মানুষের মস্তিষ্ক কোনটিকে বেশি ঝুঁকি মনে করে, বাঞ্জি জাম্পিং নাকি চাকরি হারানো

রিস্ক নিতে আপনি কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনছবি: শাটারস্টোক

কেউ যদি আপনাকে হুট করে জিজ্ঞেস করে, আপনার জীবনে নেওয়া সবচেয়ে বড় ঝুঁকি কী? হয়তো একটু ভেবে বলবেন, শেয়ার বাজারে টাকা খাটানো, পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা কিংবা বাঞ্জি জাম্প দেওয়া। আমরা সাধারণত ঝুঁকি বলতে শারীরিক বিপদ বা টাকাপয়সা হারানোর ভয়কেই বুঝি।

কিন্তু সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি এমন এক গবেষণা প্রকাশ করেছেন, যা আমাদের এই ধারণা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, আধুনিক মানুষের কাছে বাঘের সামনে পড়া বা প্যারাশুট নিয়ে লাফ দেওয়া সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নয়। তাদের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম, চাকরি ছাড়া বা নতুন চাকরিতে জয়েন করা!

আরও পড়ুন

বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছেন, এসি রুমে বসে চাকরি বদলানো আবার ঝুঁকি হয় নাকি? চলুন, বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি থেকে ঘুরে এসে দেখি গবেষকরা আসলে কী পেয়েছেন।

রেনাতো ফ্রে এবং অলিভিয়া ফিশার জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মনোবিজ্ঞানী। তাঁরা দুজন মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁরা খেয়াল করলেন, এতদিন ঝুঁকি নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, সেগুলো ছিল টপ-ডাউন পদ্ধতির। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা ল্যাবে বসে ঠিক করতেন কোনটা ঝুঁকি, আর মানুষকে সেটার ওপর প্রশ্ন করতেন। সেই ১৯৮০ সালের পুরনো ধারণার ওপর ভিত্তি করে হতো গবেষণা।

কিন্তু ফ্রে এবং ফিশার ভাবলেন, যুগ তো বদলেছে! এখন আমাদের জীবনে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া বা উন্নত প্রযুক্তি। আশির দশকের ঝুঁকির সংজ্ঞার সঙ্গে এখনকার মিল থাকবে কেন?

গবেষণায় উঠে এসেছে ১০০টি ঝুঁকির তালিকা। আর সেই তালিকার একেবারে শীর্ষে রয়েছে চাকরি ছাড়া এবং নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টা।

তাই তাঁরা উল্টো পথে হাঁটলেন। সরাসরি মানুষের কাছে গেলেন। প্রায় ৪ হাজার ৩৮০ জন মানুষের ওপর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা চালালেন। সাধারণ মানুষকে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা আসলে কোন জিনিসটাকে রিস্ক মনে করেন?’

গবেষণার ফলাফল যখন এল, তখন দেখা গেল এক অদ্ভুত চিত্র। মানুষ সাধারণত স্বাস্থ্য বা বিনোদন নিয়ে ঝুঁকি নিতে যতটা ভয় পায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয় পায় নিজের পেশা বা ক্যারিয়ার নিয়ে।

গবেষণায় উঠে এসেছে ১০০টি ঝুঁকির তালিকা। আর সেই তালিকার একেবারে শীর্ষে রয়েছে চাকরি ছাড়া এবং নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টা।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় তিনজনের মধ্যে একজন মানুষ মনে করেন, পেশাগত সিদ্ধান্ত নেওয়াই জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য বা শারীরিক ঝুঁকির কথা বলেছেন মাত্র ১৮ শতাংশ মানুষ।

সবাই বাঞ্জি জাম্প দিতে সাহস পায় না
মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

ভাবুন একবার! আমরা মনে করি মানুষ বোধহয় অসুখ-বিসুখ বা এক্সিডেন্ট নিয়ে বেশি চিন্তিত। কিন্তু ডেটা বলছে, মানুষ তার হাড় ভাঙার চেয়েও বেশি ভয় পায় মাস শেষের বেতনটা না পাওয়ার বা নতুন বসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অনিশ্চয়তাকে।

এই গবেষণায় আরও কিছু মজার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বয়স এবং লিঙ্গ ভেদে ঝুঁকির ধারণা বদলে যায়।

কম বয়সী তরুণ-তরুণীরা মনে করেন, হাতে কোনো নতুন অফার না থাকা অবস্থায় ধুম করে চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা বিশাল ঝুঁকি। অন্যদিকে বয়স্করা মনে করেন, আগের সেটলড চাকরি ছেড়ে নতুন কোনো পজিশনে যাওয়াটা বেশি ঝুঁকির। কারণ, তারা স্থিতিশীলতা বা স্টেবিলিটি পছন্দ করেন।

এখানে কিছু অদ্ভুত তথ্য মিলেছে। দেখা গেছে, ৩০-৪০ বছর বয়সী পুরুষেরা অস্ত্রোপচার করাকে নারীদের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। আবার ফাইভ-জি প্রযুক্তি গ্রহণ করাকে নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক পুরুষ ঝুঁকিপূর্ণ বলে রায় দিয়েছেন! কেন পুরুষেরা ফাইভ-জি নিয়ে এত চিন্তিত, সেটা অবশ্য আরেক গবেষণার বিষয় হতে পারে!

এই গবেষণাটি আমাদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। আধুনিক যুগে ঝুঁকি মানে শুধু প্রাণহানি নয়, ঝুঁকি মানে মানসিক চাপও।

তবে এই গবেষণার একটা ‘কিন্তু’ আছে। গবেষকেরা নিজেরাই সাবধান করে দিয়েছেন যে, এই ফলাফল অন্ধভাবে সব দেশের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কারণ, গবেষণাটি করা হয়েছে সুইজারল্যান্ডে।

সুইজারল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম ধনী এবং নিরাপদ দেশ। সেখানে রাস্তায় বের হলে ছিনতাই হওয়ার ভয় নেই, চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়ার ভয় নেই। তাই সেখানকার মানুষের কাছে চাকরি বদলানোই সবচেয়ে বড় টেনশন হতে পারে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে, যেখানে বন্দুক হামলা নিত্যদিনের ঘটনা বা চিকিৎসার খরচ আকাশচুম্বী, সেখানে হয়তো বেঁচে থাকাটাই বড় ঝুঁকি। কিংবা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে হয়তো রাস্তা পার হওয়া বা বাসে চড়াটাও একটা বড় ঝুঁকি।

তবুও এই গবেষণাটি আমাদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। আধুনিক যুগে ঝুঁকি মানে শুধু প্রাণহানি নয়, ঝুঁকি মানে মানসিক চাপও।

আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে অনিশ্চয়তা আমাদের নিত্যসঙ্গী। আর সেই অনিশ্চয়তার বাজারে দাঁড়িয়ে বাঞ্জি জাম্পিংয়ের চেয়েও অফিসের নতুন নিয়োগপত্রটা আমাদের হৃদস্পন্দন অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়!

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স