১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি। পদার্থবিজ্ঞানের জন্য সময়টা উত্তাল। কোয়ান্টাম মেকানিকসের বেশ কিছু নতুন তত্ত্ব ততদিনে ডানা মেলেছে। পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সেগুলো মিলেও যাচ্ছে দারুণভাবে। কিন্তু স্বস্তি নয়, অস্বস্তি কাঁধে চেপে বসতে লাগল একদল বিজ্ঞানীর। সেই অস্বস্তি দিন দিন বাড়তেই থাকল। তার কারণ কোয়ান্টাম জগতের অদ্ভুত সব নিয়মকানুন। পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র কণার জগতের এসব নিয়মকানুন বড় পরিসর বা বাস্তব জগতের সঙ্গে মিলছে না। সেগুলো একেবারেই আলাদা।
এই যেমন কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার কথাই বলা যাক। এ ব্যাখ্যা অনুসারে, কোয়ান্টাম জগতে ‘সুপারপজিশন’ নামে একটা ঘটনা ঘটে। একটা কণা একই সঙ্গে একাধিক অবস্থায় থাকার নাম সুপারপজিশন। আমাদের চেনা জগতে সেটা অসম্ভব। উদ্ভট বললেও কম বলা হয়। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ধারণায় সেটা নিষিদ্ধ। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে সেটা শুধু সম্ভবই নয়, আমাদের অজান্তে ঘটছে প্রতিনিয়তই। সেখানে একটি কণা একই সঙ্গে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। এই গোলমেলে পরিস্থিতিতেই জন্ম নিল একটা কাল্পনিক বিড়াল। সেই বিড়ালের জীবন-মৃত্যু হয়ে উঠল কোয়ান্টাম নামের রহস্যময় জগতের প্রতীক। এই বিড়ালের নাম—শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল।
১৯৩৫ সালে শ্রোডিঙ্গার একটি থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষা প্রস্তাব করেন। উদ্দেশ্যটা সরল। প্রতিপক্ষের দেওয়া কোয়ান্টাম মেকানিকসের সুপারপজিশনের ধারণাটিকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিতে চান তিনি।
অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ আরউইন শ্রোডিঙ্গার (এরভিন শ্রোডিঙ্গার) ছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের অন্যতম স্থপতি। ইলেকট্রনের জন্য তরঙ্গ সমীকরণ প্রণয়ন করেছেন ১৯২৬ সালে। সেই সমীকরণ ইলেকট্রনের গতিবিধি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারল ঠিকই, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের হৃৎপিণ্ডে বিঁধে গেল সম্ভাবনার কাঁটা। তাই তিনি নিজেই এই তত্ত্বের কিছু আপাত অযৌক্তিক পরিণতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলেন। এ ছাড়া বিশেষ করে সুপারপজিশনের ধারণাটি তাঁর কাছে কেমন যেন অস্বস্তিকর ঠেকত। ক্ষুদ্র কণার ক্ষেত্রে না হয় ব্যাপারটা মানা যায়, কিন্তু বাস্তব জগতেও কি একই নিয়ম প্রযোজ্য?
এই গোলমেলে প্রশ্নের উত্তরে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। এক পক্ষে কোয়ান্টাম মেকানিকসের গডফাদার হিসেবে পরিচিত নীলস বোর এবং তাঁর তরুণ শিষ্যরা। প্রতিপক্ষে আছেন স্বয়ং আইনস্টাইন, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের আরেক দিকপাল। আর আছেন শ্রোডিঙ্গার। আইনস্টাইনের সঙ্গে নীলস বোরের এ বিষয়ে অনেক তর্কবির্তক হয়েছে। ১৯৩০ সালের সলভে কনফারেন্সের সময় তাঁদের সেই বির্তক পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনো আলোচনার বিষয়। কোয়ান্টাম জগতের রহস্যময়, উদ্ভট ব্যাখ্যা নিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে আলোচনা করতেন শ্রোডিঙ্গার। দুজনের মধ্যে উত্তপ্ত চিঠি চালাচালিও চলত। আইনস্টাইনও কোয়ান্টাম মেকানিকসের কিছু ব্যাখ্যা নিয়ে সংশয়ী ছিলেন। দুই বিজ্ঞানীর ভেতর পত্রালাপ থেকে জানা যায়, তাঁরা একটি পূর্ণাঙ্গ ও বোধগম্য তত্ত্বের অভাব অনুভব করছিলেন।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৩৫ সালে শ্রোডিঙ্গার একটি থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষা প্রস্তাব করেন। উদ্দেশ্যটা সরল। প্রতিপক্ষের দেওয়া কোয়ান্টাম মেকানিকসের সুপারপজিশনের ধারণাটিকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দিতে চান তিনি। তাঁর চিন্তাটা ছিল, একটি স্থূল বস্তুর ওপর প্রয়োগ করে যদি এ ধারণার আপাত অযৌক্তিকতা তুলে ধরা যায়, তাহলে সেটা সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, ক্ষুদ্র জগতের কোয়ান্টাম নিয়ম যদি সরাসরি বড় বস্তুর ক্ষেত্রে খাটে, তাহলে আমাদের বাস্তব জগৎ কতটা অদ্ভুত ও পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠবে। আসলে শ্রোডিঙ্গারের এই মানস পরীক্ষা নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি করা হয়নি। বরং এটি ছিল কোয়ান্টাম মেকানিকসের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার একটি সমালোচনা।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কোপেনহেগেন ব্যাখ্যাটা কী? চলুন, মূল ব্যাপারটা আলোচনার আগে সেটা আরেকটু জানা যাক।
২.
বিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন কোয়ান্টাম মেকানিকসের জন্ম হয়, তখন এর ব্যাখ্যা নিয়েও নানা মতভেদ দেখা দেয়। এ তত্ত্ব অনুসারে দেখা গেল, পরমাণুদের অদ্ভুত দুনিয়ায় কণা একই সঙ্গে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অনুসারে, সেখানে অনিশ্চয়তাই যেন শেষ কথা। এ জগৎকে বুঝতে বা ব্যাখ্যা করতে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ব্যাখ্যাগুলোর একটি হলো কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন বা কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা। ১৯২০-এর দশকের প্রায় শেষ দিকে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে নীলস বোরের নেতৃত্বে একদল তরুণ বিজ্ঞানী এই ব্যাখ্যার মূল ভিত্তি স্থাপন করেন। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানীও যুক্ত ছিলেন এর সঙ্গে।
কল্পনা করুন, একটি কয়েন ঘোরানো হচ্ছে। যতক্ষণ না সেটি মাটিতে পড়ছে, ততক্ষণ সেটি একই সঙ্গে হেডস এবং টেলস—দুটোই। কোয়ান্টাম কণার অবস্থাও অনেকটা তেমন।
কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা অনুসারে, কোনো কোয়ান্টাম সিস্টেম যতক্ষণ না পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, ততক্ষণ সেটি সম্ভাব্য সব অবস্থার সুপারপজিশনে থাকে। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই সিস্টেম একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় ‘ভেঙে’ পড়ে বা ওয়েভ ফাংশন কলাপস করে। অর্থাৎ কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকানুন এবং আমাদের পর্যবেক্ষণের ভূমিকার ওপর জোর দেয়। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, কোনো কোয়ান্টাম কণাকে—যেমন ইলেকট্রন—আমরা যতক্ষণ পর্যবেক্ষণ না করছি, ততক্ষণ সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকে না, বরং সম্ভাব্য সব অবস্থার একটি মিশ্রণ বা সুপারপজিশনে বিরাজ করে। অনেকটা যেন একই সঙ্গে অনেকগুলো অস্পষ্ট ছায়া। এই সুপারপজিশন হলো সম্ভাবনার জগৎ। সেখানে কণাটি কোথায় থাকতে পারে, তার অসংখ্য সম্ভাবনা মিশে থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে কোনো পর্যবেক্ষক সেই ইলেকট্রনের দিকে তাকান, কিংবা কোনো যন্ত্র দিয়ে তার অবস্থান মাপার চেষ্টা করেন, অমনি ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা—সঙ্গে সঙ্গে ‘ওয়েভ ফাংশন “কলাপস”’ করে। যেন জাদুদণ্ড ছোঁয়ানো মাত্রই ওই অস্পষ্ট ছায়ারা একটি নির্দিষ্ট, বাস্তব অবস্থানে স্থির হয়ে আসে। ইলেকট্রনটি তার সুপারপজিশন ভেঙে ফেলে এবং পর্যবেক্ষকের চোখের সামনে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে আত্মপ্রকাশ করে।
এই ব্যাখ্যায় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা কেবল তথ্য সংগ্রহকারীর নয়, বরং সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর মতো। তার মাপার বা দেখার কাজটি যেন কোয়ান্টাম সম্ভাবনার মেঘ থেকে একটি নির্দিষ্ট বাস্তবতাকে টেনে বের করে আনে। যতক্ষণ না পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, ততক্ষণ বাস্তবতা যেন অস্পষ্ট ও অনির্ধারিত। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই যেন প্রকৃতি একটি ‘সিদ্ধান্ত’ নেয়—কণাটি ঠিক কোথায় হাজির হবে।
