যদি বলি, বিগ ব্যাংয়ের পর পর ঠিক কী হয়েছে, সে সবই আমরা শুধু তত্ত্বীয়ভাবে জানি, বিশ্বাস করবেন? যদি বলি, সেখানে আমাদের তাকানো নিষেধ, এ যেন এক মহাজাগতিক দুর্ভেদ্য দেয়াল—মানতে চাইবেন সে কথা?
প্রশ্নটা আরেকটু স্পষ্টভাবে করি। দূর অতীতে, মহাবিশ্বের সূচনার পর পর—সেই শুরুতে ঠিক কী হয়েছিল? উত্তর: কেউ জানে না।
বিজ্ঞানীরা যখন টেলিস্কোপে চোখ রেখে তাকান, বহু দূর অতীত দেখতে পান তাঁরা। জেমস ওয়েব নভোদুরবিন খুঁজে চলেছে মহাবিশ্বের প্রথম আলো। বিগ ব্যাংয়ের অবশেষ হিসেবে মহাবিশ্বের প্রথম আলোর ম্লান চিহ্ন বা ছাপ চারপাশে সবখানে দেখতে পাই আমরা। এই ছাপের নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা সিএমবি। এই ছাপ, মহাবিশ্বের প্রথম আলো কিংবা আমাদের তত্ত্বীয় দৃষ্টিসীমা—সবকিছু একটা পর্যায়ে গিয়ে থমকে যায়। এ যেন এক রহস্যময় পর্দা, যে পর্দার ওপারে তাকানো নিষেধ।
কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যায় একটা সূত্র প্রণয়ন করেন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম ভিন। ভিনের সূত্রটি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে গেল। কিন্তু দেখা গেল, দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের ব্যাখ্যায় সূত্রটি কাজ করছে না।
এই পর্দার ওপারের জগৎটিই প্ল্যাঙ্ক স্কেলের জগৎ। যেখানে একসঙ্গে মিলেমিশে যায় আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। একসঙ্গে একীভূতভাবে থাকে মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বল। মহাবিশ্বের সূচনা, কোয়ার্ক-লেপটনের মতো মৌলিক কণা মিলে মিলে প্রথম হাইড্রোজেন বা মৌলিক পদার্থের সৃষ্টি—এই সবকিছু হয়েছে এই পর্দার ওপারে। যা এই বিশ্বের কেউ দেখেনি। কোনো যন্ত্র দিয়ে তা দেখা সম্ভব নয়।
কেন? চলুন, প্ল্যাঙ্ক স্কেলের রহস্যময় জগতে কল্পরথে চড়ে উঁকি দেওয়া যাক।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম বিপ্লব ও প্ল্যাঙ্ক স্কেলের ধারণার সূচনা
১৮৯০-এর দশক। বিজ্ঞান তখন ভরা যৌবনে। পদার্থবিদেরা মনে করতেন, মহাবিশ্বের সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে বললেই চলে। শুধু কিছু ‘ছোটখাটো’ সমস্যার সমাধান বাকি আছে।
এরকমই একটি ‘ছোটখাটো’ সমস্যা ছিল ‘ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন’। অর্থাৎ কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ। সমস্যাটা কী? অতি সরলীকরণ করে, সংক্ষেপে বলা যায়, উত্তপ্ত বস্তু কীভাবে আলো বিকিরণ করে, সেটা বুঝতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা। এ সমস্যার সূত্র ধরেই দেখা দেয় ‘অতিবেগুনি বিপর্যয়’।
গল্পের পেছনেও গল্প থাকে। তেমনি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের এ গল্পের পেছনে আছে উইলহেম ভিনের ডিসপ্লেসমেন্ট ল, র্যালে-জিন্সের সূত্রসহ আরও অনেক কিছু। আমরা সেই কাহিনিতে যাব না। শুধু সমস্যাটার কথা সংক্ষেপে বলা যাক।
কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যায় একটা সূত্র প্রণয়ন করেন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম ভিন। ভিনের সূত্রটি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে গেল। কিন্তু দেখা গেল, দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের ব্যাখ্যায় সূত্রটি কাজ করছে না। ভুল ফলাফল দিচ্ছে। এরপর দীর্ঘ তরঙ্গের বিকিরণের ব্যাখ্যায় ব্রিটিশ পদার্থবিদ লর্ড র্যালে এবং স্যার জেমস জিন্স আরেকটি সূত্র দিলেন। এটিই র্যালে-জিন্সের সূত্র। এই সূত্র বলে, উত্তপ্ত বস্ত থেকে নিঃসৃত বিকিরণের তীব্রতা সরাসরি তার পরম তাপমাত্রার সমানুপাতিক এবং বিকীর্ণ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।
বিজ্ঞানীরা যখন টেলিস্কোপে চোখ রেখে তাকান, বহু দূর অতীত দেখতে পান তাঁরা। জেমস ওয়েব নভোদুরবিন খুঁজে চলেছে মহাবিশ্বের প্রথম আলো। বিগ ব্যাংয়ের অবশেষ হিসেবে মহাবিশ্বের প্রথম আলোর ম্লান চিহ্ন বা ছাপ চারপাশে সবখানে দেখতে পাই আমরা।
এই সূত্র থেকেই সেই অতিবেগুনি বিপর্যয়ের সূচনা। দেখা গেল, যত ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দিকে যাওয়া হচ্ছে, এ সূত্রানুসারে বিকিরণের তীব্রতা তত অসীমের দিকে যেতে থাকে। অর্থাৎ, তাত্ত্বিক হিসাব অনুযায়ী, উত্তপ্ত কৃষ্ণবস্তু থেকে এক সময় অসীম শক্তি নির্গত হওয়ার কথা। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, এটা হতে পারে না। আবুল বাসার যথাযথ উপমা দিয়ে লিখেছেন, সে ক্ষেত্রে মহাবিশ্ব অনেক আগেই বিশাল এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হতো।
এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ভাবলেন, আলোকে যদি ধারাবাহিক ‘রশ্মি’ না ভেবে ছোট ছোট খণ্ড বা প্যাকেটের সমষ্টি বলে ভাবা যায়, তাহলে এই সমস্যার সমাধান মেলে। এই ছোট ছোট প্যাকেটগুলোকেই তিনি বললেন কোয়ান্টা। এই কোয়ান্টা নির্ধারণের জন্য তিনি একটা নতুন ধ্রুবক নিয়ে এলেন—এটাকেই আজ আমরা বলি প্ল্যাঙ্ক কনস্ট্যান্ট বা প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক (h)।
তিনি দেখালেন, নির্গত শক্তির হিসাব এভাবে করা যায়, 𝐸= ℎ × 𝑓। এখানে E হলো শক্তি, h প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক, আর f আলোর কম্পাংক।
এই ধারণার মাধ্যমে তিনি ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন সমস্যার দারুণ এক সমাধান দিলেন—আর ঘটনাচক্রে গোটা বিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে গেল। সূচনা হলো কোয়ান্টাম তত্ত্বের।
***
প্ল্যাঙ্ক যখন দেখলেন, আলো নির্দিষ্ট কোয়ান্টায় নির্গত হয়, তখন তাঁর মনে হলো, মহাবিশ্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোও হয়তো এরকম কিছু নির্দিষ্ট সীমা বা একক ‘প্যাকেট’ দিয়ে গড়া। অর্থাৎ এটিই মহাবিশ্বের সর্বনিম্ন সীমা। আজ আমরা একেই বলি প্ল্যাঙ্ক সীমা।
প্ল্যাঙ্ক প্রকৃতির মৌলিক ধ্রুবকগুলো, যেমন আলোর গতি c, মহাকর্ষ ধ্রুবক G, প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক h ইত্যাদি সমন্বয় করে বিশেষ একধরনের একক বানাতে চাইলেন। এভাবে তিনি প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য, প্ল্যাঙ্ক সময়, প্ল্যাঙ্ক ভর ও প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রার সন্ধান পান। এই সবকটিই প্রকৃতির মৌলিক ধ্রুবকে গড়া একক, মানবসৃষ্ট একক নয়। প্ল্যাক নিজে ভাবেননি যে এর কোনো নিগূঢ় অর্থ থাকতে পারে, কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও আপেক্ষিকতার হাত ধরে বোঝা গেল, এগুলোই মহাবিশ্বের সর্বনিম্ন সীমা। প্রাকৃতিক সীমা।
মহাবিশ্বের সূচনার পর পর, মহাবিশ্বের দৈর্ঘ্য যখন ছিল ০ থেকে ১০-৩৫ মিটারের মধ্যে, ০ থেকে ১০-৪৩ সেকেন্ডের মধ্যকার এ সময়টুকুকে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক যুগ।
এখানেই আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের মূল কাঠামো ভেঙে পড়ে।
মহাবিশ্বের গঠন-কাঠামো-উপাদান
বিগ ব্যাংয়ের পর পর মহাবিশ্ব দ্রুত বড় হচ্ছিল, প্রসারিত হচ্ছিল। এ সময় মহাবিশ্ব ছিল অত্যন্ত উচ্চ শক্তির, ঘনভাবে মিলেমিশে থাকা আল্ট্রা-রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টায় ভরপুর। অর্থাৎ শক্তি ও কণা মিলে মিশে একধরনের স্যুপের মতো অবস্থা। ধীরে ধীরে সেখানে মৌলিক কণাগুলো একীভূত হয়ে মৌলিক পদার্থ তৈরি করে। কালের আবর্তে এসব পদার্থই গড়ে তোলে আজকের গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি বা গ্যালাক্সিপুঞ্জের মতো বড় কাঠামো।
এই মৌলিক কণাগুলো কেমন? তার একটা ধারণা পাওয়া যায় পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের দিকে তাকালে (ছবি দেখুন)। এই তালিকায় আছে বারো ধরনের বস্তু কণা—ছয় ধরনের কোয়ার্ক এবং ছয় ধরনের লেপটন; চার ধরনের বলের কণা এবং হিগস বোসন। এই যে কণারা—এগুলো আসলে চারটি মৌলিক বলের মাধ্যমে যুক্ত হয়, মিথস্ক্রিয়া করে—বিভিন্ন কাঠামো গড়ে তোলে। এই মৌলিক বলগুলোর কথা হয়তো জানেন—মহাকর্ষ, তড়িৎ-চুম্বক বল এবং শক্তিশালী ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে যে বলের কণাগুলো আছে, এগুলো আসলে বলের বাহক কণা। তড়িৎ-চুম্বক বলের বাহক ফোটন, গ্লুয়ন কাজ করে শক্তিশালী বলের কণা হিসেবে। আর দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের বাহক ডব্লিউ এবং জেড বোসন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাকর্ষের একটি কণা রয়েছে—গ্র্যাভিটন। তবে এই কণার আজ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি।
এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ভাবলেন, আলোকে যদি ধারাবাহিক ‘রশ্মি’ না ভেবে ছোট ছোট খণ্ড বা প্যাকেটের সমষ্টি বলে ভাবা যায়, তাহলে এই সমস্যার সমাধান মেলে। এই ছোট ছোট প্যাকেটগুলোকেই তিনি বললেন কোয়ান্টা।
বিজ্ঞানীদের সব চেষ্টার মোদ্দা কথা হলো, মহাবিশ্বের সূচনাকালে এই চারটি বল যেমন একসঙ্গে ছিল, তত্ত্বের মাধ্যমে এগুলোকে সেরকম একীভূত করা। অর্থাৎ এমন একটি গাণিতিক কাঠামো, যার মাধ্যমে এই চারটি বলকে একটি বলের বিভিন্ন রূপ হিসেবে দেখানো যায়। এ পর্যন্ত শুধু দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং তড়িৎ-চুম্বক বলকে একীভূত করা গেছে, তাত্ত্বিকভাবে শক্তিশালী বলকেও একীভূত করার উপায় পাওয়া গেছে, তবে মহাকর্ষকে বাকি তিনটি বলের সঙ্গে একীভূত করার কোনো গাণিতিক উপায়ও পাওয়া যায়নি। কেন, সেটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
আমরা যে বস্তুগুলোকে চোখে দেখি বা যেগুলো দিয়ে কিছু করি—বড় পরিসরের এই বস্তুগুলোর আচরণ ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। আবার প্রোটন-নিউট্রনের মতো উপপারমাণবিক কণাদের আচরণ ব্যাখ্যা করে কোয়ান্টাম তত্ত্ব।
আমরা জানি, আলো একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ। কিন্তু একটা তরঙ্গের দৈর্ঘ্য কতটা ছোট হলে তার আর কোনো ভৌত বা সত্যিকার অর্থ থাকে না, অর্থাৎ বিষয়টা আর একদমই বোঝার মতো অবস্থায় থাকে না, তার একটা সর্বনিম্ন সীমা আছে। এই সীমাটিই প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য: প্রায় ১০-৩৫ মিটার। এই সীমার পরে, অর্থাৎ এরচেয়ে ছোট পরিসরে—আমাদের যদিও কোনো গাণিতিক কাঠামো বা তত্ত্ব নেই, তবু সব হিসাব বলছে—মহাকর্ষ নিজেই কোয়ান্টাম আচরণ করতে শুরু করে। এ সময় তত্ত্বীয়ভাবে স্থান-কাল আর নিরবচ্ছিন্ন থাকে না—বলা ভালো, থাকার কথা নয়—বরং একধরনের অস্থির, দোলায়মান ‘কোয়ান্টাম বিন্দু’ বা ‘কোয়ান্টাম ফেনা’র মতো আচরণ করে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যার জন্য নতুন একধরনের তত্ত্ব প্রয়োজন। মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি। আগেই বলেছি, এমন কোনো তত্ত্ব বা গাণিতিক কাঠামো বিজ্ঞানীরা আজও খুঁজে পাননি।
প্ল্যাঙ্ক শক্তি ও প্ল্যাঙ্ক সময়
প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের কথা তো বললাম, এবারে প্ল্যাঙ্ক শক্তি ও সময়ের কথা বলা যাক। প্ল্যাঙ্ক শক্তির মান প্রায় ১০১৯ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট। এটা আসলে কত উচ্চ শক্তি?
মহাবিশ্বের বিভিন্ন দিকে, এমনকি সূর্য থেকেই একধরনের অত্যুচ্চ শক্তির কণা পৃথিবীর ওপর হামলা করে। হয়তো জানেন, এগুলোকে বলা হয় মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে। এর শক্তির মান ১০১২ গিগা ইলেকট্রন ভোল্টের সমান।
আর প্ল্যাঙ্ক সময়? ১০-৪৩ সেকেন্ড। এই অতি ক্ষুদ্র সময়ের গুরুত্ব কী?
কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে, বস্তু যখন অনেক ছোট হয়—যেমন উপপারমাণবিক কণারা—তখন এগুলোর ভরবেগ ও অবস্থানের মধ্যে একধরনের ‘অনিশ্চয়তামূলক’ সম্পর্ক দেখা যায়। সহজ করে বললে, এগুলোর ভরবেগ জানলে অবস্থান নিশ্চিত করে জানা যায় না। আবার অবস্থান নিশ্চিতভাবে জানলে ভরবেগ নিশ্চিত করে জানা যায় না। এই হলো আমাদের জানাশোনা ক্ষুদ্র পরিসরের অবস্থা। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক সময়ের চেয়েও ক্ষুদ্র পরিসরে সাধারণ শক্তি তথা এনার্জি ফ্ল্যাকচুয়েশনই একটা কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করতে পারে।
বিজ্ঞানীদের সব চেষ্টার মোদ্দা কথা হলো, মহাবিশ্বের সূচনাকালে এই চারটি বল যেমন একসঙ্গে ছিল, তত্ত্বের মাধ্যমে এগুলোকে সেরকম একীভূত করা। অর্থাৎ এমন একটি গাণিতিক কাঠামো, যার মাধ্যমে এই চারটি বলকে একটি বলের বিভিন্ন রূপ হিসেবে দেখানো যায়।
কৃষ্ণগহ্বর যে বাস্তব, তা আমরা জানি। এর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এত প্রবল যে গহ্বরের বাইরের সীমানা—ইভেন্ট হরাইজন তথা ঘটনা দিগন্ত পেরিয়ে কোনো কিছুই বেরোতে পারে না। এমনকি আলোও পেরোতে পারে না। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো তোলা কৃষ্ণগহ্বরের ছবি প্রকাশ করেছেন।
যাহোক, তত্ত্বীয় হিসাব বলছে, প্ল্যাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়ে স্থির থাকতে পারবে না। হকিং বিকিরণের মাধ্যমে সেই কৃষ্ণগহ্বর ক্ষয়ে যাবে। কৃষ্ণগহ্বরের ভর যত কম হবে, তা ক্ষয়ে যাবে তত দ্রুত। ‘কোয়ান্টাম ফেনা’র মতো অস্থির সেই মহাবিশ্ব অনিশ্চয়তাময়।
আমরা জানি, স্থান ও কাল আলাদা কিছু নয়। বরং মহাবিশ্বটা হলো স্থান-কালের সমষ্টিগত একটি রূপ। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে আলবার্ট আইনস্টাইন এটা দেখিয়েছেন। মহাবিশ্বের সূচনাকালে, যখন স্থান ছিল প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের চেয়েও ছোট, সময় ছিল প্ল্যাঙ্ক সময়ের চেয়েও কম—সেই সময়ের অনিশ্চিত কোয়ান্টাম-মহাকর্ষীয় মহাবিশ্বে ঠিক কী হয়েছিল?
যতদিন মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব পাওয়া না যাচ্ছে, ততদিন এর কোনো সত্যিকারের উত্তর আমরা পাব না।
পর্দার ওপারে
কিছুদিন আগে জেমস ওয়েব নভোদুরবিন আমাদের জানা সবচেয়ে প্রাচীন গ্যালাক্সির ছবি তুলেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে JADES-GS-z14-0। আমরা যদি আরও দূরে তাকাই, আরও আরও দূরে, তাহলে একসময় আমাদের দৃষ্টি মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণে গিয়ে থামবে। তার ওপাশে শুধু আলো আর আলো, নানারকম বিকিরণ। মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ যেন বিশাল কোনো পর্দায় ঢেকে দিয়েছে মহাবিশ্বের অতীতের সবটা। এই পর্দার ওপাশে আমাদের তাকানো নিষেধ। কোনো যন্ত্র দিয়ে তা দেখা সম্ভব নয়।
