প্ল্যাঙ্ক সময় কাকে বলে

একটা বস্তু ভাঙতে বা কাটতে শুরু করলে একটানা কতবার ভাঙা যাবে? চিরকাল, নাকি এর কি কোনো নির্দিষ্ট সীমা আছে? এককালে এর উত্তর খুঁজেছিল গ্রিসের একদল পণ্ডিত। অনেক ভেবেচিন্তে তারা উত্তর দিয়েছিল, এই ভাঙা বা কাটারও একটা সীমা আছে। তাদের অনুমান ছিল, ভাঙতে ভাঙতে একটা পর্যায়ে বস্তুটিকে আর ভাঙা যাবে না। সেটাই হবে ওই বস্তুটির ক্ষুদ্রতম একক, যেখানে বস্তুটির গুণাগুণ অক্ষুণ থাকে। গ্রিক ওই পণ্ডিতদল এর নাম দিয়েছিল অ্যাটম। ইংরেজিতে এর অর্থ দাঁড়ায় আনকাটেবল, অর্থাৎ যাকে আর ভাঙা বা কাটা যায় না—অবিভাজ্য। বাংলায় এখন আমরা একে বলি পরমাণু।

কিন্তু একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বস্তুকে কতবার কাটা যাবে? বস্তুটাকে সর্বোচ্চ কত ছোট খণ্ডে ভাগ করা যাবে? এ ব্যাপারে গ্রিকদের কাছে কোনো উত্তর ছিল না। তবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কাছে এর জবাব আছে। বিজ্ঞানীরা চুলচেরা হিসেব কষে দেখেছেন, কোনো বস্তুকে ১.৬×১০-৩৫ মিটারের চেয়ে ছোট করা যাবে না। ধরা যাক, আপনার কাছে ১.৬ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কাগজ আছে। কাগজটা প্রথমে সমান ১০ ভাগে ভাগ করে কেটে ফেলুন। এবার ওই ১০ টুকরো থেকে এক টুকরো নিয়ে তাকে আবারও সমান ১০ ভাগে ভাগ করুন। তারপর একই কাজ করে যেতে থাকুন। এভাবে ১.৬ দৈর্ঘ্যের কাগজটা ক্রমেই ছোট হতে থাকবে। কাগজের টুকরোগুলো মিলিমিটার, মাইক্রোমিটার, ন্যানোমিটার, পিকোমিটার, ফেমটোমিটার, অ্যাটোমিটার, জেপটোমিটার, ইয়োকটোমিটার…স্কেলে নেমে আসতে থাকবে।

টুকরো যত ছোট হবে, এক পর্যায়ে দেখা যাবে তা কাটার জন্য প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি পাওয়া তত কঠিন হবে। আবার এমন একটা পর্যায়ও আসবে, যখন কাগজের টুকরোগুলো আর খালি চোখেও দেখা যাবে না। তার জন্য হয়তো মাইক্রোস্কোপের দরকার হবে। আরও পরে সাধারণ মাইক্রোস্কোপে কাগজের টুকরোগুলো দেখা যাবে না। কিন্তু ধরা যাক, সেসব সমস্যা কোনো এক ভাবে মিটিয়ে ফেলা হলো। তাহলে এভাবে কতবার কাটতে পারবেন?

আরও পড়ুন

তাত্ত্বিকভাবে বিজ্ঞানীরা বলেন, এভাবে ৩৫ বারের বেশি কাটতে পারবেন না। মহাবিশ্বের কোনো শক্তি ব্যবহার করেও সেটা করা সম্ভব হবে না। ৩৫ বার কাটার পর কাগজের টুকরোগুলোর যে দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে সেটার একটা নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই দৈর্ঘ্যকে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য। জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামে এই দৈর্ঘ্যের নামকরণ করা হয়েছে। এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১.৬×১০-৩৫ মিটার। একে বলা হয় সম্ভাব্য সবচেয়ে ছোট দৈর্ঘ্য। প্রশ্ন আসতে পারে, প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের পরিমাণ আসলে কতটুকু?