একটা বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক। কল্পনা করুন, একটি কয়েন ঘোরানো হচ্ছে। যতক্ষণ না সেটি মাটিতে পড়ছে, ততক্ষণ সেটি একই সঙ্গে হেডস এবং টেলস—দুটোই। কোয়ান্টাম কণার অবস্থাও অনেকটা তেমন। যতক্ষণ না আমরা পরিমাপ করছি, ততক্ষণ তারা যেন সম্ভাব্য সব ‘পিঠ’-এ মিশে থাকে। পরিমাপ করার মুহূর্তেই যেন মুদ্রাটি থেমে একটি নির্দিষ্ট দিকে স্থির হয়। মানে কণাটি তখন একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় ‘ভেঙে’ পড়ে। একেই বলে ওয়েভ ফাংশন কলাপস করা।
আগেই বলেছি, এই ধারণা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। চিরায়ত জগতে বস্তুর একটি নির্দিষ্ট ও স্বাধীন বাস্তবতা থাকে, পর্যবেক্ষক থাকুক বা না থাকুক। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে, কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা অনুসারে, পর্যবেক্ষণের কাজটি মৌলিক। পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোয়ান্টাম সিস্টেমের কোনো নির্দিষ্ট ভৌত বৈশিষ্ট্য (যেমন অবস্থান বা ভরবেগ) অর্থবহ নয়। কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা, কোয়ান্টাম মেকানিকসের এক প্রভাবশালী ভাষ্য, পরমাণুর রহস্যময় জগতে আমাদের চিরায়ত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এই ব্যাখ্যায় একজন সাধারণ দর্শক বা পর্যবেক্ষক যেন কেবল দর্শক নন, বরং কোয়ান্টাম নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। তার চোখ যেন পর্দার আড়ালে থাকা সম্ভাবনার জট খুলে বাস্তবতার রূপ দেয়।
সে কারণেই কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার কট্টর সমালোচক ছিলেন আইনস্টাইন। তিনি কোয়ান্টাম জগতের অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্যতাভিত্তিক ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতেন না। এ বিষয়েই তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’। কারণ তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির একটি নির্দিষ্ট ও বাস্তব অবস্থা থাকা উচিত, যা আমাদের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল নয়। এদিকে শ্রোডিঙ্গার নিজেও কোয়ান্টাম মেকানিকসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হওয়া সত্ত্বেও কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার কিছু দিক নিয়ে সংশয়ী ছিলেন। তিনি ‘ওয়েভ ফাংশন “কলাপস”’-এর ধারণাটিকেও রহস্যময় বলে মনে করতেন। শ্রোডিঙ্গার প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই ‘পর্যবেক্ষণ’ প্রক্রিয়াটি ঠিক কখন এবং কীভাবে ঘটে? কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার সুপারপজিশন ধারণাকে অযৌক্তিক প্রমাণ করতে তাই একটা থট এক্সপেরিমেন্টের প্রস্তাব করেন তিনি।
কোয়ান্টাম মেকানিকসের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা মতে, যতক্ষণ না আমরা বাক্সটি খুলছি এবং পরমাণুটির অবস্থা দেখছি, ততক্ষণ পরমাণুটি একই সঙ্গে বিকিরণ করা এবং না করার সুপারপজিশন অবস্থায় থাকবে।
শ্রোডিঙ্গারের পরীক্ষাটা অনেকটা এরকম: ধরা যাক, একটা বাক্সের ভেতরে রাখা আছে একটি বিড়াল। সেই সঙ্গে আছে একটি তেজস্ক্রিয় পরমাণু, একটি তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করার যন্ত্র (যেমন গাইগার কাউন্টার), গাইগার কাউন্টারের সঙ্গে বিশেষভাবে বাঁধা একটি হাতুড়ি এবং একটি বিষের বোতল। পরমাণুটি যদি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে ভেঙে যায়, অর্থাৎ পরমাণুটির যদি তেজস্ক্রিয় ক্ষয় হয়, তাহলে যন্ত্রটি সেই বিকিরণ শনাক্ত করবে। তাতে হাতুড়িটি সক্রিয় হয়ে বিষের বোতলটি ভেঙে দেবে। আর সেই বিষক্রিয়ায় মারা যাবে বিড়ালটি। আর যদি পরমাণুটি বিকিরণ না করে, অর্থাৎ এর তেজস্ক্রিয় ক্ষয় না হয়, তাহলে বিষের বোতল অক্ষত থাকবে। বিড়ালটিও বেঁচে থাকবে।
কোয়ান্টাম মেকানিকসের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা মতে, যতক্ষণ না আমরা বাক্সটি খুলছি এবং পরমাণুটির অবস্থা দেখছি, ততক্ষণ পরমাণুটি একই সঙ্গে বিকিরণ করা এবং না করার সুপারপজিশন অবস্থায় থাকবে। অর্থাৎ পরমাণুটি একই সঙ্গে তেজস্ক্রিয়ভাবে অক্ষত এবং অক্ষত নয়—অনেকটা যেন একটা মুদ্রাকে ঘোরানোর পর যতক্ষণ না সেটি থামছে, ততক্ষণ সেটি একই সঙ্গে হেডস ও টেলস দুটোই।
প্রশ্ন হলো, পরমাণুটি যদি একই সঙ্গে দুটো অবস্থায় থাকে, তাহলে বিড়ালটির অবস্থাই-বা কী হবে? কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, বাক্স না খোলা পর্যন্ত বিড়ালটিও একই সঙ্গে জীবিত এবং মৃত—এই সুপারপজিশন অবস্থায় থাকবে! অর্থাৎ বিড়ালটি একইসঙ্গে ৫০ ভাগ মৃত ও ৫০ ভাগ জীবিত! আমাদের চেনা বাস্তব জগতে সেটা একেবারেই অসম্ভব। একটা বিড়াল একই মুহূর্তে জীবিত আর মৃত—এটা কেমন কথা?
এই ব্যাখ্যায় অসন্তুষ্ট ছিলেন আইনস্টাইনও। তাঁর বাসায় অতিথি বেড়াতে এলে, তিনি প্রায়ই বলতেন: ‘আকাশে চাঁদের দিকে একবার তাকান তো। একটা ইঁদুর ওটার দিকে তাকিয়েছে বলেই কি হঠাৎ করে ওটা লাফ দিয়ে অস্তিত্বশীল হয়েছে?’
শ্রোডিঙ্গার এই কাল্পনিক পরীক্ষাটির অবতারণা করেছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের এই অদ্ভুত সুপারপজিশনের ধারণাটির অযৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, কীভাবে ক্ষুদ্র জগতের কোয়ান্টাম নিয়ম বৃহৎ বস্তুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে তার উদ্ভট বা অযৌক্তিক পরিণতি আসতে পারে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কোয়ান্টাম মেকানিকসের অসম্পূর্ণতা বা এর ব্যাখ্যার সমস্যাগুলো তুলে ধরা।
কোয়ান্টাম মেকানিকসের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা মতে, যতক্ষণ না আমরা বাক্সটি খুলছি এবং পরমাণুটির অবস্থা দেখছি, ততক্ষণ পরমাণুটি একই সঙ্গে বিকিরণ করা এবং না করার সুপারপজিশন অবস্থায় থাকবে।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যাখ্যা উদ্ভট বা অযৌক্তিক হলে কী হবে, বাস্তবে কিন্তু পরমাণু আসলেই সুপারপজিশন অবস্থায় থাকে। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম কম্পিউটারসহ আধুনিক অনেক প্রযুক্তি। অর্থাৎ কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যাখ্যা যেমনই হোক, প্রকৃতিতে সত্যিই এমনটা ঘটতে দেখা যায়।
যাই হোক, এই পরীক্ষা বাস্তব না হলেও, এটি কোয়ান্টাম মেকানিকসের ব্যাখ্যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কোয়ান্টাম জগৎ এবং আমাদের চেনা চিরায়ত জগতের মধ্যকার সীমারেখা কোথায়, কীভাবে কোয়ান্টাম সুপারপজিশন বৃহৎ বস্তুর ক্ষেত্রে ভেঙে যায়, তা নিয়ে গবেষণা চলছে আজও।
এই কাল্পনিক বিড়াল কোয়ান্টাম মেকানিকসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী প্রতীকগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। এটি আমাদের শেখায় যে প্রকৃতির নিয়ম আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও অনেক অদ্ভুত এবং রহস্যময় হতে পারে। বাক্সবন্দী সেই বিড়ালটি আজও বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে। কারণ বিজ্ঞানীরা এখনো একমত হতে পারেননি যে কোয়ান্টামের জগৎ কি সত্যিই এত গোলমেলে, নাকি এর পেছনের রহস্য আমরা এখনো পুরোপুরি ভেদ করতে পারিনি?