তাহলে বিজ্ঞানীরা কীভাবে জানলেন, কী হয়েছে পর্দার ওপারে? সহজ করে বললে, সার্নের মতো গবেষণাগারগুলোতে বিভিন্ন পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্রে এগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। তা ছাড়া এই পর্দার ওপাশ থেকে কিছু নিউট্রিনো কণা ছুটে আসে। সেগুলো থেকেও কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তবে, বলা বাহুল্য, গাণিতিক যুক্তি ও গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখে, তার সঙ্গে প্রকৃতির আচরণ মিলিয়ে নিয়েই বিজ্ঞানীরা জেনেছেন মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের ওপারের কথা।
কিন্তু গবেষণাগারে কতটা অতীতে যাওয়া যায়? আমরা যদি সময়ের উল্টোদিকে চলতে শুরু করি—ধরুন, এটা একটা মহাজাগতিক ভিডিও, উল্টো করে চালিয়ে দিলাম, বর্তমান থেকে ধীরে ধীরে ওটা বিগ ব্যাংয়ে গিয়ে শেষ হবে—মহাজাগতিক এ ভিডিওটাকে উল্টো করে চালিয়ে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি আমরা? ১০-১২ সেকেন্ড পর্যন্ত। এর আগের মহাবিশ্বে কী হয়েছে, তা আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি না। কাজেই, এর আগের সবকিছুই আসলে তাত্ত্বিক। বলা ভালো, হাইপোথেটিক্যাল। সম্ভাবনা।
এরকম একটি সম্ভাবনা হলো, ১০-৩৬ সেকেন্ড থেকে ১০-৩২ সেকেন্ড পর্যন্ত মহাবিশ্ব হঠাৎ অনেক দ্রুত অনেকখানি প্রসারিত হয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মতো মহাবিশ্বের এই প্রসারণও হয়েছে আচমকা। এই বেড়ে ওঠাকে বলা হয় ইনফ্লেশন। সত্যিই কি এমন কিছু হয়েছে? আমরা নিশ্চিত নই।
তত্ত্বীয় হিসাব বলছে, প্ল্যাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়ে স্থির থাকতে পারবে না। হকিং বিকিরণের মাধ্যমে সেই কৃষ্ণগহ্বর ক্ষয়ে যাবে। কৃষ্ণগহ্বরের ভর যত কম হবে, তা ক্ষয়ে যাবে তত দ্রুত।
কারণ, আরও আগেই, ১০-৪৩ সেকেন্ডে মহাজাগতিক উল্টো ভিডিওটি প্রবেশ করেছে প্ল্যাঙ্ক যুগে। যেমনটা বললাম, এই সময়ে গোটা মহাবিশ্বের সবকিছু এত অকল্পনীয় ক্ষুদ্র দূরত্ব ও ক্ষুদ্র সময়ে অবস্থান করে যে বিপাকেই পড়ে যান বিজ্ঞানীরা।
এই অনিশ্চয়তা ভরা ক্ষুদ্র জায়গাটুকু—যেখানে রয়েছে বিপুল ভর, অসীম ঘনত্ব, এমনই একটি মহাজাগতিক বস্তু রয়েছে আমাদের চিরচেনা। নাম তার ব্ল্যাকহোল। কৃষ্ণগহ্বর। এরকম অসীম ঘন, বিপুল ভারী, মহাবিশ্বের সব মিলেমিশে যেখানে একাকার হয়ে যায়, যেখানে মিশে থাকে চারটি মৌলিক বল একসঙ্গে, সেখানে এসে ভেঙে পড়ে পদার্থবিদ্যার জানা সব তত্ত্ব। মানে তখন আর পদার্থবিজ্ঞানের কোনো সূত্র বা তত্ত্ব কাজ করে না। এরকম যেকোনো বিন্দুসম ক্ষুদ্র জায়গাকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু।
মহাবিশ্বের শুরুটা তাহলে কেমন করে হয়েছিল? বিগ ব্যাং কি সত্যিই ঘটেছিল? আমরা জানি না। এর বেশ কিছু বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী। তবে সেগুলো পরীক্ষানিরীক্ষা ও গণিতের যুক্তিতে হালে পানি পায়নি সেভাবে। আমরা শুধু জানি, মহাবিশ্বের একটি সূচনা ছিল। জানি, বিগ ব্যাং এখন পর্যন্ত এর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ব্যাখ্যা। জানি, এর পরের ঘটনা প্রবাহকে সত্যিই বুঝতে আমাদের আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বকে একীভূত করতে হবে, যাকে বলা হয় সবকিছুর তত্ত্ব বা থিওরি এভরিথিং। সেদিন হয়তো আমরা প্ল্যাঙ্ক স্কেলের সীমার ওপারে তাকাতে পারব, দেখতে পাব শিশু মহাবিশ্বের সত্যিকার রূপ।
