স্ট্রিং থিওরির প্রথম পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণের দাবি, উন্মোচিত হতে পারে ডার্ক এনার্জির রহস্য

সম্প্রতি আরজিভে (arXiv) প্রকাশিত এক প্রিপ্রিন্ট গবেষণাপত্র বেশ সাড়া ফেলেছে। এ গবেষণাপত্রে একদল পদার্থবিদ দাবি করেছেন, তাঁদের মডেল অনুসারে স্ট্রিং তত্ত্বের প্রথম পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। তাঁদের দাবি, এ প্রমাণের হাত ধরে মিলতে পারে বহুল প্রতীক্ষিত ডার্ক এনার্জির ব্যাখ্যাও।

গবেষণাপত্রটির নেপথ্যে রয়েছেন পাঁচ বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেকের পদার্থবিদ সাং-হো হুর, জর্জে মিনিক এবং তাতসু টেকুচি, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটারসর‍্যান্ডের ম্যান্ডেলস্ট্যাম ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিকসের বিষ্ণু জেজ্জালা এবং দ্য স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট ওল্ড ওয়েস্টবারির অধ্যাপক মাইকেল কোইভিস্তো।           

আরও পড়ুন

এডুইন হাবলের গবেষণার মাধ্যমে প্রথম জানা যায়, মহাবিশ্ব আজও প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের হাত ধরে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, এই প্রসারণের জন্য দায়ী এক অজানা বল। এরই নাম দেওয়া হয় ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি। অর্থাৎ রহস্যময় এক অজানা শক্তি।

এডউইন হাবল
নাসা

এই বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা এবং হিসাব-নিকাশ বলছে, একদম ক্ষুদ্রতম পর্যায়ে স্থান-কাল আমাদের পরিচিত মসৃণ ও অবিচ্ছিন্ন রূপের বদলে গভীর কোয়ান্টাম ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য দেখায়। তাঁদের গবেষণা অনুসারে, স্থান-কালের স্থানাঙ্কগুলো ‘বিনিময়যোগ্য’ নয় (Non-commutative)—অর্থাৎ, গাণিতিক সমীকরণে এদের ক্রম পরিবর্তন করলে তার ফলাফলও বদলে যায়। এই ধর্ম অনেকটা কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুসারে কণার অবস্থান ও বেগের আচরণের মতো।

ওদিকে স্ট্রিং থিওরির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, কোয়ান্টাম স্থান-কালের এই অদ্ভুত আচরণের একটি স্বাভাবিক পরিণতি হলো মহাজাগতিক ত্বরণ। শুধু তাই নয়, গবেষকরা আরও দেখেছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ত্বরণের হার যেভাবে কমছে, তার সঙ্গে ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্ট (DESI) থেকে পাওয়া সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ প্রায় হুবহু মিলে যায়। তবে এটি এখনও প্রাথমিক ফলাফল।

এ গবেষণাপত্রের সহ-লেখক অধ্যাপক মাইকেল কোইভিস্তো এক ই-মেইলে লাইভ সায়েন্সকে বলেন, ‘আমাদের কাজের “লেন্স”-এর মধ্য দিয়ে ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্টের ফলাফলের দিকে তাকালে, এটাকে স্ট্রিং থিওরি সমর্থনকারী প্রথম পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ বলা যায়। (তবে বিষয়টা আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।) সেই সঙ্গে এটাকে হয়তো স্ট্রিং থিওরি এবং কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির প্রথম পর্যবেক্ষণযোগ্য পরিণতি হিসাবেও ভাবতে পারেন।’

আরও পড়ুন

মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সেই পুরোনো রহস্য

১৯৯৮ সালে দুটি স্বাধীন গবেষক দল—সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্ট এবং হাই-জেড সুপারনোভা সার্চ টিম—আবিষ্কার করে, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি কমছে না, বরং সময়ের সঙ্গে আরও বাড়ছে। দূরবর্তী সুপারনোভা বা নক্ষত্রের বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে আসেন, কারণ সেগুলো প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল। মহাবিশ্বের এই ত্বরিত সম্প্রসারণ এক রহস্যময় শক্তির উপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে। এরই নাম দেওয়া হয় ডার্ক এনার্জি।

