পৃথিবী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ হলে কী হতো?

পৃথিবী এখন যেখানে আছে, বিজ্ঞানীরা এই স্থানকে বলেন নক্ষত্রের গোল্ডিলকস জোন। সোজা বাংলায়, যেকোনো নক্ষত্রের চারপাশে বাসযোগ্যতার জন্য সবচেয়ে অনুকূল অঞ্চল। এখানে নক্ষত্র থেকে যে তাপ এসে পৌঁছায়, তাতে পানি তরল থাকতে পারে। বরফ থাকতে পারে, থাকতে পারে জলীয় বাষ্পের মেঘ।

মানুষ মঙ্গলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শনি বা বৃহস্পতির মতো দানবীয় গ্রহের স্পষ্ট ছবি তুলছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে কত যে গবেষণা হচ্ছে প্রতিদিন, তার ইয়ত্তা নাই। শুধু কি গবেষণা? মানুষ স্বপ্ন দেখছে কোনো একদিন এসব গ্রহ জয় করার। কী আছে গ্রহগুলোতে, সরোজমিনে গিয়ে তা একবার দেখে আসার। কিন্তু কেমন হতো, যদি সৌরজগতের এই গ্রহগুলোর অস্তিত্বই না থাকত? পৃথিবীই যদি হতো সূর্যের একমাত্র গ্রহ? নিশ্চিতভাবে অন্য গ্রহ জয়ের স্বপ্ন দেখতাম না আমরা। কিন্তু রাতের আকাশটা তখন কেমন দেখাত? পৃথিবীর অবস্থানটাই-বা হতো কোথায়? পৃথিবী কি আজকের পৃথিবীর মতোই হতো, নাকি ভিন্ন?

সৌরজগতের বাকি সাতটা গ্রহ শুধু দেখতে সুন্দর কিংবা মানুষ কোনোদিন ঘুরতে যেতে পারবে, এমন জায়গা নয়। লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূরের এই গ্রহগুলো পৃথিবীতে প্রাণ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পালন করছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীর গড়ে ওঠা এবং আজকের এই অবস্থানে থাকার ব্যাপারে প্রতিটি গ্রহের অবদান আছে। উদাহরণ হিসেবে গ্রহগুলোর অবস্থানের কথাই ধরা যাক। সৌরজগতের এই বিশাল যজ্ঞে সবারই একটু করে নিজস্ব জায়গা আছে। ব্যাপারটা হঠাৎ করে হয়নি।

প্রতিটি গ্রহ একে অন্যের জায়গা ঠিকভাবে ধরে রাখার ব্যাপারে কাজ করে। মহাকর্ষীয় টানে আনে ভারসাম্য। যেমন শুক্র আর বুধ যদি না থাকত, পৃথিবী তাহলে আরও একটু এগিয়ে যেত সূর্যের দিকে। আবার শনি বা বৃহস্পতি যদি হারিয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে সরে যেত সূর্য থেকে আরও একটু দূরে। এই যে সূর্যের একটু কাছে বা সূর্য থেকে একটু দূরে সরে যাওয়া, এগুলো কিন্তু মোটেও নিরীহ ব্যাপার নয়। পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্য তো বটেই, পুরো ভূ-সংস্থানে আসতে পারে বিশাল পরিবর্তন এই সামান্য নড়াচড়ার কারণে। পৃথিবী এখন যেখানে আছে, বিজ্ঞানীরা এই স্থানকে বলেন নক্ষত্রের গোল্ডিলকস জোন। সোজা বাংলায়, যেকোনো নক্ষত্রের চারপাশে বাসযোগ্যতার জন্য সবচেয়ে অনুকূল অঞ্চল।

কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীর গড়ে ওঠা এবং আজকের এই অবস্থানে থাকার ব্যাপারে প্রতিটি গ্রহের অবদান আছে

এখানে নক্ষত্র থেকে যে তাপ এসে পৌঁছায়, তাতে পানি তরল থাকতে পারে। বরফ থাকতে পারে, থাকতে পারে জলীয় বাষ্পের মেঘ। সূর্য থেকে অবস্থান আরও কিছুটা দূরে হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা যেত কমে। পুরো গ্রহ ঢাকা পড়ত বরফের আস্তরণে। শীতল তাপমাত্রায় প্রাণ টিকে থাকা হতো প্রায় অসম্ভব। আবার সূর্যের একটু কাছে চলে গেলে পৃথিবীর হতো আরও বেশি বিপদ। প্রচণ্ড তাপ ও সৌরবায়ুর আঘাতে আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী ভাজা ভাজা হয়ে যেত।

আগেই বলেছি, সৌরজগতে পৃথিবীর এই অবস্থান শুধু প্রাণের জন্যই জরুরি নয়। পৃথিবীতে যা যা ঘটছে, তার সবকিছুই এর সঙ্গে জড়িত। ঋতু পরিবর্তন, দিনরাতের দৈর্ঘ্য, বছরের দৈর্ঘ্য—সবকিছুই বদলে হয়ে যাবে পৃথিবীর অবস্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।