একটা পরমাণুর সঙ্গে তুলনা করলে, হয়তো এই দৈর্ঘ্য সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করতে পারবেন। সাধারণত একটা পরমাণুর ব্যাস প্রায় ১০-১০ মিটার বা ১ অ্যাংট্রম। প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য তার চেয়েও ছোট—একটা পরমাণুর চেয়েও অনেক ছোট। এমনকি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা ক্ষুদ্র প্রোটন কণার চেয়েও। বিষয়টা হজম করার জন্য আরেকটা তুলনা দেওয়া যাক। প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যকে কোনোভাবে বড় করে যদি একটা পরমাণুর সমান বানানো সম্ভব হয়, তাহলে পরমাণুর ব্যাস কত দাঁড়াবে, জানেন? সেটা হবে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের সমান! আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বটা কত বড়, সেটা জানতে চাইলে গুগল করুন এক্ষুণি।

প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য নিয়ে এতসব কথা বলার আসল কারণ হলো প্ল্যাঙ্ক সময় বোঝার সুবিধার জন্য। ১৮৯৯ সালে ক্ষুদ্রতম এই সময়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক।

বিজ্ঞানীরা বলেন, এই দৈর্ঘ্য পরিসরে এসে আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কিছুই আর কাজ করে না। যেমন মহাকর্ষ, স্থান এবং কাল হয়ে ওঠে অর্থহীন। এখানে স্থান এতই অস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পদার্থবিদরা তখন একে বলেন কোয়ান্টাম ফেনা।

প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য নিয়ে এতসব কথা বলার আসল কারণ হলো প্ল্যাঙ্ক সময় বোঝার সুবিধার জন্য। ১৮৯৯ সালে ক্ষুদ্রতম এই সময়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। সে সময় একে স্রেফ একটা বৈজ্ঞানিক কৌতুহল মেটানোর জন্য প্ল্যাঙ্ক কাজটা করেছেন বলে মনে করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু মহাবিস্ফোরণ এবং থিওরি অব এভরিথিং তথা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বোঝার জন্য এই ক্ষুদ্র সময়কে এখন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাহলে প্ল্যাঙ্ক সময় কী?

আরও পড়ুন

একটা সেকেন্ডকে ছোট করতে থাকলে প্রথমে পাওয়া যাবে মিলিসেকেন্ড (১০-৩) , মাইক্রোসেকেন্ড (১০-৬), ন্যানোসেকেন্ড (১০-৯), পিকোসেকেন্ড (১০-১২), ফেমটোসেকেন্ড (১০-১৫), অ্যাটোসেকেন্ড (১০-১৮), জেপটোসেকেন্ড (১০-২১)… এভাবে সবশেষে পাওয়া যাবে সময়ের ক্ষুদ্রতম একক—প্ল্যাঙ্ক সময়। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, শূন্যস্থানে এই প্ল্যাঙ্ক দূরত্ব পার হতে আলোর যতটুকু সময় লাগে, সেটাই প্ল্যাঙ্ক সময়। এই দূরত্ব পার হতে আলোর কতটুকু সময় লাগে? মাত্র ৫.৩৯×১০-৪৪ সেকেন্ড। জি, এটাই প্ল্যাঙ্ক সময়।

একে বলা হয় ক্ষুদ্রতম অর্থবোধক সময়। মানে এটুকু সময় আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু তারপর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো উদ্ভট আচরণ করতে শুরু করে। সেজন্য বলা হয়, প্ল্যাঙ্ক সময়ের চেয়ে ছোট কোনো সময়কে বর্তমানে আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। আজ থেকে প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল একটা বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে। মহাবিস্ফোরণের শুরুর সময়, অর্থাৎ যখন সময়ের সূচনা (বা t= 0) হয়েছিল, তখন ঠিক কী ঘটেছিল, তার কিছুই বিজ্ঞানীরা জানেন না। কারণ প্ল্যাঙ্ক সময়ের আগের কিছু আর পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এই পর্যায়ে এসে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন, বিশেষ করে সাধারণ আপেক্ষিকতা ভেঙে পড়ে বা অকেজো হয়ে যায়।

সূত্র: ফিজিকস ওয়ার্ল্ড, লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া