যেভাবে সংরক্ষণ করা হয় প্রতিপদার্থ

প্রতীকী ছবি

প্রতিপদার্থ। মানে অ্যান্টিম্যাটার। পদার্থের সঙ্গে সামান্যতম স্পর্শেই ধ্বংস হয়ে যায়। এ যেন সর্বধ্বংসী। পৃথিবীর সবকিছু তো পদার্থ দিয়েই তৈরি। তাহলে, অ্যান্টিম্যাটার কি কোনোভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব? সংরক্ষণ করতে না পারলে এ নিয়ে গবেষণা করা হবে কী করে? ঘুরেফিরে আবার তাই সেই প্রশ্নটিই আসে—এমন কিছু সংরক্ষণের উপায় কী? (অ্যান্টিম্যাটার নিয়ে আরও জানতে পড়ুন: অ্যান্টিম্যাটার: বাস্তব নাকি কল্পনা)

এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করেন অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ ব্রুনো টুশ্চেক। তিনি ভাবলেন, একে এমন কোনো দেয়ালের ঘেরে আটকাতে হবে, যার মধ্যে আর যা-ই থাকুক, কোনো পদার্থ থাকবে না। সমাধান—ভ্যাকুয়াম। এই ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থানকে পৃথিবীর বাইরের, অর্থাৎ মহাশূন্যের ভ্যাকুয়ামের চেয়ে আরও কার্যকর হতে হবে। কারণ এই ভ্যাকুয়ামে কোনো পদার্থ না থাকলেও, থাকতে হবে তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রই প্রতিপদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটারকে আটকে রাখবে।

সার্নের কণা ত্বরক যন্ত্র

সার্নের মতো কণাপদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারে এটা আজ সম্ভব। কীভাবে? একটা প্রস্তাবনা হলো, দীর্ঘ এক চুম্বক-রিং বানানো। এর মধ্যে পজিট্রন বা কোনো প্রতিপদার্থের কণা চাইলে ইচ্ছেমতো ছুট দিতে পারে। এই রিংয়ের মধ্যকার জায়গাটাই সেই শূন্য বা ভ্যাকুয়াম—সর্বধ্বংসী প্রতিপদার্থকে আটকে রাখার জেলখানা। যতক্ষণ বিদ্যুৎশক্তি দিয়ে এই রিংয়ের চৌম্বকক্ষেত্র সচল রাখা হবে, ততক্ষণ প্রতিপদার্থ ভ্যাকুয়ামের দেয়ালে ধাক্কা খেতে পারবে না। ফলে এগুলো দিব্যি টিকে থাকবে। আসলেই ২০-৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ রিং-এর পুরোটা চুম্বক দিয়ে বানানো ঠিক বাস্তব চিন্তা নয়। সত্যিটা হলো, এর প্রয়োজনও নেই।

সার্নে সে জন্য এরকম একটি বিশাল রিং বানানো হয়েছিল, এলইপি—লার্জ ইলেকট্রন-পজিট্রন কলাইডার। এটা বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অর্জনগুলোর একটি। এতে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে ছুটে চলা প্রতিপদার্থের বিম বা রশ্মিকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত (আলোর বেগ সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার)। এর পেছনের মূল যে আইডিয়া ও প্রযুক্তি, তা প্রথম জানা যায় এই ব্রুনো টুশ্চেকের হাত ধরেই। সে সময় কেউ বুঝতে পারেনি, এর মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে প্রতিপদার্থ সংরক্ষণাগার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কথা। হ্যামবুর্গে রাডার নিয়ে কাজ করছেন টুশ্চেক। তাঁর এক নরওয়জিয়ান সহকর্মী ছিলেন, রল্ফ ওয়াইডেরো। বিশ বছর আগে তিনি একটা আইডিয়ার কথা ভেবেছিলেন। তুলনামূলক কম ত্বরণের ভোল্টেজ দিয়ে কোনো কণাকে একটু পরপর কয়েকবার ধাক্কা দিলে সেটার মধ্যেও ত্বরণ তৈরি হবে। ওয়াইডেরোর পরীক্ষায় দেখা গেল, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র কণাদের সরল রেখায় ত্বরিত করে। এর পরের কাজটা করলেন মার্কিন বিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্স। তিনি চুম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে কণাদের গতিপথকে বৃত্তাকার পথে রূপ দিলেন। ফলে বৃত্তের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ধাক্কা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেই হলো। কণাগুলো একই পথ ধরে বারবার ঘুরবে এবং প্রতিবার ধাক্কা খেয়ে এর ত্বরণ বাড়তে থাকবে। লরেন্স এর নাম দিলেন ‘সাইক্লোট্রন’। এর মধ্য দিয়ে ‘উচ্চশক্তি নিয়ে কাজ করে’—এমন এক আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্ম হলো। ইংরজিতে এটিকে বলে হাই এনার্জি ফিজিকস। এ জন্য লরেন্স নোবেল পুরস্কার পান। আধুনিক কণা-ত্বরক যন্ত্রগুলোও ওয়াইডেরোর সেই আইডিয়ার ওপরে ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে। আর এর পরবর্তী আইডিয়ার হাত ধরেই বাঁধা পড়েছে প্রতিপদার্থ।

রল্ফ ওয়াইডেরো

১৯৪৩ সালে ওয়াইডেরো একটা প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করেন। একই কক্ষপথ ধরে বিপরীত দিকে ছুটে চলা কণাদের সংরক্ষণ করা এবং এদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানোর একটি পদ্ধতি বের করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর প্যাটেন্টের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, এই পদ্ধতি নাকি খুব অবশ্যম্ভাবী। যে কেউ একটুখানি মাথা খাটালেই এটা বুঝতে পারবে। অথচ প্রথমবারের মতো এই পদ্ধতি অন্য কারো মাথা খাটিয়ে ব্যবহার করতে করতে লেগে যাবে আরো পনের বছর।

দুটো কণাকে যদি পরস্পরের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়, সংঘর্ষের চেয়ে এদের পরস্পরকে মিস করা বা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু যদি অনেকগুলো কণাকে কোনোভাবে একত্রে সংরক্ষণ করা হয় ও প্রয়োজনমতো সময়ে এই দুই তীব্র রশ্মিকে (অনেকগুলো কণা একসঙ্গে মিলে রশ্মি তৈরি করে) পরস্পরের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা রশ্মির মধ্যকার কিছু কণার মধ্যে অন্তত সংঘর্ষ ঘটবে।

এ আইডিয়ার প্রথম ব্যবহার দেখা গেল ১৯৫৯ সালে। মার্কিন একটি দল দুটো ‘সংরক্ষণাগার রিং’ বানাল। চুম্বক ব্যবহার করে বানানো এই রিংগুলোতে চৌম্বকক্ষেত্র ইলেকট্রনের পথ বাঁকিয়ে দেবে। ফলে ইলেকট্রন রিংয়ের মধ্যে বৃত্তাকার পথে ঘুরবে। দুটো রিংয়ের একটায় ইলেকট্রন ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আরেকটায় ঘুরবে বিপরীত দিকে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু করা হয়নি। কেবল চৌম্বকক্ষেত্রের দিকটুকু উল্টে দেওয়া হয়েছে।

এই যখন অবস্থা, টুশ্চেকের তখন ওয়াইডেরোর সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক কথোপকথনের কথা মনে পড়ে গেল। এরই সূত্র ধরে তাঁর মাথায় উঁকি দিয়ে গেল একান্ত নিজস্ব একটি আইডিয়া। ইলেকট্রনের প্রতিকণা পজিট্রন। দুটোর ভর এক, কিন্তু চার্জ বিপরীত। অর্থাৎ এদের চার্জের চিহ্ন বিপরীত। মানে, যে চৌম্বকক্ষেত্র ইলেকট্রনকে ডানে ঘুরাবে, তা পজিট্রনকে অবশ্যই বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দেবে। দুই সেট চুম্বক ব্যবহার করে ইলেকট্রনদের পরস্পর বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে যে সংঘর্ষ ঘটাতে হয়, ইলেকট্রন-পজিট্রনের ক্ষেত্রে সেই একইরকম সংঘর্ষ ঘটাতে চুম্বক লাগবে মাত্র এক সেট। যেহেতু এদের একটা নির্দিষ্ট বল দিয়ে ঘুরানো হবে, তার মানে এরা পরস্পর বিপরীত দিকে ঘুরে গেলেও ঘোরার পরিমাণ হবে সমান। এভাবে নিশ্চিতভাবেই এরা একই কক্ষপথ ধরে ছুটে যাবে এবং বৃত্তাকার পথ ঘুরে এসে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হবে।

রোমের কাছে অবস্থিত ফ্র্যাসক্যাটি গবেষণারের একদল সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ব্রুনো টুশ্চেক অ্যানেলো দ্য’অ্যাকুমুল্যাজিওনের নকশা ও নির্মাণকাজ সম্পন্ন করলেন। ইতালিয়ান এই শব্দটির ইংরেজি অর্থ হলো ‘অ্যাকুমুলেশন রিং’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, পর্যায়ক্রমিক সংরক্ষণাগার রিং। মানে, এর মধ্যে কণারা ধীরে ধীরে জমা হবে। পুরো জিনিসটির ব্যাস মাত্র এক মিটার। সফলভাবেই ইলেকট্রন ও পজিট্রন জমা করতে পেরেছিলেন তাঁরা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রতিকণাকে আটকানো হলো। ছোট্ট এই যন্ত্রটিকে চাইলেই সুটকেসে আঁটানো যেত। এভাবেই জিনিসটা নিয়ে আসা হলো প্যারিসের অরস্যেতে। এখানে আরও শক্তিশালী ইলেকট্রন রশ্মি তৈরির ব্যবস্থা ছিল।

১৯৬৩ সালে এখানেই প্রথমবারের মতো আরও শক্তিশালী পজিট্রন রশ্মি জমা করে, ইলেকট্রন রশ্মির দিকে ছুড়ে দেওয়া হলো। মাঝেমধ্যে রশ্মির মধ্যকার কিছু ইলেকট্রন-পজিট্রনের মধ্যে সংঘর্ষ হতো। তারা মুহূর্তের মধ্যে পরস্পরকে ধ্বংস করে দিত। তার মানে, এখন চাইলে যা ইচ্ছে, তাই করা যাবে। প্রতিকণা জমাতে চাইলে, সেই উপায়ও আছে। আবার, এদের পদার্থের কণার সঙ্গে সংঘর্ষ করিয়ে ধ্বংস করে ফেলতে চাইলে করা যাবে তাও।

এরকম যন্ত্র যে কাজ করে, তা আমাদের পদার্থ এবং প্রতিপদার্থের মধ্যকার দারুণ এক প্রতিসাম্যের কথা বলে।

পরের ত্রিশ বছরে পদার্থবিজ্ঞানীরা ইলেকট্রন ও পজিট্রনের জন্য আরও, আরও বড় সংরক্ষণাগার রিং তৈরি করেছেন। পরবর্তীতে উৎপাদিত রশ্মিগুলোও ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী। এদেরকে বারবার সংঘর্ষ করিয়ে, ধ্বংস করে করে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং পদার্থের প্রকৃতির ব্যাপারে আরও জানার জন্য এটি দারুণ এক উপায়। এরকম বেশ কিছু ব্রেক-থ্রু বিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কারও এনে দেয়। এখন পর্যন্ত এরকম অন্যতম বড় যন্ত্রটি বানানো হয়েছে সার্নে—এলইপি। লেখার শুরুতে এটির কথাই বলা হয়েছে। ১৯৮৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সক্রিয় হয় এটি। কালে কালে আরও উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি। ফলে ২০০১ সালে এটি ভেঙে ফেলা হয়। একই টানেলে বানানো হয় আরও উন্নত নতুন কণাত্বরক—এলএইচসি বা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার। এতে পদার্থ ও প্রতিপদার্থ—দুই ধরনের কণা-ই ত্বরাণ্বিত করা যায়, পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায় এসব নিয়ে।

এরকম যন্ত্র যে কাজ করে, তা আমাদের পদার্থ এবং প্রতিপদার্থের মধ্যকার দারুণ এক প্রতিসাম্যের কথা বলে। ইলেকট্রন এবং পজিট্রন রশ্মি এলইপির চারপাশ ধরে বারবার ঘুরে আসে। তারপর সময়মতো এরা রঁদেভু বিন্দুতে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ থেকে নিয়ন্ত্রণকারী চৌম্বক বলের প্রতি এদের একইরকম সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়। একেবারে সমান ও বিপরীত বৈদ্যুতিক চার্জ এবং সমান ভরই এদের পূর্বনির্ধারিত পথ ধরে বিপরীত দিকে ছুটতে বাধ্য করে।

প্রতিপদার্থ সংরক্ষণের আরও বেশ কিছু উপায় আছে। যেমন পেনিং ট্র্যাপ। প্রায় সবগুলোতেই চৌম্বকক্ষেত্র ও ভ্যাকুয়ামের ব্যবহার দেখা যায়। অর্থাৎ মূল বিষয়টি প্রায় এক, তবে প্রক্রিয়াগুলো ভিন্ন। এই পদ্ধতি আরও উন্নত করে আরও বেশি পরিমাণে প্রতিপদার্থ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা বর্তমানে।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া

অ্যান্টিম্যাটার/ ফ্র্যাঙ্ক ক্লোজ