চাঁদ না থাকলে কী হতো

সেই প্রাচীনকাল থেকেই চাঁদ মানুষের পরম বন্ধু। রাতের আঁধারে ঢাকা আকাশ অপার্থিব মায়াময় আলোতে ঢেকে যায়, চাঁদের উপস্থিতিতে। জোছনা রাতে চাঁদের আলো সবার মনকেই কিছুটা আন্দোলিত করে। মানুষের মনের সঙ্গে চাঁদের সম্পর্ক কীভাবে আছে, তা আমাদের সঠিক জানা নেই। কিন্তু সম্পর্ক যে আছে সে তো সত্য। যুগে যুগে সেকারণেই চাঁদ নিয়ে রচিত হয়েছে হাজারও কাব্য, কথা আর গান। তার রেশ এখনও কাটেনি। চাঁদ নিয়ে গল্প উপকথার সংখ্যাও কম নয়। বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় চাঁদকে রীতিমতো দেবতা মেনে পূজা করার চলও ছিল।

এসব ছাড়িয়ে চাঁদের আরেক পরিচয়, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে মহাজাগতিক বস্তু। নিকটতম প্রতিবেশি। পৃথিবীর জোয়ার-ভাটা, ঘূর্ণন এরকম বেশ কিছু ক্ষেত্রে চাঁদের সরাসরি ভূমিকা আছে। প্রথম যে মহাজাগতিক বস্তুর বুকে মানুষ পা রাখে, সেটাও চাঁদ। যেদিক থেকেই দেখি না কেন, চাঁদ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এখন যদি চাঁদের অস্তিত্ব একেবারেই না থাকত, তাহলে পৃথিবীর অবস্থাটা কেমন হতো? কী প্রভাবই বা পড়ত আমাদের জীবনে? এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন যদি আপনার মনে কখনো জাগে, তাহলে এবার সময় হয়েছে তার উত্তরটাও জেনে নেবার।

চাঁদের টান বল শুধু যে জোয়ার-ভাটাই সৃষ্টি করে তা নয়। একই সঙ্গে কমায় পৃথিবীর নিজ অক্ষে ঘূর্ণন গতি।

প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার নিজ অক্ষে পাক খাচ্ছে পৃথিবী। একই সঙ্গে এক বছরে চক্কর দিচ্ছে সূর্যের চারপাশে। এই চক্কর পৃথিবী দিচ্ছে চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব প্রায় পৌনে ৪ লাখ কিলোমিটার। পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে ক্রমাগত ঘুরছে চাঁদ। ওজন প্রায় ৭.৩×১০২২ কেজি। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রানুসারে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীকে টানছে নিজের দিকে টানছে চাঁদ। টানছে সূর্যও। এই টানাটানি ফলে প্রতিদিন দুবার জোয়ার-ভাটা হচ্ছে পৃথিবীর বুকে।

পৃথিবীর ওপর সূর্যের চেয়ে চাঁদের মহাকর্ষ টান বেশি। ফলে, এখন যে জোয়ার-ভাটা দেখি আমরা তার পিছনে চাঁদের ভূমিকাই মূখ্য। কিন্তু উভয়ের টানাটানির ফলে মোট টান বল (Pull force) কিছুটা কমে যায়। চাঁদ না থাকলে, শুধু সূর্যের টান বল কাজ করত পৃথিবীর ওপর। ফলে সামগ্রিকভাবে জোয়ারের সময় পানির পরিমাণ বাড়ত প্রায় ৪০ শতাংশ। বিজ্ঞানীদের মতে, এতে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রভাব তেমন একটা পড়ত না ঠিক, কিন্তু বিষয়টি দেখা যেত খালি চোখেই।

চাঁদের টান বল শুধু যে জোয়ার-ভাটাই সৃষ্টি করে তা নয়। একই সঙ্গে কমায় পৃথিবীর নিজ অক্ষে ঘূর্ণন গতি। চাঁদের অভাবে এ ঘূর্ণন যেত বেড়ে। ফলে দিনরাতের দৈর্ঘ্য যেত কমে। সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের পিছনেও রয়েছে চাঁদের সক্রিয় ভূমিকা। চাঁদ না থাকলে কোনটিই ঘটত না।

পৃথিবী যে নিজ অক্ষে উত্তর-দক্ষিণ মেরু বরাবর হেলে আছে, তার পিছনেও কিন্তু চাঁদের অবদান আছে। পৃথিবীর হেলানো অবস্থা স্থির রাখতে সাহায্য করে করে চাঁদ। চাঁদ না থাকলে, এই অবস্থা স্থির থাকত না। প্রভাব পড়ত, ভূ-সংস্থান এবং ঋতু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

চাঁদের অনুপস্থিতিতে রাতের আকাশ হতো প্রায় অন্ধকার। তারার মিটমিটে আলোতে দেখার জন্য আমাদের চোখ আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠত বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। ফলে, অল্প আলোতে দেখার শক্তি বৃদ্ধি পেত। পরিবর্তন আসত নিশাচর প্রাণীদের জীবনযাত্রাতেও।

মজার কথা হচ্ছে, চাঁদ না থাকলে কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগে আমরা চন্দ্রবিজয় করতে পারতাম না। তাছাড়া চাঁদের আলো বা জোছনা এই যে আমাদের এতো আবেগ, সেটারই কি জন্ম হতো? বিপুল এই মহাবিশ্বের কোনকিছুই অপ্রয়োজনীয় না। সামান্য গ্রহাণুও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদ না থাকলে পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকতে বড় কোন সমস্যা হতো না ঠিক, কিন্তু জীবনটা হতো পুরোপুরি অন্যরকম।

চাঁদের জন্ম কীভাবে হয়েছিল, তার সঠিক ইতিহাস বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না। কিন্তু এ নিয়ে অনেক অনুকল্প আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অনুকল্পটি বলে, পৃথিবীর সঙ্গে থিয়া নামক এক প্রোটো গ্রহের সংঘর্ষের ফলে প্রায় সাড়ে চারকোটি বছর আগে জন্ম হয় চাঁদের। থিয়ার আকার ছিল প্রায় মঙ্গলগ্রহের সমান। তরুণ উত্তপ্ত পৃথিবীর সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে বাষ্পীভূত ধূলিকণার দিয়ে তৈরি হয় পৃথিবীর বলয়। বলয়ের কিছু অংশ নেমে আসে পৃথিবীতে। বাকি অংশ জড়ো হয়ে তৈরি হয় আজকের চাঁদ।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, ন্যাচারনুন ডট কম