বিশেষ আপেক্ষিকতা ও টুইন প্যারাডক্স

বিজ্ঞানচিন্তার গত সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর ২০২৪) বিশেষ আপেক্ষিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছিলাম, আলোর চেয়ে বেশি বেগে সংকেত আদান–প্রদান সম্ভব হলে সেটি কার্যকারণ সূত্রের বিরোধিতা করবে। অর্থাৎ ফলাফলটি উৎস কারণের আগেই সংঘটিত হতে পারে। যেমন ধনুক থেকে তির বের হওয়ার আগেই তিরটি লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। আজ আমরা আপেক্ষিকতার আরেকটি বিখ্যাত অনুসিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলব, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় টুইন প্যারাডক্স। এর বাংলা নাম হতে পারে যমজ হেত্বাভাস বা বিরোধাভাস।

খুব সংক্ষেপে প্যারাডক্সটি এভাবে বর্ণনা করা যায়: ধরা যাক আলফা ও বিটা দুই যমজ ভাই–বোন। তারা সবে জন্মগ্রহণ করেছে, তাই তাদের দুজনেরই বয়স শূন্য। এবার বিটাকে একটা অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন রকেটে চাপিয়ে নিকটবর্তী কোনো তারায় পাঠানো হলো। যেহেতু বিটা অতি দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করছে, আলফা বলবে বিটার ঘড়ি শ্লথ চলছে, বিটার বয়স তার তুলনায় বাড়ছে না। তাই বিটা যখন দূরের তারাটা চক্কর দিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবে, তার বয়স আলফার চেয়ে কম হবে।

কিন্তু আপেক্ষিকতা বলে, সবকিছুই আপেক্ষিক। বিটার জন্য যা সত্যি, আলফার জন্যও তা-ই। অর্থাৎ আলফা যেমন বিটাকে দ্রুতগতিতে চলে যেতে দেখবে, বিটাও আলফাকে একই গতিতে পেছনে ফেলে আসবে এবং ফেরার পথে সামনে এগিয়ে আসতে দেখবে। ফলে বিটা মনে করবে, আলফার ঘড়ি ধীরে চলছে। আবার পৃথিবীতে ফিরলে সে দেখতে পাবে, আলফার বয়স তার চেয়ে কম। আলফার কাছে মনে হবে বিটার বয়স কম, আর বিটার মনে হবে আলফার বয়স কম। কিন্তু দুটো তো একই সঙ্গে সত্যি হতে পারে না। তাই আপাতদৃষ্টে এটি একটি প্যারডক্স বা বিরোধাভাস।

আলফা যেমন বিটাকে দ্রুতগতিতে চলে যেতে দেখবে, বিটাও আলফাকে একই গতিতে পেছনে ফেলে আসবে এবং ফেরার পথে সামনে এগিয়ে আসতে দেখবে। ফলে বিটা মনে করবে, আলফার ঘড়ি ধীরে চলছে। আবার পৃথিবীতে ফিরলে সে দেখতে পাবে, আলফার বয়স তার চেয়ে কম। আলফার কাছে মনে হবে বিটার বয়স কম, আর বিটার মনে হবে আলফার বয়স কম। কিন্তু দুটো তো একই সঙ্গে সত্যি হতে পারে না। তাই আপাতদৃষ্টে এটি একটি প্যারডক্স বা বিরোধাভাস

এখানে বিটার বয়স যে আলফা থেকে কম হবে, এ বিষয়ে সবাই একমত। সেটা আবার বেশ কয়েকটা এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে প্রমাণও করা হয়েছে। প্রথমটি করা হয় ১৯৭১ সালে, যখন দুজন মার্কিন বিজ্ঞানী একটি পারমাণবিক ঘড়ি নিয়ে বিমানে পৃথিবীর চারদিকে ভ্রমণ করেন। এরপর ভূপৃষ্ঠে রাখা একটি ঘড়ির সঙ্গে সেটির সময়ের পার্থক্য নিরূপণ করেন। বিমান যখন পূর্ব দিকে ভ্রমণ করছিল, তখন তার গতি ভূপৃষ্ঠ থেকে বেশি ছিল আর পশ্চিম দিকে ভ্রমণ করার সময় কম ছিল (যেহেতু পৃথিবীর অক্ষ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘোরে, সে জন্য পশ্চিম দিকে চলা বিমানকে পুব দিকের আদি গতিকে অতিক্রম করতে হয়)। ফলে প্রথম ক্ষেত্রে ঘড়িটি প্রায় দুই শ ন্যানোসেকেন্ড সময় হারায়। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে এক শ ন্যানোসেকেন্ড সময় লাভ করে। এখানে যেটা ইন্টারেস্টিং, সেটা হলো এই এক্সপেরিমেন্টে শুধু যে বিশেষ আপেক্ষিকতা কাজ করেছে, তা–ই নয়, সাধারণ আপেক্ষিকতাও প্রায় সমান সমান কার্যকর হয়েছে। বিমানটিতে পৃথিবীপৃষ্ঠের তুলনায় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র অল্প কম হওয়া ঘড়ি কিছুটা দ্রুত চলেছিল এবং উভয় ক্ষেত্রেই এক শ থেকে দুই শ ন্যানোসেকেন্ড সময় লাভ করেছিল।

এই এক্সপেরিমেন্ট এটাই প্রমাণ করে যে দুটি ঘড়ির কাছে পরস্পরের সময় শ্লথ হলেও বিমানের ঘড়িটি যখন অপর ঘড়িটির কাছে ফিরে আসে, তখন সেটিকে আপেক্ষিক ত্বরণ বা মন্দনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আর এই ক্রিয়াটি বিমানের ঘড়িটির সময়কে অনন্য করে তোলে। আমাদের যমজদের ক্ষেত্রেও সেটি কাজ করে। পৃথিবীতে ফিরে আসতে হলে বিটাকে তার গতি শ্লথ করে শূন্য করতে হবে এবং আবার উল্টো দিকের গতিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। অর্থাৎ তার রেফারেন্স ফ্রেম জড় বা ইনারশিয়াল থাকবে না (শূন্য বা সমগতিতে থাকা ফ্রেমকে আমরা জড় বলছি)। কিন্তু বিটা যদি মন্দন বা ত্বরণের মধ্য দিয়ে না–ও যায়, অর্থাৎ মুহূর্তে তার রকেট থামিয়ে উল্টো দিকে একই গতিতে যাত্রা করে (ধরে নাওয়া যাক, এই অসম্ভব ব্যাপারটা সম্ভব এবং এতে বিটার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে না), তাহলেও শেষ পর্যন্ত বিটার সময় আলফার চেয়ে কম হবে। এর মূল কারণ হলো, বিটা একটি জড় ফ্রেম থেকে অন্য একটি জড় ফ্রেমে নিজেকে স্থানান্তরিত করছে। অন্যদিকে আলফা একটি ফ্রেমেই নিজেকে রাখছে।

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদের একদিকে মিনকোভস্কি ডায়াগ্রাম এবং অন্যদিকে লরেন্টজ রূপান্তরের সাহায্য নিতে হবে (কিন্তু তাতে যে সবাই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবে, ব্যাপারটা তা নয়)। আমরা শুরু করি একটি অতি দ্রুতগামী ট্রেন দিয়ে (চিত্র ১)।

চিত্র ১: ডান দিকে চলা একটি অতি দ্রুতগামী ট্রেনের ঠিক মাঝখানে অবস্থানরত B একটি বাতি জ্বালায়। A এবং C–এই দুজন B থেকে সমদূরত্বে রয়েছে। যেহেতু A, B, C–এই তিনজনই একই জড় ফ্রেমে অবস্থিত, A ও C-এর কাছে B-এর কাছ থেকে আসা আলোকতরঙ্গ একই সময়ে পৌঁছাবে। অন্যদিকে ট্রেনের বাইরে কোনো স্থির অবস্থান থেকে এই দৃশ্যটি অবলোকন করলে দেখা যাবে, A-এর কাছে আলো আগে পৌঁছাচ্ছে।

১ নম্বর চিত্রে, একই ট্রেনের মধ্যে ভ্রমণরত A এবং C-এর কাছে B থেকে আসা আলো একই সময়ে পৌঁছাবে। কিন্তু বাইরে কোনো স্থির অবস্থান থেকে দেখলে দেখা যাবে, A-এর কাছে আলো আগে পৌঁছাচ্ছে; কারণ, B থেকে A-এর দিকে আলো ট্রেনের গতির বিপরীতে চলছে, কাজেই সেই ক্ষেত্রে আলোকে কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। এই ঘটনাটি ২ নম্বর চিত্রে একটি মিনকোভস্কি ডায়াগ্রামের মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে।

চিত্র ২: একটি স্থির গাছের অবস্থান থেকে দেখলে B থেকে আগত আলো A-এর কাছে A′ সময়ে এবং C-এর কাছে C′ সময়ে পৌঁছাবে, অর্থাৎ A এবং C-এর সময় এক হবে না। গাছটির ফ্রেমে, ct অক্ষে ড্যাশ রেখা দিয়ে ওই দুটি সময় দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে চলন্ত ট্রেনের জড় ফ্রেমে এই দুটি সময় এক হবে। সময়ের এই যুগপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রেনের স্থানিক অক্ষ x হবে না; বরং x′ হবে (A′C′ এর সমান্তরাল)।

২ নম্বর চিত্রে ডান দিকে ভ্রমণরত ট্রেনটির কালিক অক্ষ ct′ এবং স্থানিক অক্ষ x′ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে A, B এবং C-এর বিশ্বরেখা ct′-এর সমান্তরাল হবে। অন্যদিকে ট্রেনটি যদি বাঁ দিকে, গাছটির দিকে ভ্রমণ করত, তাহলে গাছটির ফ্রেমে C, A-এর আগেই C′ অবস্থানে আলোকসংকেতটি পেত। ট্রেন ফ্রেমে, C′ এবং A′ একই সময়ে সংকেতটি পাবে। সেই ক্ষেত্রে, সময়ের ওই ফ্রেমে সময়ের যুগপত্তা বজায় রাখতে ট্রেনের স্থানিক অক্ষ চিত্র ২ থেকে ভিন্ন হবে। ৩ নম্বর চিত্রে আমরা C′A′ বা x′′ দিয়ে সেই অক্ষটি দেখিয়েছি।

বহির্গামী ট্রেন ও অন্তর্গামী ট্রেনের কালিক ও স্থানিক অক্ষের অবস্থান নির্ধারণ করার পর এবার আমরা যমজের কাহিনিতে ফিরে যাব।

চিত্র ৩: এবার ট্রেনটি বাঁ দিকে, গাছের দিকে যাচ্ছে। তাই এটির বিশ্বরেখা বা কালিক অক্ষ (ct′′) বাঁ দিকে বেঁকে থাকবে। এই ক্ষেত্রে B থেকে আলো প্রথম C-এর কাছে C′-এ পৌঁছাবে। C′ এবং A′ গাছের ফ্রেমে দুটি ভিন্ন সময়ে হলেও ট্রেন ফ্রেমে যুগপৎ হবে। এই যুগপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রেনের স্থানিক অক্ষ C′A′ বা x′′ হবে।

৪ নম্বর চিত্রে পৃথিবীতে থাকা আলফার বিশ্বরেখা ct অক্ষ দিয়ে দেখানো হয়েছে। বহির্গামী রকেটের সময় অক্ষ ct′ দিয়ে দেখানো হয়েছে। রকেটের ফ্রেমে বিটার অবস্থান বদলাবে না। অর্থাৎ বহির্গমনের সবটা সময়জুড়ে তার স্থানিক অবস্থান হবে x′ = 0। C অবস্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত বিটা আলফার বয়স নির্ধারণ করবে তার স্থানিক অক্ষ x′-এর সমান্তরাল রেখাগুলো দিয়ে। সেগুলো সব সময়ই আলফার বয়স কম দেখাবে। C-তে পৌঁছে বিটা দেখবে আলফা মাত্র A সময়ে পৌঁছেছে, কিন্তু রকেট তার গতির দিক পরিবর্তন করা মাত্র বিটার জড় রেফারেন্স ফ্রেম বদলে যাবে—তার কালিক অক্ষ হবে ct′′ এবং স্থানিক অক্ষ হবে x′′। আলফার সময় নির্ধারণ করতে সে x′′-এর সমন্তরাল CB রেখার সাহায্য নেবে এবং আবিষ্কার করবে, একমুহূর্তে আলফার বয়স A থেকে B-তে লাফ দিয়েছে। এরপর আলফার বয়স বাড়ার গতি শ্লথ হলেও বিটা পৃথিবীতে পৌঁছে দেখবে, আলফার বয়স তার চেয়ে বেশি।

চিত্র ৪: বিটা C অবস্থানে পৌঁছে তার দিক পরিবর্তন করে বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু করবে। ফলে তার স্থানিক অক্ষ x′ এর বদলে x′′ হবে। কাজেই C-এর দিকে যাওয়ার সময় সে আলফার বয়স নির্ধারণ করবে x′-এর সঙ্গে সমান্তরাল রেখাগুলো দিয়ে, যেগুলো ct অক্ষের সঙ্গে মেলে। আর C থেকে পৃথিবীতে পৌঁছানোর সময় x′′-এর সঙ্গে সমান্তরাল রেখাগুলো ব্যবহার করবে।

এবার আমরা একটু অঙ্ক কষে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি। এর জন্য আমাদের লরেন্টজের রূপান্তর সমীকরণগুলোকে (চিত্র ৫) ব্যবহার করতে হবে। ধরা যাক, বিটা 12 আলোকবর্ষ দূরে টাউ সেটি তারার দিকে v = 0.8c, অর্থাৎ আলোর গতির শতকরা ৮০ ভাগ গতিতে রওনা দিল (টাউ সেটি সূর্যের মতোই G টাইপ একটি তারা)। আলফার স্থান (x) এবং কালের (t) তুলনায় বিটার স্থান ও কালকে গণনা করতে আমরা [1] এবং [2] নম্বর সমীকরণ ব্যবহার করতে পারি। আবার ফেরার পথে বিটার স্থান-কাল (x′′, t′′) আমরা [3] এবং [4] নম্বর সমীকরণের মাধ্যমে বের করতে পারি। স্থানের একক হিসেবে আলোকবর্ষ, সময়ের একক বছর এবং গতিবেগের হিসাবকে আলোক-গতির ভগ্নাংশ হিসেবে ব্যবহার করলে এই সমীকরণগুলোয় আলোর গতি c-এর মান ‘এক’ ধরা সম্ভব। এতে গণনা অনেক সহজ হয়ে যায়। v = 0.8c ধরলে [5] অনুযায়ী g-এর মান হবে 1.67।

চিত্র ৫: লরেন্টজ রূপান্তর সমীকরণগুলো

যেহেতু বিটার রকেটের গতি 0.8c এবং তারাটি 12 আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে, সেহেতু আলফার সময়ে বিটা 12/0.8 = 15 বছরে নক্ষত্রটিতে পৌঁছাবে। আবার বিটার ফিরতে 15 বছর লাগবে, সব মিলিয়ে 15 + 15 = 30 বছর। ৪ নম্বর চিত্রে বিটা যখন তারাটিতে পৌঁছাবে C বিন্দুতে, তখন আলফার স্থান-কাল হবে (x, t) = (12, 15)। এখানে 12 মানে হলো 12 আলোকবর্ষ এবং 15 হলো 15 বছর। কিন্তু বিটার বহির্গামী রকেটের ফ্রেমে এই দুটো মান কী হবে? [1] নম্বর সমীকরণ অনুযায়ী এটা হবে

x′ = 1.67(12 – 0.8 × 15) = 0 এবং [2] নম্বর সমীকরণ অনুযায়ী t′ = 1.67(15 – 0.8 x 12) = 9 বছর। অর্থাৎ (x′,t′) = (0,9)। রকেটের ফ্রেমে বিটার স্থানাঙ্ক x′ = 0 হবে সব সময়, অন্যদিকে তার ঘড়ি মাত্র 9 বছর সময়ে দেখাবে। অর্থাৎ আলফার বয়স যখন 15 বছর হবে, বিটার বয়স হবে 9 বছর। কিন্তু C-তে বিটা যখন পৌঁছাচ্ছে, তখন আলফার বয়স কত হবে (বিটার ঘড়ি অনুযায়ী)? [2] নম্বর সমীকরণ ব্যবহার করে আমরা পাব 9 = 1.67(t – 0) বা t = 5.4 বছর। অর্থাৎ বিটা ভাবছে, আলফা তার চেয়ে 9 – 5.4 = 3.6 বছর ছোট হবে, যখন সে টাউ সেটিতে পৌঁছাচ্ছে।

আরও পড়ুন

কিন্তু যেই মুহূর্তে বিটা রকেটের দিক পরিবর্তন করল, তার গতিবেগ v-এর বদলে -v হলো। এই ক্ষেত্রে আমাদের [3] এবং [4] নম্বর সমীকরণ ব্যবহার করতে হবে। এই নতুন ফ্রেমে টাউ সেটিতে বিটার কালাঙ্ক হবে t′′ = 1.67(15 + 0.8 x 12) = 41 বছর। ব্যাপারটা যতই অদ্ভুত ঠেকুক না কেন, ফ্রেম বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বিটাকে তার ঘড়িকে 41 – 9 = 32 বছর এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বিটার বয়স 32 বছর বেড়েছে, তাৎক্ষণিক দিক পরিবর্তনে বিটার বয়সের পরিবর্তন হয়নি। এখানে অন্তর্বর্তী সময়টিই (ইন্টারভ্যাল) বড় কথা; ঘড়ি কী দেখাচ্ছে, তা নয়।

রকেটের মুখ ঘোরানোর পর, সেই মুহূর্তে, আলফার বয়স আমরা [4] নম্বর সমীকরণ অনুযায়ী পেতে পারি। সেটা হবে 41 = 1.67(t + 0) অথবা t = 24.6 বছর। অর্থাৎ বিটার মনে হবে আলফার বয়স 5.4 থেকে 24.6 বছর হয়ে গেছে, অর্থাৎ 19.2 বছর লাফ দিয়েছে। এরপর টাউ সেটি থেকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে বিটার ঘড়িতে আলফার বয়স মাত্র 5.4 বছর বাড়বে। কাজেই সব মিলিয়ে আলফার বয়স বিটার ঘড়িতে হবে 24.6 + 5.4 = 30 বছর। আলফার বয়স আসলেই 15 + 15 = 30 হবে, কাজেই এখানে কোনো প্যারাডক্স নেই।

বিটা যখন পৃথিবীতে ফিরে আসবে, তার ঘড়ি সময় দেখাবে t′′ = 1.67(30 + 0) = 50 বছর। অর্থাৎ C থেকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে 50 – 41 = 9 বছর লেগেছে (দিক পরিবর্তনের সময় বিটার ঘড়িকে, লরেন্টজ রূপান্তর অনুযায়ী, 41 বছর করতে হয়েছিল)। কাজেই সব মিলিয়ে বিটার বয়স হবে 9 + 9 = 18 বছর। আর আলফার কাছে বিটার রেফারেন্স বদলানো কোনো ব্যাপার হবে না—সে দেখবে বিটার বয়স t/g = 30/1.67 = 18 বছর হবে। বিটার ঘড়িও তা–ই বলবে। কাজেই এখানে আপাতদৃষ্টে কোনো প্যারাডক্স নেই।

আরও পড়ুন

কিন্তু অনেকের কাছেই রেফারেন্স ফ্রেম বদলানোর ফলে, বিটার চোখে আলফার বয়সের বৃদ্ধির ব্যাখ্যা তৃপ্তিদায়ক হয়নি। আইনস্টাইনও এই দলে ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে এই বিরোধাভাস বা প্যারাডক্সের ব্যাখ্যার জন্য সাধারণ আপেক্ষিকতা, অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের ভূমিকার দরকার। তাঁর এই ধারণাটি অবশ্য সর্বজনগ্রাহ্য বলে এখনো স্বীকৃত হয়নি। টুইন পারাডক্সকে ব্যাখ্যা করতে গবেষকরা এখনো নানাবিধ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানের অনেক ব্যাপারই এ রকম—প্রথম দৃষ্টিতে যা মনে হয় সহজ সমাধানযোগ্য, পরবর্তী গবেষণা বলে সেটি অত সহজ নয়, কিন্তু এর মধ্যেই বিজ্ঞানের সৃজনশীলতা নিহিত।

লেখক: অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: ১. অ্যান ইলাস্ট্রেটেড গাইড টু রিলেটিভিটি, টাটসু টাকেউচি

২. ফিজিকস পেইজেস ডটকম

৩. স্পেশাল রিলেটিভিটি, এ পি ফ্রেঞ্চ