভ্যতার কাছে কী পরিমাণ শক্তি ব্যবহারের সুযোগ আছে, তার ওপর ভিত্তি করে একটি স্কেল তৈরি করেন তিনি ১৯৬৪ সালে। তাঁর নাম অনুসারে এই স্কেলকে বলা হয় কারদাশেভ স্কেল। এই স্কেলে তিন ধরনের সভ্যতার কথা বলা হয়। টাইপ ওয়ান, টাইপ টু ও টাইপ থ্রি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
উন্নত সেই সভ্যতায় মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকেও শক্তি সংগ্রহ করত। সুনামি বা ভূমিকম্পের মতো দূর্যোগ থেকে শক্তি সংগ্রহের বিষয়টি তখন হতো একেবারেই স্বাভাবিক

বর্তমানে মানবজাতি অবশ্য কারদাশেভ স্কেল অনুযায়ী টাইপ ওয়ান সভ্যতার ধারেকাছেই যেতে পারেনি। এর কারণ মানুষ এখনও পৃথিবীর সমস্ত শক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম নয়। আমরা কাঠ, কয়লা তেলের মতো কিছু শক্তির উৎস কেবল ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু এ ছাড়াও পৃথিবীতে আছে শক্তির আরও নানা উৎস।

তাই, কেমন হবে যদি মানব সভ্যতা উন্নত হয়ে টাইপ ওয়ান সভ্যতা পর্যন্ত যেতে পারে?

টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন বলতে এমন এক সভ্যতাকে বুঝানো হয়, যারা নিজ গ্রহের সব শক্তি নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ মানুষ টাইপ ওয়ান সভ্যতা হলে সবরকম জীবাশ্ম জ্বালানীকে চিরতরে বিদায় জানাতে পারত। কারণ, শক্তির এই উৎসগুলোর পরিমাণ সীমাবদ্ধ।

এর বদলে মানুষ বায়ু, সূর্যের আলো এবং পানিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করত শক্তি। মজার ব্যাপার হলো, টাইপ ওয়ান সভ্যতা হতে পারলে শক্তি এতটাই সহজলভ্য হতো যে, তার জন্য হয়তো কাউকেই আর পয়সা দিতে হতো না। শক্তি ব্যবহৃত হতো অনেক বেশি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে প্রয়োজন হতো শক্তির। সহজ কথায়, আমাদের জন্য অক্সিজেন যেমন প্রয়োজন, টাইপ ওয়ান সভ্যতার জন্য একইরকম দরকারি হলো শক্তি।

শিল্পীর কল্পনায় টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশনের পৃথিবী

উন্নত সেই সভ্যতায় মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকেও শক্তি সংগ্রহ করত। সুনামি বা ভূমিকম্পের মতো দূর্যোগ থেকে শক্তি সংগ্রহের বিষয়টি তখন হতো একেবারেই স্বাভাবিক। গ্রহের সব শক্তির নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে থাকায় আবহাওয়াও নিয়ন্ত্রণ করতে পারত মানুষ। পৃথিবীর কোনো অঞ্চলে খরা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে নিমিষেই সেখানে মেঘ পাঠিয়ে বৃষ্টি নামানো সম্ভব হতো।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার মতো বিষয়কে চিরতরে বিদায় জানাতে পারত মানুষ। নিশ্চিত করতে পারত বায়ুমণ্ডলের কার্বনসহ সব গ্যাসের সুষম বন্টন। সম্ভব হতো পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ। প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ একেবারে কমিয়ে আনা যেত। কোনো দূর্যোগ আসার আগেই সেটার প্রায় নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারত মানুষ।

এখানেই শেষ নয়। মানুষ পৃথিবীর এমন সব জায়গায় বসতি স্থাপন করতে পারত, যা বর্তমানে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যেমন পানিতে। যেমনটা ভাবা হয় কল্পকাহিনীর আটলান্টিস শহর। এ ছাড়া জলবায়ুর কারণে যেসব জায়গায় মানুষের বসবাস প্রায় অসম্ভব, সেসব জায়গাতেও দিব্যি আরামে থাকতে পারত মানুষ। মোট কথায়, কারদাশেভ স্কেল অনুযায়ী টাইপ ওয়ান সভ্যতা মানুষের জন্য হবে এক স্বপ্নের পৃথিবী। এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে, শান্তি-সুখের এই পৃথিবী একঘেয়ে হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সামনে আছে আরও দুই ধাপের উন্নত সভ্যতা। টাইপ টু ও টাইপ থ্রি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
শিল্পীর কল্পনায় ভবিষ্যতের পৃথিবী

টাইপ ওয়ান সভ্যতার বেলায় মানুষ শুধু পৃথিবীর সব শক্তি ব্যবহার করবে। পৃথিবীকে করতে পারবে সুন্দর। কিন্তু কারদাশেভ স্কেল অনুযায়ী টাইপ টু সভ্যতায় মানুষ শুধু পৃথিবী নয়, বরং পুরো সৌরজগতেরই শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। সরাসরি শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে সূর্য থেকে। এই শক্তি ব্যবহার করে সৌরজগতের সব গ্রহে যেতে পারবে মানুষ ইচ্ছামতো। চাই কি মঙ্গলকেও মানুষ করতে পারবে বাসযোগ্য। অর্থাৎ টাইপ টু সভ্যতা নিজস্ব নক্ষত্রজগতের সব শক্তি ব্যবহার করতে পারে।

আর টাইপ থ্রি সভ্যতা হয়ে উঠলে মানুষ পুরো গ্যালাক্সির শক্তি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারবে। সেক্ষেত্রে কী হতে পারে, তা নিয়ে অন্য কোনো লেখায় বলা যাবে।

কারদাশেভ তাঁর স্কেলে তিন স্তরের উন্নত সভ্যতার কথা বলেছিলেন। তবে এরপর বিজ্ঞানীরা আরও চিন্তা করেছেন, মানব সভ্যতা কতটা উন্নত হতে পারে, তা নিয়ে। বর্তমানে পাঁচ কিংবা সাত স্তরের সভ্যতার কথাও বলা হয় অনেক জায়গায়। তবে, সেটা বেশ জটিল। পদার্থবিজ্ঞানের বর্তমান জ্ঞান দিয়ে এসব সভ্যতাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যাও করা যায় না। প্রচুর অনুকল্পের সাহায্য নেওয়া হয়।

যাই হোক, মানব সভ্যতা কখনো এই ধাপগুলোয় পৌঁছাবে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, আগামী প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে মানুষ টাইপ ওয়ান সভ্যতার বাসিন্দা হতে পারে।

তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা দিনদিন বাড়ছে। পরিবেশ দূষণের হারও কমছে না। পাশাপাশি আছে যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো ভয়াবহ সব ব্যাপার। সভ্যতাকে উন্নত করতে হলে এসব বন্ধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের সবার। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানসিকতাতেও আনতে হবে ইতিবাচক পরিবর্তন। তাহলেই হয়তো একদিন মানুষ পৌঁছাতে পারবে টাইপ ওয়ান সভ্যতার পর্যায়ে। যদিও এটা এখনো শুধুই কল্পনা কিংবা সম্ভাবনা, তবু আমরা গত ২০০ বছরে যতটা এগিয়েছি, এটুকু স্বপ্ন তো দেখাই যায়!

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াট ইফ শো ডট কম, ফিউচারিজম, উইকিপিডিয়া