কম্পিউটার যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁদের কাছে ‘বিট’ শব্দটি অচেনা থাকার কথা নয়। একইভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছেও কিউবিট শব্দটি এতদিনে বহুল পরিচিত হয়ে যাওয়ার কথা। তবু জানার বাইরে কিছু অজানা বিষয় থেকে যেতেই পারে। চলুন, সেটাই খুঁজে দেখা যাক।
বর্তমানে প্রচলিত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার, অর্থাৎ আমাদের প্রচলিত আধুনিক কম্পিউটার গড়ে উঠেছে বাইনারি পদ্ধতিতে। অর্থাৎ এসব ডিজিটাল তথ্য ০ এবং ১-এর সিরিজে এনকোড করা হয়। বাইনারি কম্পিউটিং পদ্ধতিতে ইনফরমেশন বা তথ্যের সবচেয়ে ছোট এককের নাম বিট (bit)। বিট শব্দটি এসেছে বাইনারি ডিজিট (Binary Digit) শব্দটির আদ্যক্ষরের সংমিশ্রণে। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে লেখা একটি গবেষণা প্রবন্ধে। এর লেখক ছিলেন ক্লড শ্যানন। ওই প্রবন্ধে তিনি জানান, এর এক বছর আগে (৯ জানুয়ারি, ১৯৪৭) জন টাকি ‘বাইনারি ইনফরমেশন ডিজিট’ শব্দগুচ্ছের বদলে ‘বিট’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।
অন্যদিকে কিউবিট শব্দটি প্রথম চালু করেছিলেন মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ বেঞ্জামিন শুমাহা (কারও কারও মতে উচ্চারণটা শুমাখা)। তিনি মূলত গবেষণা করেন কোয়ান্টাম ইনফরমেশন থিওরি নিয়ে। ১৯৯৫ সালে এক গবেষণা প্রবন্ধে শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন তিনি। তাঁর সহকর্মী পদার্থবিদ উইলিয়াম উটারসের সঙ্গে একদিন কথা বলতে গিয়ে হুট করে শব্দটি মাথায় আসে বেঞ্জামিনের।
কিউবিট (Qubit) শব্দটি আসলে কোয়ান্টাম বিটের (Quantum bit) সংক্ষিপ্ত রূপ। কিউবিটকে বলা হয় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মৌলিক গাঠনিক একক। অর্থাৎ একে বলা হয় কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মৌলিক একক। ক্লাসিক কম্পিউটারের বাইনারি বিটের মতো কিউবিটও তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে, কিন্তু দুটোর আচরণ একেবারেই আলাদা।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সাধারণত উপপারমাণবিক কণাকে (প্রচলিত বাংলায় বলা হয় ‘অতিপারমাণবিক কণা) কিউবিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমন ফোটন বা আলোর কণা, ইলেকট্রন। ক্লাসিক বা বাইনারি কম্পিউটারের ১ বা ০ শূন্যকে একেকটি বিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কিউবিটে উপপারমাণিবক কণাদের চার্জ, ফোটোনিক পোলারাইজেশন বা স্পিন ১ ও ০-এর প্রতিনিধিত্ব করে। আবার কোয়ান্টাম মেকানিকসের সুপারপজিশন ও এনট্যাঙ্গলমেন্টের মতো উদ্ভট পরিঘটনাগুলোও কিউবিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো সুপারপজিশনের কারণে একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিটগুলো একাধিক দশায় থাকার সুযোগ পায়।
ডিজিটাল বা বাইনারি কম্পিউটারে একটা বিট একই সময়ে হয় ১ অথবা ০ শূন্য হতে পারে। মানে, চার্জ আছে বা চার্জ নেই। একই সময়ে দুটোর যেকোনো একটি হতে পারে, দুটো একসঙ্গে নয়। কিন্তু কিউবিট একই সময়ে দুটোই দখল করে থাকতে পারে। অর্থাৎ ১ ও ০-এর সুপারপজিশনে থাকতে পারে।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, সুপারপজিশন জিনিসটা কী? সহজভাবে বললে, সুপারপজিশন হলো, পরিমাপের আগপর্যন্ত কোনো কোয়ান্টাম সিস্টেমের একই সময়ে একাধিক অবস্থায় থাকার ক্ষমতা। শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের কথা মনে আছে? কোনো দর্শকের পর্যবেক্ষণের আগপর্যন্ত একটা বাক্সের ভেতর বিড়ালটা একইসঙ্গে জীবিত এবং মৃত। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণের আগপর্যন্ত বাক্সের ভেতর বিড়ালটি থাকে সুপারপজিশনে বা কোনো অতিদশায়।
যাই হোক, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিটও সুপারপজিশনে থাকে, যতক্ষণ না একে কোনো বাহ্যিক পরিবেশগত ফ্যাক্টরের (যেমন তাপ) মাধ্যমে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা বা মাপা হচ্ছে। কিংবা কোনো বাহ্যিক পরিবেশগত ফ্যাক্টরের মাধ্যমে বিঘ্ন ঘটানো হচ্ছে। এই কোয়ান্টাম দশা খুব সূক্ষ্ণ। সে কারণে কিউবিটকে ব্যতিচার মুক্ত রাখতে হয়। আর সে জন্য দরকার খুব শীতল তাপমাত্রা।
শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের মতো সুপারপজিশনের কারণে একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিটগুলো একাধিক দশায় (১, ০ এবং একইসঙ্গে দুটোই) থাকার সুযোগ পায়। আর কিউবিটের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তার সঙ্গে সূচকীয় হারে বাড়তে থাকে সম্ভাব্য দশার সংখ্যাও। আমাদের কাছে যদি দুটি ক্লাসিক বা বাইনারি বিট থাকে, তাহলে যেকোনো সময়ে সেগুলোর মান হতে পারে ০,০; ০,১; ১,০; অথবা ১,১-এর যেকোনো একটি। কিন্তু দুটি কিউবিটের ক্ষেত্রে ওপরের চারটি দশাই ঘটতে পারে একই সময়ে।
আবার কোয়ান্টাম কণা দুটির দশার যেকোনো সমাহারও হতে পারে। যেমন এমন দশাও পাওয়া সম্ভব, যেখানে পরমাণুটি ১০ শতাংশ সময় থাকবে আপ স্পিনে এবং ৯০ শতাংশ সময় থাকবে ডাউন স্পিনে। কিংবা ৬৫ শতাংশ সময় আপ স্পিন থাকবে এবং ৩৫ শতাংশ সময় থাকবে ডাউন স্পিন। আসলে পরমাণুর স্পিন বা ঘূর্ণনের উপায় আছে অসীম সংখ্যক। এটিই সম্ভাব্য দশার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। কাজেই পরমাণুটি তথ্যও বহন করতে পারে অনেক বেশি। এ কারণেই ডিজিটাল বিটগুলোর চেয়ে কিউবিটের শক্তি বা ক্ষমতা প্রায় সীমাহীন। তাই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রসেসিং পাওয়ার থাকার সম্ভাবনা প্রচলিত কম্পিউটারের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। অর্থাৎ যত বেশি কিউবিট থাকবে, গণনা করার ক্ষমতাও পাওয়া যাবে তত বেশি। আর এই ক্ষমতা বাড়তে থাকে সূচকীয় হারে। তবে প্রসেসিং পাওয়ার সূচকীয় হারে বাড়ানোর জন্য কিউবিটগুলো এনট্যাঙ্গলডও হতে হবে। ভাবছেন, সেটা আবার কী?
এককালে কোয়ান্টাম তত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে এই মানস পরীক্ষাটি করেছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের যুক্তি ছিল, বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী যেহেতু কোনো কিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না, কাজেই কোয়ান্টাম তত্ত্ব ত্রুটিপূর্ণ।
সহজ কথায়, কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টে হলো অতিপারমাণবিক কণাগুলোর একটি অবস্থা বা দশা, যেখানে তারা পরস্পর বিজড়িত অবস্থায় থাকে। তাদের মধ্যে একটা সংযোগ থাকে। বলা যায়, পরস্পরের মধ্যে থাকে একটা অদৃশ্য সংযোগ। কণাগুলোর মাঝখানের দূরত্ব যা-ই হোক না কেন, এই যোগাযোগে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। ব্যাপারটা যত সহজে বলা গেল, প্রক্রিয়াটি আসলে ততটাই জটিল। কাজেই একটা কিউবিট সম্পর্কে তথ্য জানা গেলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনট্যাঙ্গল দশার অন্য কণাটি সম্পর্কে জানা সম্ভব।
ব্যাপারটা সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়: ধরা যাক, দুটি ইলেকট্রন পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তারা একই ঐক্যতানে কাঁপছে। অর্থাৎ একই কম্পাংকে। ধরা যাক, তাদের মোট স্পিনের যোগফল শূন্য। একটি ইলেকট্রন যদি ঘড়ির কাঁটা বরাবর ঘোরে, তাহলে অন্যটা ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে। কারণ তাহলেই মোট স্পিন শূন্য হবে।
এবার ইলেকট্রন দুটিকে যদি আমরা আলাদা করে একটাকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিই (ধরা যাক, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্য প্রান্তে), তাহলেও তাদের মোট স্পিন শূন্যই থাকবে। কিন্তু পরিমাপ করার আগপর্যন্ত আমরা জানতে পারব না, কোন ইলেকট্রনটি ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং কোনটি ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরছে। এখন আমাদের কাছে থাকা ইলেকট্রনটার স্পিন যদি মাপি, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যাব গ্যালাক্সির অন্য প্রান্তের ইলেকট্রনটার স্পিন কী। পদার্থবিদদের ভাষায় এর মানে দাঁড়াচ্ছে, এই দুই ইলেকট্রনের মধ্যে তথ্যটা বাহিত হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে। এমনকি এই তথ্যপ্রবাহের গতি আলোর বেগের চেয়েও বেশি। একেই বলে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টাম বিজড়ন।
এককালে কোয়ান্টাম তত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে এই মানস পরীক্ষাটি করেছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের যুক্তি ছিল, বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী যেহেতু কোনো কিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না, কাজেই কোয়ান্টাম তত্ত্ব ত্রুটিপূর্ণ। একে বলা হয় ইপিআর প্যারাডক্স। ব্যাপারটা নিয়ে আইনস্টাইন ও নীলস বোরের মধ্যে ব্যাপক তর্কবির্তক থাকলেও একেই এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিটগুলো যদি পরস্পর থেকে অনেক দূরে আলাদা থাকে, তবু তারা পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। আর এটাই কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে দারুণ কম্পিউটেশনাল ক্ষমতা দিতে পারে।
বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে প্রযুক্তি বিশ্বের জায়ান্ট কোম্পানিগুলো গবেষণা করছে। কাজ করার উপযোগী কিছু কোয়ান্টাম কম্পিউটারও তৈরি করা হয়েছে।
কারণ কোয়ান্টাম কম্পিউটারে যখনই আরেকটা কিউবিট যোগ করা হয়, তখন তা আগের সব কিউবিটের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করবে। ফলে সম্ভাব্য মিথস্ক্রিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই কোয়ান্টাম কম্পিউটার সহজাতভাবেই ডিজিটাল কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। যেমন বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ১০০ কিউবিটের বেশি থাকতে পারে। তার মানে, সেগুলো এক কিউবিটের সুপার কম্পিউটারের চেয়ে ২১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী হওয়া সম্ভব।
বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে প্রযুক্তি বিশ্বের জায়ান্ট কোম্পানিগুলো গবেষণা করছে। কাজ করার উপযোগী কিছু কোয়ান্টাম কম্পিউটারও তৈরি করা হয়েছে। এদের কম্পিউটেশনাল ক্ষমতা দেখে চোখ বন্ধ করে বলা যায়, কোয়ান্টাম কম্পিউটার ভবিষ্যতে প্রযুক্তি বিশ্বের খোলনলচে বদলে দেবেই দেবে। আজকের বিট তখন হয়ে যাবে সেকেলে ব্যাপার, সবাই কথা বলবে, হিসেব-নিকেষ করবে কিউবিটে—চোখের পলক ফেলার আগেই।
সূত্র: কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি/ মিচিও কাকু
লাইভ সায়েন্স ডটকম
বিজ্ঞানচিন্তা ডটকম
