ফোটন কী দিয়ে তৈরি

প্রতীকী ছবি

আলোর কণাকে বলা হয় ফোটন। ১৯০৫ সালে আলোর তড়িৎক্রিয়া বা ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের প্রণীত কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করেন আইনস্টাইন। ফলে আলোকে কণার গুচ্ছ হিসেবে ধরে নেন তিনই। আলোর কণা বোঝাতে আইনস্টাইন ব্যবহার করেন ‘কোয়ান্টা অব লাইট’ বাআলোর কোয়ান্ট শব্দগুচ্ছ। এর প্রায় দুই দশক পরে এর নাম দেওয়া হয় ফোটন। ১৯২৬ সালে এ নামটি দেন পদার্থবিদ ফ্রিথিওফ উলফার্স এবং রসায়নবিদ গিলবার্ট লুইস। পরে নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অন্য বিজ্ঞানীরা আলোর কণা বোঝাতে ফোটন শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন।

পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, ফোটন মৌলিক কণা। অর্থাৎ এরা অন্য কোনো ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত নয়। এদের আর কোনো ক্ষুদ্র এককে ভাঙা যায় না। আলোর ক্ষুদ্র এককই হলো ফোটন কণা। ফোটন গঠিত হয় শক্তি দিয়ে। এরা বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, যারা আলোর কণা বহন করে। এদের কোনো স্থির ভর নেই। চার্জও নেই। তবে ভরবেগ আছে।

এককালে আলো কণা, নাকি তরঙ্গ, তা নিয়ে তুমুল তর্কবির্তক হয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। এই বিতর্কে জড়িত ছিলেন স্বয়ং আইজ্যাক নিউটন থেকে শুরু করে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, আইনস্টাইনসহ আরও অনেক নামকরা বিজ্ঞানী।

ফোটন কণা অস্তিত্বে আসে বিদ্যুৎচুম্বকীয় কণা হিসেবে। এতে বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় উভয় ক্ষেত্রই থাকে। এই ক্ষেত্রটি পরস্পরের সমকোণে আলোর গতিতে স্পন্দিত হয়। কোনো ভর না থাকায় এরা আলোর গতিতে (২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার/সেকেন্ড) শূন্য স্থানের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। অন্য কোনো পদার্থ বা কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করা পর্যন্ত ফোটন স্থানের ভেতর দিয়ে আলোর গতিতে চলতে থাকে। এভাবেই এরা শক্তি স্থানান্তর করে। এক্স-রশ্মি, গামারশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি, বেতার তরঙ্গ এবং দৃশ্যমান আলোসহ অন্যান্য সব আলো ফোটন দিয়ে তৈরি। 

আরও পড়ুন

এককালে আলো কণা, নাকি তরঙ্গ, তা নিয়ে তুমুল তর্কবির্তক হয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। এই বিতর্কে জড়িত ছিলেন স্বয়ং আইজ্যাক নিউটন থেকে শুরু করে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, আইনস্টাইনসহ আরও অনেক নামকরা বিজ্ঞানী। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এই বিতর্কের অবসান করেছে। এখন আলোর দুটো ধর্মই সর্বজন স্বীকৃত। অর্থাৎ অন্যান্য অতিপারমাণবিক (সাব-অ্যাটমিক) কণার মতো ফোটনেরও তরঙ্গধর্মী ও কণাধর্মী দুই রকম আচরণই দেখা যায়। এদেরকে বর্ণনা করা হয় শক্তির গুচ্ছ (কণা) বা একটা নির্দিষ্ট কম্পাংক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ হিসেবে। এর সরল মানে হলো, এরা মাঝে মাঝে কণার মতো এবং মাঝে মাঝে তরঙ্গের মতো আচরণ করে। একে বলা হয় কণা/তরঙ্গ দ্বৈততা।

প্রতীকী ছবি

ফোটনকে ধ্বংস করা সম্ভব?

এর উত্তর হলো না। ফোটনকে ধ্বংস করা যায় না। এদের ধ্বংস করা করা যায় না, কারণ এ কণার কোনো ভর নেই। তবে এরা অন্য কণাতে শোষিত হতে পারে। আরও ঠিক করে বললে এদের শক্তি অন্য কণা শুষে নিতে পারে। যেমন আলো শোষণ করে ইলেকট্রন পরমাণুর এক শক্তিস্তর থেকে আরেক শক্তিস্তরে লাফিয়ে যেতে পারে। এভাবে ফোটনের শক্তি অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়। 

ফোটন পরমাণু দিয়ে তৈরি নয়। যার ভর বা বৈদ্যুতিক চার্জ আছে, তা কখনোই ফোটন হতে পারে না। অর্থাৎ সেসব ফোটন তৈরি হতে পারে না। ফোটন গঠিত হয় শক্তি দিয়ে।

ফোটন কি চিরকাল ভ্রমণ করে?

তাত্ত্বিকভাবে এর উত্তর হলো, হ্যাঁ। এদের কোনো ভর বা চার্জ নেই। তাই যাত্রাপথে কোনো বাধা না পেলে ফোটন অবিরাম চলতেই থাকে। ফোটন হলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এটাই আসলে আলোর মৌলিক কণা। এই কণা যদি অন্য কোথাও শোষিত না হয়, তাহলে তা চিরকাল চলতেই থাকবে। কিন্তু যাত্রাপথে অন্য কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করলে এরা শক্তি হারিয়ে ফেলে বা বস্তুতে শোষিত হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

ফোটন কি পরমাণু দিয়ে তৈরি?

এর উত্তর হলো, না। ফোটন পরমাণু দিয়ে তৈরি নয়। যার ভর বা বৈদ্যুতিক চার্জ আছে, তা কখনোই ফোটন হতে পারে না। অর্থাৎ সেসব ফোটন তৈরি হতে পারে না। ফোটন গঠিত হয় শক্তি দিয়ে। এই কণা যে ধরনের শক্তি বহন করে, তাকে বলা হয় বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ। ফোটন চলাচল করে তরঙ্গ রূপে এবং আলোর সবচেয়ে মৌলিক উপাদান বহন করে।

একইভাবে ফোটন অন্য কোনো বস্তুকণা বা পদার্থ দিয়েও গঠিত নয়। ব্যাপারটা বেশ সহজ। আলোর কোনো ভর থাকা অসম্ভব। সে কারণেই আলো বা ফোটন ছুটতে পারে আলোর গতিতে (সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার)। তাই সিদ্ধান্তে আসা যায়, ফোটন কোনো পদার্থ বা বস্তুকণা দিয়ে তৈরি নয়।

ফোটন আর নিউট্রন কি একই জিনিস?

না। ফোটন যে নিউট্রন নয়, তা খুব সহজেই বোঝা সম্ভব। এই দুটি কণা আসলে একেবারেই আলাদা। এমনকি প্রোটন, ইলেকট্রনের মতো অন্য কণাদের চেয়েও ফোটন আলাদা। ফোটনকে বলা হয় বোসন কণা। বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর নামে নাম রাখা হয়েছে বোসন কণার। বোসন কণাদের ধর্ম হলো, এদের কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ ও ভর থাকে না।

কিন্তু গুগলে একটু ঘাটাঘাটি করলেই আমরা দেখতে পাবো, নিউট্রন কণার বৈদ্যুতিক চার্জ না থাকলেও এর ভর আছে। নিউট্রনের ভর প্রায় ১.৬৭৪২৯২৭৪৯৮০৪×১০-২৭ কিলোগ্রাম। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে ফোটন এবং নিউট্রন পুরোপুরি আলাদা।

ট্যাকিয়ন নামের একটি কাল্পনিক কণার কথা বলেন একদল বিজ্ঞানী। তাঁদের মতে, এই তাত্ত্বিক ট্যাকিয়ন কণা আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে চলতে পরে। তবে এর পরীক্ষামূলক কোনো প্রমাণ নেই।

ফোটনের আয়ু কতদিন?

তাত্ত্বিকভাবে, ফোটন কোটি কোটি বছর টিকে থাকতে পারে। কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল মতে, ফোটনের আয়ু অসীম। এর মানে হলো, অন্যকোনো পদার্থ বা বস্তুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করা পর্যন্ত এদের ‘ক্ষয়’ বা ‘মৃত্যু’ নেই।  (যেমন পরমাণুর ইলেকট্রনে এরা শোষিত হয়।) পৃথিবীতে বহুদূরের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি থেকে আলো আসে। অর্থাৎ কোটি কোটি বছর ধরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে আমাদের কাছে এসে পৌঁছে। এটিই প্রমাণ করে যে আলো আয়ু অনেক বেশি।

কিন্তু এরা খুবই দ্রুত গতিতে চলার কারণে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের অনুমান অনুযায়ী, এদের কাল প্রসারণ ঘটে। সে কারণে ফোটনের জড়কাঠামোর সাপেক্ষে (ফ্রেম অব রেফারেন্স) তাদের আয়ু মাত্র ৩.৫ বছর গণনা করা হয়। তবে আমাদের জড়কাঠামোর সাপেক্ষে সেই সময়ের পরিমাণ প্রায় এক বিলিয়ন বিলিয়ন বছর বা ১০১৮ বছর।

আরও পড়ুন

ফোটনের চেয়ে দ্রুত গতিতে কি অন্য কিছু ছুটতে পারে?

কোনোকিছুই আলো বা ফোটনের চেয়ে বেশি বেগে ছুটতে পারে না। আলোর কোনো ভর নেই। তাই অন্য কণাদের চেয়ে ফোটন ছুটতে পারে বেশি বেগে। এ কারণে আলোর গতিতে বলা হয় মহাবিশ্বের চূড়ান্ত গতিসীমা। এটিই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মৌলিক নীতি।

প্রতীকী ছবি

তবে ট্যাকিয়ন নামের একটি কাল্পনিক কণার কথা বলেন একদল বিজ্ঞানী। তাঁদের মতে, এই তাত্ত্বিক ট্যাকিয়ন কণা আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে চলতে পরে। তবে এর পরীক্ষামূলক কোনো প্রমাণ নেই। আবার অন্য আরেক দল বিজ্ঞানী ট্যাকিয়নের ধারণা বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁদের মতে, এমন কোনো কণার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কারণ আমাদের জানা ও প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন বা তত্ত্বের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক।

সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, মহাকর্ষ কোনো বল নয়, বরং এটি হলো ভর ও শক্তির কারণে বেঁকে যাওয়া স্থানকাল। স্থান ও কালকে বিবেচনা করা হয় একটা বক্র চাদর হিসেবে। সে কারণেই বড় কোনো বস্তুর পাশে স্থানকাল বেঁকে যায়।

প্রতি সেকেন্ড পৃথিবীতে কতগুলো ফোটন আঘাত হানছে?

বিজ্ঞানীদের হিসেবে, পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে প্রায় ২.৬ ×১০২১টি ফোটন আঘাত হানছে। পৃথিবীর এক বর্গ মিটার পৃষ্ঠে সেকেন্ডে এটাই গড় ফোটন আঘাত হানার হিসেব। অন্যদিকে সূর্য থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৯ ×১০৪৫টি ফোটন নিঃসৃত হচ্ছে।

ফোটনের ভর নেই, কিন্তু মহাকর্ষের কারণে প্রভাবিত হয় কীভাবে

ফোটন বা আলো যে মহাকর্ষ বলের কারণে প্রভাবিত হয়, তার প্রমাণ আছে বেশকিছু। ১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রমাণ করাও হয়েছিল এই পরিঘটনা পর্যবেক্ষণ করে। কাজটি করেছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ আর্থার এডিংটন।

সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, মহাকর্ষ কোনো বল নয়, বরং এটি হলো ভর ও শক্তির কারণে বেঁকে যাওয়া স্থানকাল। স্থান ও কালকে বিবেচনা করা হয় একটা বক্র চাদর হিসেবে। সে কারণেই বড় কোনো বস্তুর পাশে স্থানকাল বেঁকে যায়। আর পাশের অন্য বস্তু সেই বক্রতায় প্রভাবিত হয়। এর ফলেই সূর্যের চারপাশে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরছে।

আলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। আলোও কোনো ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানকালের এই বক্রতার প্রভাবে বক্র পথ অনুসরণ করে এবং তার গতিপথ বেঁকে যায়।

সূত্র: দ্য বিগ বুক অব সায়েন্স কোয়েশ্চেন্স

ফিজিকস ওয়ার্ল্ড ডট কম

সায়েন্টিফিক আমেরিকান

লাইভ সায়েন্স ডট কম

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন