প্রিজনার’স ডিলেমা

মালিবাগে একটা খুন হয়েছে। সেই মামলায় আটক দুই আসামি—আসাদ আর প্রসাদ

মালিবাগে একটা খুন হয়েছে। সেই মামলায় আটক দুই আসামি—আসাদ আর প্রসাদ। এই দুজনের একজন অপরাধী, অথবা দুজনই অপরাধী। সব সাক্ষ্য-প্রমাণ তেমনই দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু পুলিশ বা আদালতের হাতে কোনো পোক্ত প্রমাণ নেই।

যিনি খুন হয়েছেন, তিনি সমাজের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। সরকারের ওপর মহল থেকে পুলিশের ওপর চাপ আসছে। আদালতেও দ্রুত বিচারের তাড়া আছে।

খুনের অস্ত্র গায়েব করে ফেলেছে খুনি। ঘটনাস্থলের নমুনায় আসাদ ও প্রসাদের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনো আলামত থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে খুনি আসলে কে? তবে এই দুজনের একজন অথবা দুজনই যে খুনি, এ ব্যাপারে পুলিশ নিশ্চিত।

কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে রায় দেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ কয়েক দফায় রিমান্ডে নিয়েছে দুই আসামিকে। তবে মুখ খোলানো যায়নি কোনোভাবেই। শেষে আদালত বিরক্ত হয়ে পুলিশকে আদেশ দিয়েছে চার্জশিট জমা দিতে। সময় বেঁধে দিয়েছে ১৫ দিন। দুই আসামিকেও জানানো হয়েছে সে কথা।

পুলিশ তাদের দুজনকে আলাদা সেলে রেখেছে। তারপর আসাদ ও প্রসাদকে সময় দিয়েছে পাঁচ দিন। এর মধ্যে স্বীকার করতে হবে অপরাধের কথা। নইলে দুজনকেই আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হবে। আর সেটা যদি করা হয়, তাহলে কী শাস্তি হবে, বলে দিয়েছে তাও। স্বীকার না করলে কী শাস্তি হবে, তাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে পুলিশ একটা চাল চেলেছে। এখন যদি তা কাজে লাগে!

আরও পড়ুন
খুনের অস্ত্র গায়েব করে ফেলেছে খুনি। ঘটনাস্থলের নমুনায় আসাদ ও প্রসাদের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনো আলামত থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে খুনি আসলে কে?

২.

পুলিশের বেঁধে দেওয়া পাঁচ দিনের সময় প্রায় শেষ হয়ে গেছে। আজকেই শেষ রাত। কাল সকালের মধ্যে তারা জবানবন্দি না দিলে পুলিশ নিজের মতো করে চার্জশিট দেবে।

আসাদ নিজের সেলে পায়চারি করছে। কী করবে, কী করা উচিত কিংবা উচিত নয়, ভাবছে তা নিয়ে। আসলে গত চারদিন ধরে ভেবেও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি। সে একটা গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে। একই অবস্থা প্রসাদেরও। নিজে বাঁচবে, নাকি বন্ধু আসাদকে নিয়ে বাঁচবে, নাকি সাজা পাবে দুজনেই?

পুলিশ জানিয়েছে, দুজনই যদি সত্যিটা স্বীকার করে নেয়, অর্থাৎ আসাদ ও প্রসাদ দুজনেই যদি স্বীকার করে যে তারা দুজন মিলে কাজটা করেছে, তাহলে দুজনেরই পাঁচ বছর করে জেল হবে। আসাদ যদি নিজেকে নির্দোষ বলে বন্ধুকে দোষী বলে কিংবা প্রসাদ যদি নিজেকে নির্দোষ বলে বন্ধুকে দোষী বলে, তাহলে দুজনেরই জেল হবে দশ বছরের।

অন্যদিকে আসাদ যদি নিজের দোষ স্বীকার করে প্রসাদকে নির্দোষ বলে; এবং প্রসাদ যদি নিজেকে নির্দোষ মেনে নেয়, তাহলে একমাত্র অপরাধী হিসেবে আসাদের ফাঁসি হবে এবং ছাড়া পেয়ে যাবে প্রসাদ। আবার আসাদ নিজেকে নির্দোষ বলে প্রসাদকে খুনি বলে, এবং প্রসাদ নিজেকে খুনি হিসেবে মেনে নেয়; তাহলে প্রসাদের ফাঁসি হবে, ছাড়া পেয়ে যাবে আসাদ।

আরও পড়ুন
আসাদ নিজের সেলে পায়চারি করছে। কী করবে, কী করা উচিত কিংবা উচিত নয়, ভাবছে তা নিয়ে। আসলে গত চারদিন ধরে ভেবেও কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি। সে একটা গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে। একই অবস্থা প্রসাদেরও।

এবার সংক্ষেপে বিষয়টা একটু দেখে নিই।

পুলিশের প্রস্তাবটি যেমন ছিল:

দুজনেই চুপ থাকলে: খুনের সরাসরি প্রমাণ না থাকায়, দুজনের ৫ বছর করে জেল হবে।

দুজনই যদি একসঙ্গে দোষ দোষ স্বীকার করলে: ৫ বছরের জেল হবে।

দুজন একে অপরের ওপর দোষ চাপালে: তাহলে দুজনেরই ১০ বছর করে জেল হবে।

আসাদ দোষ স্বীকার করে নিলে: প্রসাদ রাজসাক্ষী হওয়ায় ছাড়া পেয়ে যাবে, কিন্তু ফাঁসি হবে আসাদের।

প্রসাদ দোষ স্বীকার করে নিলে: আসাদ ছাড়া পেয়ে যাবে এবং প্রসাদের ফাঁসি হবে।

দুজনই আলাদা সেলে বন্দী। তাই তাদের মধ্যে আলোচনার কোনো উপায় নেই। দুজনের জন্যই সবচেয়ে ভালো হতো যদি তারা চুপ থাকত, তাহলে মাত্র ১০ বছর করে জেল হতো। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে লাভজনক হলো, অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজে ছাড়া পেয়ে যাওয়া।

আসাদ একবার ভাবে নিজের দোষ স্বীকার নেবে। প্রসাদও যদি নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়, তাহলে মাত্র পাঁচ বছর জেল। খুব বেশি দিন তো নয়! কিন্তু সে ভয় পাচ্ছে। কারণ, সে চুপ থাকলেও প্রসাদ যদি নিজের দোষ অস্বীকার করে বন্ধুকে দোষ দেয়, তাহলে নির্ঘাত তাঁর ফাঁসি। অন্তত ফাঁসি থেকে বাঁচতে হলেও নিজের দোষ স্বীকার করা যাবে না। আবার পরস্পরকে দোষারোপ করলেও বিপদ। এখন তারা কী করবে? কোনটা লাভজনক?

কোনোভাবেই দুই বন্ধু সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তারা কী করবে, সেই প্রশ্নটি একটি প্যারাডক্সে বা বুদ্ধির ফাঁদে আটকে যায়। তাই শেষ পর্যন্ত পুলিশ নিজেদের মতো করে চার্জশিট দেয়। এখন সাজার বিষয়টি পুরোটাই আদালতের হাতে।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন