আমাদের চারপাশে আছে অসংখ্য বস্তু। কলমের কথাই ধরা যাক। একটি কলমকে ভাঙলে দুটি টুকরো পাওয়া যায়। ওই দুই টুকরো ভাঙ্গলে পাওয়া যাবে চার টুকরা। এভাবে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এক সময় অনেকগুলো টুকরো হবে। কিন্তু একটা টুকরোকে ঠিক কতটুকু ছোট করা যাবে? ধরা যাক, আমাদের এমন ক্ষমতা দেয়া হলো যে আমরা আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়েও ভাঙতে পারি। এখন কতটা ছোট অংশে কলমটিকে ভাঙা যাবে?
বলা বাহুল্য, এখানে কলমের প্লাস্টিক অংশ আলোচ্য। কালি কিংবা অন্যান্য অংশ নয়। পদার্থকে ঠিক কতটা ভাঙা সম্ভব, সে ব্যাপারে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন গ্রিক দার্শনিক লিউসিপ্পাস। তিনি বলেছিলেন, ‘একটি পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে এমন এক দশা পাওয়া যাবে, যাকে আর ভাঙা সম্ভব নয়।’ পরে লিউসিপ্পাসের ছাত্র আরেক গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস বললেন, ‘পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে এমন এক কণা পাওয়া যাবে, যাকে আর ভাঙা সম্ভব নয়।’ তিনি এ কণার নাম দিলেন Atomos। এর আক্ষরিক অর্থ অবিভাজ্য। ইংরেজি প্রতিশব্দ Atom বা পরমাণু।
দার্শনিক ডেমোক্রিটাস আরও বললেন, ‘পরমাণুর বেশিরভাগ জায়গাই ফাঁকা। এদের ধ্বংস কিংবা সৃষ্টি নেই।’ তবে সে যুগে তাঁর কথা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ডেমোক্রিটাসের এই মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দিলেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল। তাঁদের মতে, সব পদার্থ পানি, মাটি, বায়ু ও আগুন দিয়ে তৈরি। সঙ্গে তাঁরা আরও যোগ করলেন, তাঁদের মতবাদের বিরোধিতা করা আর সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করা একই কথা। সে সময় অ্যারিস্টটলকে সবাই প্রায় দেবতার মতো সম্মান করতো। তাঁর বিরোধিতা করে এমন সাহস কারও ছিল না।
ডেমোক্রিটাস কম জনপ্রিয় হওয়ায় তাঁর পরমাণু সম্পর্কিত প্রায় ৭২টি বইয়ের রেপ্লিকা হারিয়ে যায়। তবে হারিয়ে যাওয়া আগে আরেক গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাস সেগুলিকে পড়েন। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় স্কুল শিক্ষক। পরমাণু নিয়ে তিনি প্রায় শতাধিক বই রচনা করেছিলেন। তবে ডেমোক্রিটাসের মতবাদের সঙ্গে সুর মেলানোর কারণে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। এপিকিউরাসের বেশিরভাগ বই-ই পড়েছিলেন গ্রিক কবি ও দার্শনিক লুক্রেটিয়াস। পরমাণু বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে তিনি কবিতাও লিখেছিলেন।
১৪২৭ সালে এক ব্যক্তি দাবি করলেন, তাঁর বাড়ির চিলেকোঠায় লুক্রেটিয়াসের লেখা কবিতা খুঁজে পেয়েছেন। পরে গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার হলে লুক্রেটিয়াসের কবিতাগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। কিন্তু পরমাণু নিয়ে কারও তেমন কোনো তোড়জোড় নেই। ইতিমধ্যে রবার্ট বয়েলের আদর্শ গ্যাসের সূত্র আবিষ্কার করেন।
১৮০৩ সাল। গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে হাজির হন ব্রিটিশ রসায়নবিদ জন ডাল্টন। তিনিও ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ডেমোক্রিটাসের মতো একই পথে হাটেন জন ডাল্টনও। তবে তাঁর মতবাদে সামান্য পরিবর্তন ছিল। ডাল্টনের মতে, ‘পরমাণু পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা।’ তিনি যৌগের পরমাণুর নাম দেন যৌগিক পরমাণু এবং মৌলের পরমাণুর নাম মৌলিক পরমাণু। পরে ১৮০৮ সালে পরমাণু নিয়ে একটি বই লেখেন তিনি। এই বইয়ে পরমাণু সম্পর্কে তাঁর ধারণা ব্যাখা করেন। এ কারণে ডাল্টনকে আধুনিক পরমাণুবাদের জনক বলা হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে: সেই দুই হাজার বছর আগে লিউসিপ্পাস কিংবা ডেমোক্রিটাস তো একই কথা বলেছেন। তাহলে তাঁরা কেন পরমাণুবাদের জনক নয়?
শুভংকরের ফাঁকিটা এখানেই। ডেমোক্রিটাস কিংবা লিউসিপ্পাস যা বলেছিলেন তা শুধু মতবাদ। তাঁরা কোনো বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করে বলেননি। কিন্তু ডাল্টন গবেষণা করে পাওয়া ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এ কথা বলেছিলেন। এর অনেক বছর পরে ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জে জে টমসন একটি পূর্নাঙ্গ পরমাণু মডেল প্রবর্তন করেন। এ মডেলে তিনি ডাল্টনের পরমাণুবাদের কিছু ত্রুটি উপস্থাপন করেন। টমসন বলেন, ‘একটি তরমুজে যেভাবে বিচিগুলো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে, ঠিক তেমনি পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে।’ অর্থাৎ, পরমাণু আদতে অবিভাজ্য নয়। তিনি বললেন, ‘তরমুজের বিচিগুলো ইলেকট্রন আর জলীয় অংশ হলো প্রোটন।’
টমসনের এ মডেলকে তোয়াক্কা না করে নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড একটি পরীক্ষা করলেন। এ পরীক্ষা আলফা রশ্মি বিক্ষেপণ নামে পরিচিত। পরীক্ষার জন্য রাদারফোর্ড একটি সোনার পাত নিলেন। পাতটি অত্যন্ত পুরু। এছাড়া জিংক সালফাইডের প্রলেপযুক্ত পর্দা ও আলফা রশ্মি বিক্ষেপন করতে পারে এমন যন্ত্র নিলেন। জিংক সালফাইড মূলত আলো শোষণ করে পরে বিকিরণ করে। তিনি জিংক সালফাইডের প্রলেপযুক্ত পর্দার মাঝে সোনার পাতটাকে রেখে তার ওপর আলফা রশ্মি বিক্ষেপণ করলেন। গুটিকয়েক রশ্মি ছাড়া প্রায় সব রশ্মিই পাত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। তবে দুই একটি রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে আসছে।
এ থেকে তিনি আরেকটি পরমাণুর মডেলের ধারণা দিলেন। এই মডেলটি সোলার সিস্টেম মডেল বা নিউক্লিয়ার মডেল নামে পরিচিত। পরে এই মডেলের অনেক খুঁত ধরা পরে। ১৯১৩ সালে ড্যানিস পদার্থবিদ নীলস বোর আরেকটি মডেল প্রস্তাব করেন। মোটা দাগে যাকে নিউক্লিয়ার মডেলের সংশোধিত ভার্সন বলা যায়। রাদারফোর্ড তাঁর মডেলে ইলেকট্রন বিন্যাস সম্পর্কে ধারণা দেননি। কিন্তু বোর বলেছিলেন পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো 2n2 রুপে বিন্যস্ত। রাদারফোর্ড তাঁর মডেলে কক্ষপথের আকৃতিও বলেননি। বোর বলেছেন তা বৃত্তাকার। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী রাদারফোর্ড মডেলে সমস্যা ছিল, যা বোর মডেলে সমাধান হয়েছে।
নীলস বোর কৌণিক ভরবেগ সম্পর্কে ব্যাখা করেছিলেন। পাশাপাশি ইলেকট্রনের কক্ষপথ পরিবর্তন হওয়ার ব্যাপারেও দিয়েছিলেন ধারণা। এতো কিছুর পরেও সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল বোর মডেলে। পরে সেই সমস্যার সমাধান দিয়েছিলেন অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ আরউইন শ্রোডিঙ্গার। তবে এখনো আমরা স্কুল-কলেজে বোর মডেলের সংশোধিত ভার্সনই পড়ি।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল ফারুক একাডেমী, সৈয়দপুর
সূত্র: উইকিপিডিয়া