নিউক্লিয়ার বলের কাহন (পর্ব ৩)

দুটি চার্জ পরস্পরের ওপর একধরনের বল প্রয়োগ করে। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা হয় বলক্ষেত্র বা ‘ক্ষেত্র’ দিয়ে। তাহলে বলক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে কি ভরবেগ প্রবাহিত হয়? ক্ষেত্ররহস্য, হিদেকি ইউকাওয়া ও মেসন আবিষ্কারের কাহিনি...

ধরা যাক, আমরা একটি খালি বাক্সের ভেতর দুটি চার্জ রাখলাম, যাদের নাম দিলাম X ও Y। সেই দুটি চার্জ যে একই, মানে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। চার্জিত হওয়ায় তারা পরস্পরের ওপর বল প্রয়োগ করবে, এটা কুলম্ব (ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস-অগাস্তিন দে কুলম্ব) সাহেবের উদ্‌ঘাটন।

ধরে নিই, এ দুটি চার্জের ওপর আর কোনো বল কাজ করছে না। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র আমাদের শেখায়, এ ক্ষেত্রে বাক্সের মোট ভরবেগ সংরক্ষিত হবে। কিন্তু আমরা যদি এই বাক্সকে দুই ভাগে ভাগ করি, যার প্রতিটি ভাগে একটি করে চার্জ আছে, তাহলে দেখব, X চার্জ যেমন Y চার্জের ওপর বল প্রয়োগ করছে, ঠিক তেমনি (নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী) Y চার্জ X চার্জের ওপরও সমান ও বিপরীত বল প্রয়োগ করছে। কিন্তু আমরা জানি, কোনো কিছুর ওপর বল প্রয়োগ করার মানে হলো তাতে ভরবেগের পরিবর্তন ঘটানো। অন্যদিকে X ও Y চার্জ নিয়ে গড়া পুরো সিস্টেমের ভরবেগের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এ সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারি, যদি চিন্তা করি যে এক চার্জ থেকে অন্য চার্জের মধ্যে ভরবেগের প্রবাহ ঘটছে। এই ‘প্রবাহিত’ ভরবেগ তাহলে কে নিয়ে যাচ্ছে? চিরায়ত বিজ্ঞানের ধারণায় চার্জ দুটি একে অপরের তৈরি করা বৈদ্যুতিক বলক্ষেত্রের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। তাহলে কি বৈদ্যুতিক বলক্ষেত্র আদতে ভরবেগ বহন করে? এ প্রশ্নের আংশিক উত্তর যদিও আইনস্টাইনের দেওয়া ফটো–ইলেকট্রিক ইফেক্টে ফোটনিক ব্যাখ্যার মধ্যে পাওয়া যায়, এর কোনো সরাসরি প্রমাণ ল্যাবে করা কোনো পরীক্ষায় বেশ কিছুদিন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। এর প্রমাণ মেলে আর্থার কম্পটনের করা ধাতব ক্রিস্টালের ওপর আপতিত এক্স-রের বিক্ষেপণ (scattering) দেখে। একটু ব্যাখ্যা করি।

দু’টি চার্জের মাঝে ভরবেগের আদানপ্রদানের জন্য দায়ী কে?

আইনস্টাইনের ফোটনের ধারণায় শুধু শক্তির নিত্যতার সূত্র ব্যবহার করে ক্ষারীয় ধাতু থেকে অবমুক্ত ইলেকট্রনের শক্তির মান নির্ণয় করা হচ্ছিল, যার ধর্ম মিলে গিয়েছিল পরীক্ষণের সঙ্গে, কিন্তু সেটা ফোটনীয় ধারণার নিশ্ছিদ্র প্রমাণ নয়। কারণ, শক্তি ছাড়া ভরবেগের নিত্যতার সূত্র রয়ে গেছে। সেটার প্রমাণ পাওয়ার জন্য আপতিত ফোটনকণার দিকও জানা প্রয়োজন ছিল, যা আগের পরীক্ষাগুলোয় আমলে নেওয়া হয়নি। এই পরীক্ষার পরপরই ফোটন যে আসলেই একটা কণা, যা বস্তুকণার মতোই শক্তি ও ভরবেগ বহন করে, এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না। এখন যে ধারণা এর মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানীদের মাথায় আসন পেতে থাকল, তা হলো, কোনো বলক্ষেত্রকে (যেমন বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ক্ষেত্র) কোয়ান্টায়িত করলে (এর প্রক্রিয়াটি যে আসলে কী, তার ব্যাখ্যা একেক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে একেক রকম পাওয়া যাবে) শেষতক একপ্রকার কণা পাওয়া যাবে, যা শক্তি ও ভরবেগ বহন করবে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানী ইউকাওয়া দেখালেন, এই কণাগুলোকে ভরযুক্ত হতে হবে। কারণ, এর আগেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন, যে দূরত্ব পর্যন্ত এই বলের প্রভাব রয়ে যায়, তা যে কণা বিনিময় করা হয়, তার ভরের বিপরীত আনুপাতিক (বা ব্যস্তানুপাতিক)।

কথায় বলে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়’। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত আমরা শুধু মাধ্যাকর্ষণ আর বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। এখন থেকে আমরা ‘বলক্ষেত্র’ শব্দটি ব্যবহার না করে শুধু ‘ক্ষেত্র’ শব্দটি ব্যবহার করব। ফোটন আবিষ্কৃত হলেও মাধ্যাকর্ষণের কোয়ান্টাম কণা হিসেবে গ্র্যাভিটনের কথা অনেকেই চিন্তা করতে লাগলেন। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ এত দুর্বল একটা বল, এর সপক্ষে প্রমাণ দাঁড় করানো বিজ্ঞানীদের পক্ষে সে সময় আসলেই অসম্ভব ছিল। এ যেন গুহামানবকে বলা, ‘পরমাণুর প্রমাণ দাও!’ এর পাশাপাশি ফোটনকে যেমন বিভিন্ন প্রসঙ্গকাঠামো (Inertial Frame) থেকে একইভাবে বর্ণনা করা যায় (এর মানে হচ্ছে, সবাই বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় কোনো ঘটনার একটি একীভূত বয়ান দিতে পারবেন), মাধ্যাকর্ষণের ক্ষেত্রে এই ব্যাপার খাটে না।

দুটি প্রোটন বা নিউট্রনের মাঝে মেসন আদানপ্রদানের ফাইনম্যানীয় চিত্র

বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ক্ষেত্র ও মাধ্যাকর্ষণ ছাড়া কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের ধারণা যে প্রযোজ্য হতে পারে, তার প্রমাণ মিলল জাপানি পদার্থবিদ হিদেকি ইউকাওয়ার হাতে। তিনি চিন্তা করলেন, যেভাবে দুটি বৈদ্যুতিক চার্জ ফোটন আদান–প্রদানের মাধ্যমে পরস্পরের ওপর আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল প্রয়োগ করে, ঠিক তেমনি কোনো প্রকার কণার আদান–প্রদানের মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের মাঝের প্রোটন বা নিউট্রনের মধ্যে নিউক্লীয় আকর্ষণের উদ্ভব ঘটে। বিজ্ঞানী ইউকাওয়া দেখালেন, এই কণাগুলোকে ভরযুক্ত হতে হবে। কারণ, এর আগেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন, যে দূরত্ব পর্যন্ত এই বলের প্রভাব রয়ে যায়, তা যে কণা বিনিময় করা হয়, তার ভরের বিপরীত আনুপাতিক (বা ব্যস্তানুপাতিক)। ফোটনের ভর প্রায় শূন্য হওয়ায় বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার প্রভাব অসীম দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। ইউকাওয়া জানতেন, নিউক্লীয় বলের প্রভাব নিউক্লিয়াসের বাইরে অনুভূত হয় না, সেটাকে হিসাবে নিয়ে তিনি নিউক্লীয় বলের কোয়ান্টাম কণার ভরের হিসাব দিলেন, যার মান প্রায় ইলেকট্রনের ভরের ২০০ গুণ। যেহেতু এই মান প্রোটন বা নিউট্রনের ভর ও ইলেকট্রনের ভরের মাঝামাঝি, তাই এই কণার নাম দেওয়া হলো মেসন। কিন্তু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা যতই গাণিতিক কলাকৌশল ব্যবহার করুন না কেন, তার অনেকাংশজুড়েই থাকে অনুমান (না, এটা ‘আমি তো মনে করলাম’–জাতীয় কোনো কিছু নয়), শুধু পরীক্ষণ দিয়েই এটি সঠিক কি না, তা যাচাই করা যায়।

আইনস্টাইনের ফোটনের ধারণায় শুধু শক্তির নিত্যতার সূত্র ব্যবহার করে ক্ষারীয় ধাতু থেকে অবমুক্ত ইলেকট্রনের শক্তির মান নির্ণয় করা হচ্ছিল, যার ধর্ম মিলে গিয়েছিল পরীক্ষণের সঙ্গে, কিন্তু সেটা ফোটনীয় ধারণার নিশ্ছিদ্র প্রমাণ নয়।

১৯৩৫ সালে ইউকাওয়া এই মেসনের ধারণা সামনে নিয়ে এলেও সে সময় নিউক্লিয়াসের মধ্য থেকে এই মেসনকণাগুলো সরাসরি বের করে নিয়ে আসার মতো কৌশল বিজ্ঞানীদের হাতে ছিল না। এর অব্যবহিত পরই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা ভারী মৌল, যেমন ইউরেনিয়ামের ফিশনপ্রক্রিয়া কীভাবে করতে হয়, তা শিখে ফেললেন এবং নিউক্লিয়াসকেও টুকরা করার কৌশল তাঁদের আয়ত্তে এল। কিন্তু ইউকাওয়ার মেসনকে বিজ্ঞানীরা সরাসরি নিউক্লিয়াস থেকে আবিষ্কার করেননি। তাঁদের তাকাতে হয়েছে একভাবে বললে আকাশের দিকে। গল্পের এ পর্ব আরেকটি সম্পূর্ণ ভিন্নধারা থেকে শুরু হয়েছে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারব, বিজ্ঞানে আমরা যা আবিষ্কার করি বা শিখি, তা সব সময় একরৈখিক নয়। সে জন্য বিজ্ঞানীদের নিজের গবেষণার ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরেও অন্যরা কী নিয়ে কাজ করছেন, তার কিছু হালকা জ্ঞান রাখতে হয়।

লেখক: অধ্যাপক, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন