পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। একজন মানুষের ওজন গড়ে ৫০ কেজি হলেও মোট ওজন দাঁড়ায় ৪০০ কোটি কেজির বেশি! সংখ্যাটা বিশাল। এবারে ভাবুন তো, কী হবে যদি পৃথিবীর সবাই একসঙ্গে লাফ দেয়?
সাউথইস্টার্ন লুইজিয়ানা বিশ্ববিদ্যলয়ের পদার্থবিজ্ঞানী রেত অ্যালেইনের মতে, ধাক্কার পরিমাণ বিশাল মনে হলেও আসলে কিছু ঘটবে না। কারণ, পৃথিবী জুড়ে এই ৮০০ কোটি মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। একেকজন আছেন একেক দিকে। তাই সবাই মিলে পৃথিবীর সবদিক থেকে একসঙ্গে লাফ দিলে, লাফিয়ে ওঠা এবং নেমে আসার ধাক্কা গড় হিসেবে কাটাকাটি হয়ে যাবে। আরেকটু সহজ করে যদি বলি, বাংলাদেশের উল্টোপাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশ বা ভারতসহ আশেপাশের এলাকায় যাঁরা লাফ দেবেন, তাঁদের লাফিয়ে ওঠা এবং নেমে আসার ধাক্কা উল্টোপাশের মার্কিনিদের নেমে আসার ধাক্কার সঙ্গে কাটাকাটি হয়ে যাবে। ফলে পৃথিবীর ওপর প্রযুক্ত লব্ধি (মোট) বলের পরিমাণ হবে অতিসামান্য বা প্রায় শূন্য।
আপনি হয়তো মনে মনে ভাবছেন, ৮০০ কোটি মানুষ লাফ দিয়েও কিছু হলো না! পণ্ডশ্রম! সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় যেহেতু কিছু হচ্ছে না, এবার তাহলে অন্য ব্যবস্থা করা যাক। কী করা যায়? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করতে হবে। এতে লাফ দেওয়ার বিষয়টিতেও সামঞ্জস্য আসবে। সবাই মিলে একদম একইসঙ্গে লাফ দেওয়া যাবে।
ঠিক আছে। এবারে তাহলে ভাবা যাক, সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে লাফ দেবেন। কী হবে তাহলে?
ভরবেগ ও শক্তির সংরক্ষণ সূত্র ব্যবহার করে আমরা এটা হিসাব করে দেখতে পারি। ৮০০ কোটি মানুষ একসঙ্গে লাফ দিলে সবার মোট ধাক্কার পরিমাণ হবে ৩×১০৯ কেজি। ১০২৪ কেজি ভরের পৃথিবীর ওপর এই ধাক্কা কেমন প্রভাব ফেলবে?
প্রথমে দৃশ্যপটটা আরেকবার দেখে নেওয়া যাক। গড়ে একজন মানুষ লাফ দিয়ে মোটামুটি এক ফুট পর্যন্ত উঠতে পারেন। সবাই এক জায়গা থেকে লাফ দিলে এক জায়গাতেই এসে নামবেন। পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের মান ৯.৮ মিটার/বর্গ সেকেন্ড ধরে হিসেব করলে দেখা যায়, সবাই লাফিয়ে ওঠার ফলে পৃথিবী ২.৬×১০-১৩ মিটার/সেকেন্ড গতি প্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ এক সেকেন্ডের মধ্যে পৃথিবী একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যসার্সের একশ ভাগের একভাগ পরিমাণ স্থানচ্যুত হবে বা সরে যাবে নিজের কক্ষপথ থেকে। মানে, একচুল মতোন!
এই সরে যাওয়ার ফলে কি পৃথিবীর কক্ষপথ বদলে যাবে? এ পরিবর্তন কি স্থায়ী? এর কারণে কি আমরা পরে কখনো সরতে সরতে সৌরজগতের বাইরে চলে যাব? কেননা আমরা তো জানি, মহাকাশে সামান্য আঘাতেই কক্ষপথ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কিছুদিন আগে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পরিচালিত ডার্ট মিশনেই তার এক ঝলক দেখা গেছে। তাহলে পৃথিবীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন হবে?
রেত অ্যালেইনের মতে, এক্ষেত্রেও আসলে পৃথিবীর কিচ্ছু হবে না। কারণ, সবাই লাফিয়ে ওঠার পর আবার নেমে আসবেন একই জায়গায়, অর্থাৎ পৃথিবীর দিকে পড়বেন। ফলে পৃথিবী আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। তাছাড়া এই এতসব মানুষের লাফের ধাক্কাও পৃথিবীর ভরের তুলনায় একেবারেই নগন্য (এটা আমরা আগেই দেখেছি)। মানে, এই পুরো ঘটনায়—লাফের ফলে পৃথিবী শুধু হালকা একটু নড়ে উঠে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। ব্যাস!
এবারে হয়তো আপনি বলতে পারেন, একবার লাফ দিলে যদি এইটুকু নড়ে, তাহলে বারবার লাফালে কী হবে? আসলে এতেও কিছু হবে না। কারণ, এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। বিষয়টা আগেই আমরা সংক্ষেপে দেখেছি—লাফিয়ে ওঠার পর নেমে আসলে পৃথিবী আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। বিষয়টাকে এবারে একটু খতিয়ে দেখা যাক।
লাফ দেওয়ার সময় বায়ুচাপ কাজ করে। মানুষের চেয়ে বায়ুমণ্ডলের ওজন অনেক বেশি। প্রায় ৫.১৫×১০১৮ কেজি। সব মানুষ একসঙ্গে লাফ দিলে এই বায়ুমণ্ডল অনেকটা রবারের মতো আচরণ করবে। লাফ দিয়ে ওপরে ওঠার সময় প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের মাথার ওপরে এবং চারপাশের বায়ু ওপরে উঠে যাবে কিছুটা। ফলে টান পড়বে পৃথিবীর অন্যপাশের বায়ুতে। পরিমাণটা অবশ্য খুবই সামান্য। কিন্তু আমরা যেহেতু সামান্যের হিসেবই করছি, তাই এটাকে এখন আমলে নেওয়া দরকার। সবাই একসঙ্গে লাফ দিলে পৃথিবী সামান্য পরিমাণে আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে। আবার আমরা যখন লাফ দিয়ে পৃথিবীতে পড়ব, তখন ধাক্কার কারণে তা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
মানুষ ও পৃথিবীর ওপরে ভরযুক্ত যা কিছু আছে, সেসব পৃথিবীর সঙ্গে অনেকটা স্প্রিং এর মতো যুক্ত। পৃথিবীর অভিকর্ষ ছিন্ন করে মহাকাশে যাওয়া যেমন কঠিন কাজ, মুক্তিবেগের বেশি বেগে লাফ দিতে হয়, তেমনি পৃথিবীর অভিকর্ষের বাঁধন ছিন্ন করে তাকে কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করাও প্রায় অসম্ভব।
তাই ৮০০ কোটি মানুষ একসঙ্গে এক জায়গায় এসে সারাদিন লাফালাফি করলেও পৃথিবীর কক্ষপথে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না। বরং ৮০০ কোটি মানুষকে একত্রে রাখার মতো জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাই বেশি চিন্তার বিষয়! কোনোভাবে জায়গা পাওয়া গেলেও এত মানুষের লাফালাফিতে মাটি সামান্য দেবে যেতে পারে। আবার তাদের সবার খাবার ব্যবস্থাও তো করতে হবে। সেজন্য এরকম লাফালাফি করতেই হলে, বাংলাদেশে না করাই ভালো!
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: লাইভ সায়েন্স