ক্যালেন্ডারের গোলমাল: নিউটনের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর নাকি ৪ জানুয়ারি
২৫ ডিসেম্বর মানেই বড়দিন, যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন। কিন্তু এই একই দিনে জন্মেছিলেন বিজ্ঞানের বরপুত্র স্যার আইজ্যাক নিউটন। তবে ক্যালেন্ডারের ফেরে তাঁর জন্মদিন নিয়েও বেধেছে গোলমাল। ইংল্যান্ডের জেদ আর পোপের ক্যালেন্ডারের দ্বন্দ্বে নিউটনের জন্মদিন কীভাবে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি হয়ে গেল?
২৫ ডিসেম্বর। এ দিনেই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মানুষেরা পালন করেন বড়দিন। যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবেই দিনটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত। কিন্তু এই দিনেই মানব ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেওয়া আরেক মহাপুরুষ জন্মেছিলেন। তিনি বিজ্ঞানের বরপুত্র স্যার আইজ্যাক নিউটন।
তবে এখানে একটা বিশাল ‘কিন্তু’ আছে। নিউটন যদি ইংল্যান্ডে না জন্মে ইউরোপের অন্য কোনো দেশে জন্মাতেন, তবে তাঁর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরের বদলে হতো ৪ জানুয়ারি! একই মানুষের দুই জন্মদিন? তা-ও আবার ক্যালেন্ডারের ফেরে? চলুন, ইতিহাসের এই মজার ঘটনাটি একটু ঘেঁটে দেখি।
১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডে জন্মেছিলেন আইজ্যাক নিউটন। তবে তাঁর জন্মটা মোটেও সুখকর ছিল না। তিনি ছিলেন প্রিম্যাচিউর বা অপরিণত। মানে সময়ের আগেই জন্মেছিলেন। জানা যায়, জন্মের সময় তিনি এতটাই ছোট আর রুগ্ন ছিলেন যে একটা এক লিটার মগের ভেতরে তাঁকে অনায়াসেই ভরে ফেলা যেত! তখন কেউ ভাবতেও পারেনি যে এই দুর্বল শিশুটি বেঁচে থাকবে আর বড় হয়ে একদিন পৃথিবীকে বদলে দেবে।
নিউটন যখন জন্মান, তখন ইংল্যান্ডের অবস্থা ছিল হুলুস্থূল। একদিকে চলছে গৃহযুদ্ধ, অন্যদিকে ধর্মের লড়াই। ইংল্যান্ড তখন পোপের ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে প্রোটেস্ট্যান্ট হয়ে গিয়েছিল। সোজা কথায়, পোপের কোনো নিয়মই তারা মানতে নারাজ ছিল।
সমস্যাটা ঠিক এখানেই। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের তৈরি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার তখন ইংল্যান্ডে প্রচলিত ছিল। এই ক্যালেন্ডারে বছর ধরা হতো ৩৬৫.২৫ দিনে। কিন্তু এটি আসল সৌর বছরের চেয়ে ১১ মিনিট এগিয়ে ছিল। শুনতে সামান্য মনে হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ১১ মিনিট জমতে জমতে ক্যালেন্ডার আর ঋতুর মধ্যে বিশাল ফারাক তৈরি হয়।
যেহেতু ইংল্যান্ড তখনো পুরোনো ক্যালেন্ডারে চলছিল, তাই তাদের হিসাবে নিউটনের জন্ম ছিল ২৫ ডিসেম্বর। কিন্তু আধুনিক বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাবে তারিখটা ৪ জানুয়ারি, ১৬৪৩।
এই সমস্যা মেটাতে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ১৫৮২ সালে নতুন এবং নিখুঁত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন। সেই ক্যালেন্ডার আজও আমরা ব্যবহার করি। ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলো পোপের এই ক্যালেন্ডার মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড জেদ ধরে বসে ছিল, তারা পোপের ক্যালেন্ডার মানবে না! তারা সেই ভুল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারই আঁকড়ে ধরে ছিল। ইংল্যান্ড এই জেদ ভেঙে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করতে সময় নিয়েছিল আরও ১৭০ বছর! ১৭৫২ সালে তারা অবশেষে ক্যালেন্ডার ঠিক করে।
যেহেতু ইংল্যান্ড তখনো পুরোনো ক্যালেন্ডারে চলছিল, তাই তাদের হিসাবে নিউটনের জন্ম ছিল ২৫ ডিসেম্বর। কিন্তু আধুনিক বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাবে তারিখটা ৪ জানুয়ারি, ১৬৪৩।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, নিউটন ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত গম্ভীর, উৎসববিমুখ, ঘরকুনো এবং কিছুটা অসামাজিক প্রকৃতির মানুষ। অথচ ক্যালেন্ডারের এই ভুলের কারণে তাঁর জন্মদিনটি গিয়ে পড়ল বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব, অর্থাৎ ক্রিসমাসের দিনে!
তাই আপনি চাইলে আজ নিউটনের জন্মদিন পালন করতে পারেন, আবার অপেক্ষা করতে পারেন ৪ জানুয়ারির জন্যও। বিজ্ঞানপিপাসু মানুষ সাধারণত ২৫ ডিসেম্বরকেই নিউটনের জন্মদিন হিসেবে পালন করেন। অনেকে এই মাসকে ‘নিউটনমাস’ বলেও ডাকেন। যদিও আধুনিক ক্যালেন্ডারে তা ৪ জানুয়ারি, তবু ঐতিহাসিক তারিখ হিসেবে ২৫ ডিসেম্বরকে নিউটনের জন্মদিন মানা হয়। তা ছাড়া, গ্যালিলিও মারা যাওয়ার বছরেই নিউটনের জন্ম—এই ঐতিহাসিক কথাটা জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ২৫ ডিসেম্বর মেনেই টেকে!