এই ডার্ক এনার্জি কী হতে পারে? আলবার্ট আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের সমীকরণে একটি ধ্রুবক আছে, ল্যামডা (Λ)। আইনস্টাইন এটিকে প্রতিমহাকর্ষ, অর্থাৎ মহাকর্ষের বিপরীত বল হিসেবে সমীকরণে স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর প্রাথমিক বিশ্বাস ছিল, মহাবিশ্ব স্থিতিশীল—জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি একই রকম আছে। প্রসারিত বা সংকুচিত হচ্ছে না। পরে হাবলের আবিষ্কারের মাধ্যমে তাঁর ভুল ভাঙে। এর পরে, কালের আবর্তে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা এই ল্যামডা দিয়েই ডার্ক এনার্জিকে প্রকাশ করতে থাকেন। এর ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে বিগ ব্যাং তত্ত্ব বা ল্যামডা-সিডিএম মডেল। বর্তমানে এটিই মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।

আলবার্ট আইনস্টাইন

এই মডেলে বেশ কিছু সমস্যা আছে। এর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো, এই ডার্ক এনার্জির উৎস কী, তা আজও অজানা। মোটামুটি জনপ্রিয় একটি হাইপোথিসিস বলে, ডার্ক এনার্জির জন্ম হয় শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়ামের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বা কণাদের স্বতঃস্ফূর্ত উত্থান-পতনের কারণে। এটা অনেকটা তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রের আচরণের মতো। সমস্যা হলো, বিজ্ঞানীরা যখন এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার গণনা করতে গেলেন, তখন যে সংখ্যা পেলেন তা বাস্তবতার চেয়ে প্রায় 10120 গুণ বেশি। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অমিলগুলোর একটি এটি।

সম্প্রতি ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্ট বা ডেসির পর্যবেক্ষণ এই রহস্যকে আরও ঘনীভূত করেছে। পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী, ডার্ক এনার্জি যদি শূন্যস্থানের শক্তি হয়, তবে সময়ের সঙ্গে এর ঘনত্ব স্থির থাকার কথা। কিন্তু ডেসির তথ্য বলছে, এই ত্বরণের হার স্থির নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কমছে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এ রহস্যের কোনো ব্যাখ্যা নেই।

আরও পড়ুন
চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ধারণা থেকে সরে এসে এই নতুন মডেল তাঁদেরকে শুধু পরীক্ষামূলক তথ্যের ওপর নির্ভর না করে, বরং একটি মৌলিক তত্ত্ব থেকে সরাসরি ডার্ক এনার্জির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে সাহায্য করেছে।

স্ট্রিং থিওরির হাত ধরে সমাধানের পথে

এসব অসামঞ্জস্য দূর করতে গবেষকেরা স্ট্রিং থিওরির শরণাপন্ন হয়েছেন। এটি কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তত্ত্বগুলোর একটি। স্ট্যান্ডার্ড মডেল যেখানে মৌলিক কণাগুলোকে বিন্দুর মতো কল্পনা করে, সেখানে স্ট্রিং থিওরি বলে, এগুলো আসলে ক্ষুদ্র, কম্পনরত একধরনের একমাত্রিক তন্তু বা স্ট্রিং। অর্থাৎ স্ট্রিংয়ের বিভিন্ন ধরনের কম্পনই আসলে বিভিন্ন ধরনের উপপারমাণবিক কণা। স্ট্রিংগুলো কীভাবে কাঁপছে, তার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের কণার জন্ম হয়।

স্ট্রিং থিওরি যেসব কণার ভবিষ্যদ্বাণী করে, এর একটি হলো গ্র্যাভিটন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি মহাকর্ষের কোয়ান্টাম কণা বা বাহক। আরজিভ প্রিপ্রিন্ট ডাটাবেসে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম পর্যায়ে স্থান-কালকে বিশ্লেষণ করার জন্য স্ট্রিং থিওরি প্রয়োগ করেছেন। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পরিবর্তে স্ট্রিং থিওরির কাঠামো ব্যবহার করে তাঁরা দেখান, স্থান-কাল নিজেই কোয়ান্টাম এবং নন-কমিউটেটিভ, অর্থাৎ এর স্থানাঙ্কগুলোর ক্রম গণনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ধারণা থেকে সরে এসে এই নতুন মডেল তাঁদেরকে শুধু পরীক্ষামূলক তথ্যের ওপর নির্ভর না করে, বরং একটি মৌলিক তত্ত্ব থেকে সরাসরি ডার্ক এনার্জির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে সাহায্য করেছে। তাঁদের মডেল কেবল ডার্ক এনার্জির ঘনত্বের সঠিক মানই দেয়নি, পাশাপাশি ডেসির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিল রেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শক্তির পরিমাণ কমবে।

এই গবেষণার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হলো, ডার্ক এনার্জির মান নির্ভর করছে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাপের ওপর: একটি প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য (1.6×10−33 সেন্টিমিটার)—এটি কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির ক্ষুদ্রতম একক; অন্যটি হলো আমাদের মহাবিশ্বের আকার। মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম এবং বৃহত্তম স্কেলের মধ্যে এ সেতুবন্ধন পদার্থবিজ্ঞানে অত্যন্ত বিরল। এটি ইঙ্গিত করে, ডার্ক এনার্জির রহস্য হয়তো স্থান-কালের কোয়ান্টাম প্রকৃতির সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িত। (প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য নিয়ে আরও জানতে বিস্তারিত পড়ুন: প্ল্যাঙ্ক স্কেলের রহস্য: যেখানে সবকিছু ভেঙে পড়ে)

কোইভিস্তোর ভাষ্যে, ‘এটি কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি এবং প্রকৃতির সেসব পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এক গভীর সংযোগের ইঙ্গিত দেয়, যেগুলোকে আমরা এতদিন ধ্রুবক বলে মনে করতাম। হতে পারে “মহাবিশ্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো স্থির বা ধ্রুব”—এটা আমাদের একটা ভুল ধারণা। বাস্তবে বিষয়টা হয়তো এমন নয়।’

আরও পড়ুন
তবে পরীক্ষামূলক প্রমাণের জন্য গবেষকরা বসে নেই। তাঁরা কোয়ান্টাম স্থান-কাল সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান আরও ঝালিয়ে নিচ্ছেন।

ভবিষ্যৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সম্ভাবনা

মহাবিশ্বের ত্বরিত সম্প্রসারণের এই ব্যাখ্যা তাত্ত্বিকভাবে যুগান্তকারী হলেও এই মডেল প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন স্বাধীন পরীক্ষামূলক প্রমাণ। এই গবেষণাপত্রের গবেষকেরা তাঁদের এ তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রস্তাবও করেছেন।

ভার্জিনিয়া টেকের পদার্থবিদ জর্জে মিনিক বলেন, ‘এরকম একধরনের প্রমাণ হতে পারে কোয়ান্টাম ইন্টারফিয়ারেন্স প্যাটার্ন শনাক্ত করা। স্ট্যান্ডার্ড কোয়ান্টাম ফিজিকসে এটা সম্ভব নয়, কিন্তু কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্ব সত্যি হলে এ ধরনের ইন্টারফিয়ারেন্স (ব্যতিচার) প্যাটার্ন ঘটা উচিৎ (অর্থাৎ, শনাক্ত করতে পার উচিৎ)।’

যখন একাধিক তরঙ্গ (যেমন আলো) একে অপরের ওপর এসে পড়ে, তখন তারা মিলিত হয়ে আরও শক্তিশালী বা দুর্বল হয়ে যায়। এই ঘটনাকেই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ব্যতিচার। এর ফলেই তৈরি হয় ইন্টারফারেন্স প্যাটার্ন বা ব্যতিচার নকশা। সাধারণ কোয়ান্টাম মেকানিকসে এর নিয়মগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কিছু কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি মডেল আরও জটিল, উচ্চ-স্তরের ইন্টারফিয়ারেন্সের ভবিষ্যদ্বাণী করে। পরীক্ষাগারে এ ধরনের প্রভাব শনাক্ত করা সম্ভব হলে তা হবে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির যুগান্তকারী প্রমাণ। মিনিকের মতে, ‘এসব পরীক্ষা অদূর ভবিষ্যতে—তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই—সহজেই করে দেখা যাবে।’

তবে পরীক্ষামূলক প্রমাণের জন্য গবেষকরা বসে নেই। তাঁরা কোয়ান্টাম স্থান-কাল সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান আরও ঝালিয়ে নিচ্ছেন। নিজেদের তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য খুঁজে ফিরছেন নতুন নতুন উপায়। কারণ, বৈজ্ঞানিক সত্যের একমাত্র বিচারক পরীক্ষা। এত সব তত্ত্ব, মডেল বা রোমাঞ্চকর ভাবনা পরীক্ষায় ফেল করলে কোনো কাজেই লাগবে না।

কিন্তু এই গবেষণা যদি সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, তবে এটি কেবল ডার্ক এনার্জির রহস্যই উন্মোচন করবে না, বরং মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের বহু আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য—স্ট্রিং থিওরির—প্রথম বাস্তব প্রমাণও তুলে ধরবে আমাদের সামনে। বিজ্ঞানীদের পরম আকাঙ্ক্ষিত সবকিছুর তত্ত্বের দিকে এটি হবে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

প্রিপ্রিন্ট পেপার লিংক: https://arxiv.org/pdf/2503.20854