তাই পৃথিবী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ হলে পরিণতিটা ঠিক কী হতো, তা চট করে বলার সুযোগ নেই। নেপচুন কিংবা ইউরেনাসের জায়গাতেও তৈরি হতে পারত পৃথিবী, আবার জন্ম নিতে পারত বুধের মতো সূর্যের একদম কাছাকাছি জায়গায়। সৌরজগতের গোল্ডিলকস জোন ছাড়া যেখানেই পৃথিবীর অবস্থান হোক না কেন, সেটা প্রাণ বৈচিত্র্যের জন্য মোটেই উপযোগী হতো না। হলেও, আমরা এখন যে ধরনের প্রাণের সঙ্গে পরিচিত, সেরকম প্রাণ থাকত না। এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পৃথিবী ছাড়া আর কোনো গ্রহ একেবারে না থাকলে কী হতো, সেটা আমরা একটু কল্পনা করলাম। কিন্তু অন্য গ্রহগুলো পৃথিবীকে কীভাবে নিরাপদ রাখছে আসলে? হঠাৎ করে এসব গ্রহ নেই হয়ে গেলেই-বা কী হতো?

প্রথমত, এই গ্রহগুলোর প্রতিটিরই আছে নিজস্ব মহাকর্ষ ক্ষেত্র। সেই মহাকর্ষের সম্মিলিত প্রভাব সূর্যের তীব্র মহাকর্ষীয় টানের বিপরীতে পৃথিবীকে নিজ অক্ষে স্থিতিশীল থাকতে বেশ কিছুটা সাহায্য করছে। যদিও পৃথিবীর নিজ অক্ষে স্থিতিশীল থাকার মূল কাজটা করছে পৃথিবী নিজেই। প্রচণ্ড গতিতে ঘোরার কারণে কক্ষপথ থেকে সোজা ছুটে যাবার যে প্রবণতা তৈরি হচ্ছে, তা শূন্য করে দিচ্ছে সূর্যের আকর্ষণ বা কেন্দ্রমুখী বল। ফলে পৃথিবী নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, অন্য গ্রহগুলো হঠাৎ নেই হয়ে গেলে এই কক্ষপথ আর স্থিতিশীল থাকত না। ক্রমশ বড় কিংবা ছোট হতে থাকত। ফলাফল কী হতে পারে, তা তো আগেই বলেছি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

তবে সবচেয়ে বিপদজনক ঘটনাটি ঘটত শনি এবং বৃহস্পতি হারিয়ে গেলে। সৌরজগতে শুধু গ্রহ, নক্ষত্র বা উপগ্রহই নয়, আছে কোটি কোটি গ্রহাণু, উল্কাপিণ্ড ও ধূমকেতু। প্রচণ্ড এলোমেলো কক্ষপথের কিছু গ্রহাণু মাঝে মাঝেই গ্রহের মহাকর্ষের টানে বাঁধা পড়ে। আছড়ে পড়ে গ্রহের বুকে। ধারণা করা হয়, এমনই এক গ্রহাণুর আঘাতে লাখ লাখ বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল ডাইনোসর।

এসব গ্রহাণুর আঘাতের বিপরীতে অনেকটা ঢালের মতো কাজ করে বৃহস্পতি ও শনি। বিশাল আকৃতি ও শক্তিশালী মহাকর্ষক্ষেত্রের সাহায্যে প্রচুর উটকো গ্রহাণুকে নিজের দিকে টেনে নেয় গ্রহ দুটি। পৃথিবী বেঁচে যায় ভয়াবহ সংঘর্ষ থেকে। তাই হঠাৎ গ্রহ দুটি হারিয়ে গেলে পৃথিবীতে শুরু হতো উল্কা ও গ্রহাণুর বিধ্বংসী বৃষ্টি। আর সেটা হলে পৃথিবীর অবস্থা কী হতো, তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বাকি গ্রহগুলোর জন্যেও একই কথা। সেগুলো হারিয়ে গেলেও তার ফলাফল পৃথিবীর জন্য শুভ কিছু বয়ে আনত না।

তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সহসাই কোনো গ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে না। বিশেষ করে এখনও যেহেতু স্টার ওয়ার্স-এর ডেথ স্টারের মতো গ্রহ ধ্বংসকারী অস্ত্র বাস্তবে নেই, গ্রহ হারিয়ে যাবার আশঙ্কাও আপাতত নেই। কিন্তু গ্রহ হারিয়ে না গেলেও প্রতিনিয়ত পৃথিবীকে নানাভাবে বিপদে ফেলছি এই আমরাই। প্রাকৃতিক নিরাপত্তা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। এর সঙ্গে আমরা মানুষেরা যদি একটু চেষ্টা করি, পৃথিবীটা তাহলেই হবে আরও সুন্দর। আরও বাসযোগ্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, হোয়াট ইফ শো