স্ট্যান্ডার্ড মডেল: সহজ পাঠ

স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো পদার্থবিজ্ঞান তথা কণাপদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্বছবি: সার্ন
মৌলিক কণাগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এদের একভাগকে বলা হয় ফার্মিয়ন, আরেক ভাগের নাম বোসন। ফার্মিয়ন কণার নামকরণ করা হয়েছে ইতালিয়ান পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির নামে। অন্যদিকে বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন বোসের নামে নামকরণ করা হয়েছে বোসন কণাদের।

শুরুতেই বলে রাখি, এই লেখা বিজ্ঞাপন বা ফ্যাশনের কোনো সুপার মডেলকে নিয়ে নয়। কাজেই সুন্দরী মডেলপ্রেমীরা হতাশ হওয়ার আগে এখানেই ক্ষান্ত দিতে পারেন। আসলে স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো পদার্থবিজ্ঞান তথা কণাপদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব, যার কাজকারবার মহাবিশ্বের গাঠনিক একক নিয়ে। গ্যালাক্সি, নক্ষত্র থেকে শুরু করে মানুষসহ সবকিছু কী দিয়ে তৈরি এবং সেগুলো কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে—সেসব ব্যাখ্যা ও আলাপ-আলোচনা করা হয় এতে। বাংলায় একে অনেকে বলেন প্রমিত মডেল।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল গড়ে উঠেছিল গত শতকের ৭০ দশকের মাঝামাঝি। এটি গড়ে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে শেলডন গ্ল্যাশো, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, আব্দুস সালামসহ আরও অনেক বিজ্ঞানীর। এ তত্ত্ব অনুসারে, আমাদের চেনা মহাবিশ্বের সব কিছু চূড়ান্তভাবে মাত্র ১২টি বস্তুকণা দিয়ে গঠিত হয়েছে। এসব কণা পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে মাত্র তিনটি বলের মাধ্যমে। এ বলগুলোকে বলা হয় নন-গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স বা অমহাকর্ষীয় বল। কারণ প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বাদে অন্য তিনটি নিয়ে কাজকারবার চলে এ মডেলে। সেই বল তিনটি হলো: বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, শক্তিশালী পারমাণবিক বল এবং দুর্বল পারমাণবিক বল। এ ছাড়া পুরো ব্যবস্থাটা বিশেষ একটা কণা দিয়ে বাঁধা থাকে, যাকে বলা হয় হিগস-বোসন কণা। একে একে আমরা এসব বিষয়ে আলোচনা করব।

এ মডেলে মৌলিক কণাগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এদের একভাগকে বলা হয় ফার্মিয়ন, আরেক ভাগের নাম বোসন। ফার্মিয়ন কণার নামকরণ করা হয়েছে ইতালিয়ান পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির নামে। অন্যদিকে বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন বোসের নামে নামকরণ করা হয়েছে বোসন কণাদের। সহজভাবে বললে, ফার্মিয়ন হলো বস্তুকণা। যেমন ইলেকট্রন। আর বোসন হলো বস্তুকণাদের মধ্যে বলের বাহক। যেমন ফোটন। দুনিয়ায় সবকিছুই হয় ফার্মিয়ন, নয়তো বোসন কণা। মোটা দাগে এই দুই কণার মধ্যে পার্থক্য হলো, ফার্মিয়ন কণা পাউলির বর্জন নীতি বা এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল মেনে চলে।

কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল
গ্রাফিক্স: বিজ্ঞানচিন্তা
আপনি, আমি এবং আমাদের চারপাশের সবসহ মহাবিশ্বের পরিচিত সব কিছুই তৈরি হয়েছে মাত্র তিনটি ফার্মিয়নের পারমুটেশন ও কম্বিনেশনে। সেই তিনটি ফার্মিয়নের নাম ইলেকট্রন, আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক।

এ নীতি অনুসারে, একইরকম দুটি ফার্মিয়ন একই জায়গা দখল করতে পারবে না। যেমন দুটি ইলেকট্রন পরমাণুর একই জায়গায় থাকতে পারে না। তাদের অবশ্যই ভিন্ন অবস্থানে থাকতে হবে। সে হিসেবে ফার্মিয়নকে অসামাজিক বা অমিশুক বলা চলে। বিপরীতে বোসনের জন্য পাউলির বর্জন নীতি প্রযোজ্য নয়। তাই এ কণাগুলো বেশ মিশুক। কারণ ফোটনের মতো বোসন কতটা একে-অপরের ওপরে গাদা করে থাকতে পারবে, তার সীমা-পরিসীমা নেই। যেমন লেজার আলোয় অসংখ্য ফোটন একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে।

প্রথমে ফার্মিয়নের কথা বলা যাক। ফার্মিয়ন দুইভাগে বিভক্ত: কোয়ার্ক এবং লেপটন। এর মধ্যে রয়েছে ৬টি কোয়ার্ক এবং ৬টি লেপটন কণা। ৬টি কোয়ার্ক হলো: আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্ম, বটম এবং টপ কোয়ার্ক। আর ৬টি লেপটন হলো: ইলেকট্রন, ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন, মিউয়ন নিউট্রিনো, টাউ এবং টাউ নিউট্রিনো।

তবে আপনি, আমি এবং আমাদের চারপাশের সবসহ মহাবিশ্বের পরিচিত সব কিছুই তৈরি হয়েছে মাত্র তিনটি ফার্মিয়নের পারমুটেশন ও কম্বিনেশনে। সেই তিনটি ফার্মিয়নের নাম ইলেকট্রন, আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক। তিনটি কোয়ার্ক একত্রে গুচ্ছবদ্ধ হয়ে প্রোটন ও নিউট্রন তৈরি করে। তবে যেকোনো কোয়ার্ক একত্রিত হলে চলবে না, সুনির্দিষ্ট কোয়ার্ক হতে হবে। যেমন প্রোটন তৈরির জন্য দরকার দুটি আপ কোয়ার্ক এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক। অন্য দিকে একটি আপ কোয়ার্ক এবং দুটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় নিউট্রন।

এদিকে প্রোটন ও নিউট্রন একত্রিত হয়ে তৈরি করে পরমাণুর নিউক্লিয়াস। এর সঙ্গে ইলেকট্রন যুক্ত হলে গঠিত হয় পূর্ণাঙ্গ পরমাণু বা অ্যাটম। প্রাকৃতিকভাবে মহাবিশ্বে ৯২টি পরমাণু পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে হালকা পরমাণু হাইড্রোজেন থেকে শুরু করে সবচেয়ে ভারী পরমাণু ইউরেনিয়াম। এ ছাড়া কৃত্রিমভাবে বেশ কটি পরমাণু তৈরি করা যায়। সবমিলিয়ে পরমাণুর সংখ্যা ১১৮টি।

আরও পড়ুন
কোয়ার্কের বাইরে যেসব কণা থাকে, সেগুলোকে বলা হয় লেপটন। যেমন ইলেকট্রন, মিউয়ন, টাউ হলো লেপটন কণা। আর কোয়ার্ক কণারা একত্রিত হয়ে যে যৌগিক কণা গড়ে তোলে, তাদের বলা হয় হ্যাড্রন।

মহাবিশ্বের গাঠনিক উপাদানকে এই তিনটি মৌলিক কণা—অর্থাৎ আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক এবং ইলেকট্রন দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তবে এর বাইরে চতুর্থ আরেকটি কণা আছে, যা ইলেকট্রনের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ ভাগ হালকা। সেই কণাটিই নিউট্রিনো (নিউট্রন নয়)। এ কণাটিও চরম অসামাজিক। কারণ অন্য কণার সঙ্গে এর মেলামেশা বা মিথস্ক্রিয়া  বিরল৷ কোনোকিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করায় একে শনাক্ত করা খুব কঠিন। তাই একে ভুতুড়ে কণাও বলা হয়। প্রতি মুহূর্তে আপনার দেহের ভেতর দিয়ে কোটি কোটি নিউট্রিনো কণা চলে যাচ্ছে। আসলে সূর্যের ভেতর পারমাণবিক বিক্রিয়ার উপজাত হিসেবে বেরিয়ে আসে নিউট্রিনো। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময়ও বিপুল পরিমাণ নিউট্রিনো কণা তৈরি হয়েছিল। এক কথায় বলা যায়, গোটা মহাবিশ্ব এই ভুতুড়ে কণায় ডুবে আছে। প্রাচুর্যের দিক থেকে আলোর কণা ফোটনের পর মহাবিশ্বে এর অবস্থান দ্বিতীয়।

কণাদের এই মিছিল যদি এই চারটি কণাতেই থেমে যেত, তাহলে আমাদের কাছে মহাবিশ্বের সবকিছু হতো অনেক সরল-সোজা। মহাবিশ্বকে বুঝতে এত কাঠখড় পোড়াতে হতো না। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা ঘটেনি। কোনো রহস্যময় কারণে মহাবিশ্বে এই চারটি কণার আরও বাড়তি দুটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। এ দুই প্রজন্মের কণাগুলোর সঙ্গে প্রথম প্রজন্মের কণাদের প্রধান পার্থক্য হলো, প্রথম প্রজন্মের চেয়ে সেগুলো অনেক বেশি ভারি। কাজেই প্রথম প্রজন্মে যেমন ইলেকট্রন, আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক এবং নিউট্রিনো থাকে, সেখানে দ্বিতীয় প্রজন্মের কণাগুলো হলো মিউয়ন, স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক, চার্ম কোয়ার্ক এবং মিউয়ন নিউট্রিনো। আর তৃতীয় প্রজন্মে থাকে টাউ, বটম কোয়ার্ক, টপ কোয়ার্ক এবং টাউ-নিউট্রিনো কণা। মিউয়নের ধর্ম হুবহু ইলেকট্রনের মতো। তবে সেটা ইলেকট্রনের চেয়ে ২০৭ গুণ ভারি। আবার টাউয়ের ভর ইলেকট্রনের চেয়ে আরও বেশি। প্রায় ৩ হাজার গুণ।

আগেই বলেছি, কোয়ার্কের বাইরে যেসব কণা থাকে, সেগুলোকে বলা হয় লেপটন। যেমন ইলেকট্রন, মিউয়ন, টাউ হলো লেপটন কণা। আর কোয়ার্ক কণারা একত্রিত হয়ে যে যৌগিক কণা গড়ে তোলে, তাদের বলা হয় হ্যাড্রন। যেমন প্রোটন ও নিউট্রন হলো হ্যাড্রন। জানেন নিশ্চয়ই, ইউরোপে সার্নের বিশালাকৃতির কণাত্বরক যন্ত্রের নাম লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার। কারণ প্রায় ২৭ কিলোমিটার বৃত্তাকার বিশাল যন্ত্রটি দিয়ে হ্যাড্রনকে ভেঙেচুরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।

প্রশ্ন জাগতে পারে, বস্তুকণাদের প্রজন্ম তিনটি কেন? সেই প্রশ্ন পদার্থবিদদেরও। তাঁরাও এর উত্তর এখনও জানেন না। যেমন মিউয়ন আবিষ্কৃত হয় ১৯৩৬ সালে। কণাটি ভারী এবং অস্থিতিশীল। খুব দ্রুত সেটি ক্ষয় হয়ে আমাদের পরিচিত কণায় পরিণত হয়। এটি অনেক ভারী হওয়ায় এদের তৈরি করাও কঠিন এবং শক্তিও লাগে অনেক বেশি। বর্তমানে শুধু কণাত্বরক যন্ত্রে এবং উচ্চশক্তির মহাজাগতিক রশ্মিতে এই কণার দেখা মেলে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিস্ফোরণের সময় অতি উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে এ কণা তৈরি হয়েছিল এবং বর্তমানের মহাবিশ্ব গড়ে তুলতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত আরও অনেক প্রশ্নের জবাব বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

আমরাসহ মহাবিশ্ব গড়ে ওঠা মৌলিক বস্তুকণার আলোচনা এটুকুই। এরপর আসে বোসন কণার প্রসঙ্গ। যদি প্রশ্ন আসে, এসব কণাকে একত্রে বেঁধে রাখে কোন বল? তাহলে তার জবাব দেয় বোসন কণা।

আরও পড়ুন
প্রকৃতির চারটি বলের মধ্যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলই আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত। একে তড়িৎচুম্বকীয় বলও বলেন অনেকে। এটি পদার্থের পরমাণুকে একত্রে বেঁধে রাখে। অর্থাৎ নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনকে।

বস্তুকণাদের একত্রিত রাখার পেছনে কাজ করে প্রকৃতির তিনটি মৌলিক বল। সেগুলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, শক্তিশালী পারমাণবিক বল এবং দুর্বল পারমাণবিক বল। এদের প্রতিটির জন্যই রয়েছে সংশ্লিষ্ট বোসন কণা। এ কণারাই বল বহন করে। বিষয়টি সরলভাবে বোঝার জন্য দুজন টেনিস খেলোয়ারের কথা ভাবুন। তাঁরা র‍্যাকেট দিয়ে একটি বলে আঘাত করে এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে এক খেলোয়ার র‍্যাকেট দিয়ে বলটিতে আঘাত করে একটা বল (ফোর্স) টেনিস বলটির মধ্য দিয়ে অপরপ্রান্তে পাঠাচ্ছেন। বলাবহী কণারাও বস্তুকণাদের মধ্যে এভাবেই বল স্থানান্তর বা বিনিময় করে। তবে এটা একদম অতিসরলীকরণ, গোটা বিষয়টা আসলে আরও জটিল। তাই এভাবে পুরোটা বোঝা যাবে না।

প্রকৃতির চারটি বলের মধ্যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলই আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত। একে তড়িৎচুম্বকীয় বলও বলেন অনেকে। এটি পদার্থের পরমাণুকে একত্রে বেঁধে রাখে। অর্থাৎ নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনকে। শুধু তাই নয়, আমাদের বৈদ্যুতিক জগৎও গড়ে উঠেছে এই বলের ওপর ভর করে। পারমাণবিক ইলেকট্রন শেল বা কক্ষপথের কাঠামো, রাসায়নিক বন্ধন, ইলেকট্রিক সার্কিট এবং ইলেকট্রনিকসের মতো পরিঘটনার পেছনে দায়ী এই বলটি। যে কণার বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রিক চার্জ আছে, তার ওপর বলটি ক্রিয়া করে। কাজেই ইলেকট্রন-টাইপের কণা এবং কোয়ার্কের ওপর এটি ক্রিয়াশীল। তবে চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রনের ওপর বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের প্রভাব নেই। এ বলের বাহক কণা ফোটন। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এটাই সবচেয়ে দূরপাল্লার বল। ইলেকট্রোডাইনামিকস বা কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনাকসে (QED) এই বল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

পরের মৌলিক বলটি হলো শক্তিশালী বা সবল পারমাণবিক বল। ইংরেজিতে বলা হয় স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স। বলটি বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের চেয়ে প্রায় ১০০ (১০) গুণ, দুর্বল পারমাণবিক বলের চেয়ে ১০ গুণ এবং মহাকর্ষ বলের চেয়ে প্রায় ১০৩৮ গুণ বেশি শক্তিশালী। তবে এর শক্তি ১০-১৫ মিটার বা ১ ফেমটোমিটার পরিসরে সীমাবদ্ধ। লেপটন এবং কোয়ার্কের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য তৈরি হয় এ বলের কারণে। কারণ বলটি লেপটনের (যথা ইলেকট্রন, মিওয়ন, টাউ) ওপর কাজ করে না, স্রেফ কোয়ার্ক কণা ওপর ক্রিয়াশীল। তাই কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত প্রোটন ও নিউট্রনের ওপর কাজ করে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে একত্রে বেঁধে রাখে এটি। সেইসঙ্গে নিউক্লিয়ার ফিশন বা পারমাণবিক বিভাজন এবং পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে বেরিয়ে আসা বিপুল শক্তির জন্য দায়ী এ বল। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের বাহক যেমন ফোটন, তেমনি সবল বলের বাহক গ্লুয়ন। এ কণাও আছে ৮ ধরনের। ইলেকট্রন যে বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের উৎস হিসেব কাজ করে, তেমনি কোয়ার্ক কাজ করে গ্লুয়ন ক্ষেত্রের উৎস হিসেবে। তবে এই দুইয়ের মধ্যে গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও আছে। বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র ছড়িয়ে পড়ে বৃত্তাকারভাবে। অন্যদিকে একটা কোয়ার্ক সুতার মতো একটা পাতলা ফ্লাস্ক টিউব তৈরি করে, যা অন্য আরেকটি ভিন্ন ধরনের কোয়ার্কে গিয়ে শেষ হয়। এসব বিষয় ঘিরেই গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস বা কিউসিডি (QCD)।

আরও পড়ুন
স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সর্বশেষ টুকরো হলো হিগস-বোসন কণা। এটাই বস্তুকণা ও বলবাহী কণাসহ সবকিছুকে একত্রিত করে। কণাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্ট্যান্ডার্ড মডেলের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা সমাধান করে এটি।

কোয়ার্ক কণাগুলো ফ্লাক্স টিউবের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়ার কারণে তাদেরকে পরস্পর থেকে আলাদা করা অসম্ভব। তাই প্রকৃতিতে আলাদাভাবে বা একক কোয়ার্ক কখনই দেখা যায় না। এ কণাগুলো সবসময় প্রোটন ও নিউট্রনের মতো যৌগিক কণার মধ্যে একত্রিত থাকে।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সর্বশেষ বলটির নাম দুর্বল পারমাণবিক বল বা উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স। সবল বলের মতো এটাও কাজ করে শুধু অতিপারমাণবিক (আসলে উপপারমাণবিক) পরিসরে। দুর্বল বলই একমাত্র বল, যা সব কণার ওপর কাজ করে। এমনকি চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রনও এ বল অনুভব করে। তবে বলটি কণাদের একত্রে বেঁধে রাখার বদলে অন্য কাজ করে। সেটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোয়ার্কের পরিচয় পাল্টে দেয়। যেমন রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয় বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের ভেতর নিউট্রন চেহারা পাল্টে প্রোটনে পরিণত হয়। এ সময় দুর্বল বলের কারণে একটা নিউট্রনের ভেতরের ডাউন কোয়ার্ক রূপান্তরিত হয় আপ কোয়ার্কে। তাতেই এই বদল ঘটে।

সূর্য যে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় উত্তপ্ত হয়, তার পেছনেও এই দুর্বল বল দায়ী। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ যে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের কারণে উষ্ণ থাকে, যার কারণে এ গ্রহে প্রাণ বিকশিত হয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে এই বল। আবার পদার্থের ভারী প্রজন্মগুলো ক্ষয় হয়ে দ্রুত যে স্থিতিশীল ফার্মিয়নে পরিণত হয়ে আমাদের পরিচিত পদার্থ তৈরি করে, তারও কারণ দুর্বল বল।

বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের সঙ্গে যেমন ফোটন এবং শক্তিশালী বলের সঙ্গে যেমন গ্লুয়ন জড়িত, তেমনি দুর্বল বলের বাহক হিসেবেও বোসন রয়েছে। তবে এই বাহক একটি নয়, তিনটি। সেগুলো হলো: ডব্লিউ প্লাস, ডব্লিউ মাইনাস এবং ডেজ জিরো বোসন (W+, W- ও Z0)।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সর্বশেষ টুকরো হলো হিগস-বোসন কণা। এটাই বস্তুকণা ও বলবাহী কণাসহ সবকিছুকে একত্রিত করে। কণাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্ট্যান্ডার্ড মডেলের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা সমাধান করে এটি। সেটি হলো ভরের সমস্যা। আসলে সব ফার্মিয়ন কণাকে ভর যোগায় এই হিগস-বোসন কণা। কারণ ফার্মিয়নের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে হিগস-বোসন। কিন্তু ফোটন ও গ্লুয়নের সঙ্গে কোনো মিথস্ক্রিয়া না করায় এ কণাদের ভর নেই।

অবশ্য কাজটা হিগস-বোসন নয়, করে হিগস ক্ষেত্র। হিগস-বোসনই একমাত্র বোসন, যা কোনো বলের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে না। বিশ্বাস করাও কঠিন যে আমরা হিগস ফিল্ডে ডুবে আছি, কিন্তু এর অস্তিত্ব কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তা করে না। পর্যাপ্ত শক্তি যদি এই ক্ষেত্রের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে এ ক্ষেত্রটিতে যে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, সেটাই হিগস-বোসন। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর ২০১২ সালে এ কণা শনাক্ত করার ঘোষণা দেন সার্নের পদার্থবিদেরা। সুইজারল্যান্ডের জেনেভার কাছে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে এটি শনাক্ত করা হয়। এ কণার অস্তিত্বের কথা প্রথম অনুমান করেন পিটার হিগস, ১৯৬৪ সালে। তাই ২০১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।

আসলে হিগস-বোসন হলো হিগস ক্ষেত্রে একটা ঢেউ বা আলোড়নের মতো। ধানের ক্ষেতে বাতাসের কারণে ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় ব্যাপারটাকে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মৌলিক কণাগুলোও আসলে তাই। এসব কণা আসলে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রজুড়ে ঘনিয়ে ওটা ঢেউ, যা গোটা স্থানজুড়ে বিস্তৃত। সেখানে বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রও আছে, যার ঢেউয়ে তৈরি হয় ফোটন কণা। আছে ইলেকট্রন ফিল্ড, যার ঢেউ থেকে ইলেকট্রন তৈরি হয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব মতে, এসব ক্ষেত্র থেকেই শেষপর্যন্ত সবকিছু তৈরি হয়। সেগুলো জটিল এক নৃত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সমন্বয় করে। পাশাপাশি এটিই সবগুলো ক্ষেত্রের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে, যার ফলে কণাদের ভৌত জগৎ গড়ে ওঠে। কাজেই এসব ক্ষেত্র থেকে পদার্থ গড়ে ওঠে। আর স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির মূল বিষয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ মডেলকে একগুচ্ছ কণাদের ভাষায় বোঝা সম্ভব।

কাজেই সংক্ষেপে বলা যায়, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে ১২টি বস্তুকণা বা ফার্মিয়ন, ৪টি বলবাহী কণা (আসলে ১২টি) বা বোসন এবং হিগস-বোসন রয়েছে। মোট ১৭টি কণা। আরও ভালোভাবে বললে, সর্বমোট ২৫টি কণা (কারণ ৮টি গ্লুয়নসহ বোসন কণা মোট ১২টি)।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আরেকটা গুরুতর সমস্যা হলো, এর সঙ্গে প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ বল মহাকর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দুটোকে কীভাবে মেলানো সম্ভব বা আদৌ তা সম্ভব কি না, তার উত্তরও কারও জানা নেই। কণাসংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার কোনো সূত্র বা ক্লু মেলেনি।

৩.

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সফলতা ব্যাপক। কারণ গত ৪০০ বছরের বিজ্ঞানের ইতিহাসে এর মতো সফল কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দেখা মেলেনি। বিস্ময়করভাবে দশমিকের ১০ ঘর পর্যন্ত এর সফলতা পাওয়া যায়, যাকে বলা চলে অসাধারণ নির্ভুল ফলাফল। বিজ্ঞানে এরকম ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। এটা এত সফল যে অনেকের চোখে এর কোনো টুটা-ফাটাও চোখে পড়ে না। তারপরও এটি সঠিক নয় বলে সন্দেহ করেন বিজ্ঞানীরা। এর সমালোচনাতেও মুখর একদল বিজ্ঞানী। কারণ এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন তত্ত্বটা বলগুলোর আপেক্ষিক শক্তি এবং কণাদের ভর আগাম অনুমান করতে পারে না। যেমন ইলেকট্রনের চেয়ে টপ কোয়ার্কের ভর এক লাখ গুণ বেশি কেন? বস্তুর গাঠনিক একক বা মৌলিক কণাগুলোর প্রজন্ম তিনটি কেন? নিউট্রিনোর ভর এত কম কেন? এসব প্রশ্নের জবাব কণাপদার্থবিদ বা কণাপদার্থবিজ্ঞানের কাছে নেই।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আরেকটা গুরুতর সমস্যা হলো, এর সঙ্গে প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ বল মহাকর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দুটোকে কীভাবে মেলানো সম্ভব বা আদৌ তা সম্ভব কি না, তার উত্তরও কারও জানা নেই। কণাসংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার কোনো সূত্র বা ক্লু মেলেনি। কারণ অতিপারমাণবিক পরিসরে মহাকর্ষ এত দুর্বল যে একটা কণায় তার প্রভাব থাকে না। তবে মহাকর্ষের জন্য আলাদা তত্ত্ব রয়েছে। সেটা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এতে স্থান-কালের বক্রতার ভিত্তিতে মহাকর্ষ বলকে ব্যাখ্যা করা হয়। অন্য তিনটি বলকে বলবাহী কণার কোয়ান্টাম আদান-প্রদান হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলেও মহাকর্ষের বেলায় তা সম্ভব হয়নি। যেমন মহাকর্ষকে গ্র্যাভিটন নামে একটি কোয়ান্টাম কণার বিনিময় হিসেবে অনুমান করা হয়েছিল ব্যাখ্যার জন্য। কিন্তু এখনো এমন কোনো কণার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি। 

বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না, মহাবিস্ফোরণের আগের সেই অসীম ভর ও ঘনত্বের পরম বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি কিংবা কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের পরম বিন্দুকে স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন। কারণ ওই পরম বিন্দুতে কোয়ান্টাম মহাকর্ষীয় প্রভাব থাকে। কাজেই সেখানে এককভাবে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অকার্যকর। একইভাবে বর্তমান রূপে স্ট্যান্ডার্ড মডেলও এককভাবে সেখানে কাজ করে না।

মোদ্দা কথা হলো, কণা পদার্থবিজ্ঞানে স্ট্যান্ডার্ড মডেল মৌলিক কণা এবং তিনটি বলকে খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু মহাকর্ষের প্রসঙ্গ এলে তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এটা অনেক বড় একটি সমস্যা। আসলে পরম বিন্দুর ব্যাখ্যার জন্য আমাদের এই দুটো তত্ত্বকে একত্রিত করে ব্যবহার করতে হবে। সেটাকেই অনেকে বলেন কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব বা থিওরি অব এভিরিথিং।

তবে এ সমস্যাটাও ম্লান হয়ে যায় ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তুর কথা উঠলে। কারণ সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা গেছে, এ তত্ত্বটি মহাবিশ্বের মাত্র ৫ ভাগ ভর-শক্তির ব্যাখ্যা দিতে পারে। বাকি ৯৫ ভাগের কোনো ব্যাখ্যা এর কাছে নেই। নেই মানে আক্ষরিক অর্থেই নেই। এর মধ্যে ২৫ ভাগ অজানা বা উদ্ভট কোনো কণা দিয়ে তৈরি বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। (উদ্ভট, কারণ আমাদের চেনা-পরিচিত কোনো কণার মতো নয় সেগুলো। এমনকি সেগুলো আসলে কোনো কণা কি না, তাও আমরা জানি না।) আর বাকি ৭০ ভাগ অজানা ও রহস্যময় কোনো শক্তি, যাকে বলা হয় গুপ্তশক্তি বা ডার্ক এনার্জি। তাই মহাবিশ্বের সিংহভাগই আমাদের কাছে রহস্যের চাদরে ঢাকা। 

বুঝতেই পারছেন, মহাবিশ্বের খুব সামান্য অংশ নিয়ে কাজকারবার করে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। অর্থাৎ গোটা মহাবিশ্বকে যদি একটা বড় জিগস পাজল হিসেবে ধরা হয়, তাহলে এ মডেলটি ছোট্ট একটা টুকরোর কথা বলে। বা সমাধান দেয়। বাকি বিরাট একটি অংশ তখনও পড়ে থাকে এলোমেলো টুকরো হয়ে। সেই ধাঁধা মেলানোর সাধ্য আধুনিক বিজ্ঞানের নেই। কাজেই মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের বর্তমান বিজ্ঞানকে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ। 

সূত্র: দ্য গড ইকুয়েশন/ মিচিও কাকু

ওয়ান থিং ইউ নিড টু নো/ মার্কাস চোন

উইকিপিডিয়া