ভৌত ও লব্ধ রাশি কী, এদের কাজ কী

নিজের আশপাশটা একটু চোখ বুলিয়ে দেখ তো! কী কী দেখতে পাচ্ছ? বই, খাতা, পেনসিল, টেবিল, চেয়ার...কতকিছু। এই জিনিসগুলোর কি কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে যা আমরা মাপতে পারি? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে! যেমন ধরো, একটা বইটা কতটুকু লম্বা, তা আমরা স্কেলের সাহায্যে মাপতে পারি। একটা চেয়ার কতটা ভারী, তা জানতে পারি ওজন মাপার যন্ত্র দিয়ে মেপে। এখন কটা বাজে, তাও ঘড়ি দেখে বলে দিতে পারি। বাজারে গেলে চাল, ডাল, তেল, লবণ...কতকিছু দেখ। এগুলো সবই পরিমাপ করে কিনতে হয়। কেউ হয়তো ২ কেজি চাল কেনে, কেউ ৫০০ গ্রাম ডাল ইত্যাদি। আবার জামাকাপড় কিনতে গেলে লম্বা ফিতা দিয়ে মেপে দেখা জামার মাপ। এই যা কিছু আমরা পরিমাণ করছি বা মাপছি, এই মাপগুলোকেই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলে রাশি। মানে, সহজ কথায় বলতে গেলে, যা কিছু পরিমাপ করা যায়, তাই হলো রাশি।

এবার আমরা ছোট্ট একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারি। এতক্ষণ যা বললাম, তার কতটা তোমরা বুঝলে, তাও তো একটু যাচাই করতে হবে! নিচের সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলে তুমি নিজেই বাকিটা বুঝতে পারবে। আসলে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো, কোনটা রাশি আর কোনটা রাশি নয়। বলো তো, নিচের কোনটা কোনটা রাশি।

  • তোমাদের উচ্চতা?

  • তোমাদের মায়ের প্রতি ভালো লাগা?

  • একটা গানের সুর?

  • আজকের দিনের তাপমাত্রা?

ওপরের চারটার মধ্যে প্রথমটা আর শেষেরটা মাপা যায়। তাই এই দুটি রাশি। কিন্তু বাকি দুটি রাশি নয়।

এখানে চারটা আলাদা আলাদা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন আছে। সবগুলোই কি রাশি? চলো, একটা একটা করে বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমত, তোমার নিশ্চয়ই উচ্চতা আছে। মানে তোমার উচ্চতা তো মাপা যায়। ৫ ফুট, ৬ ফুট বা এর মাঝের কিছু একটা হবে। যেহেতু উচ্চতা মাপা যায়, তাই এটা একটা রাশি। কিন্তু মায়ের প্রতি তোমার ভালো লাগা বা ভালোবাসা কি মাপতে পারবে কিছু দিয়ে? না, পারবে না। তাহলে এটা রাশি নয়। একটা গানের সুরও মাপা যাবে না। কিন্তু আজকের তাপমাত্রা কত, তা চট করে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র দিয়ে বলতে পারবে। এখন অবশ্য মোবাইলে চোখ রেখেই চট করে বলা সম্ভব।

অর্থাৎ, ওপরের চারটার মধ্যে প্রথমটা আর শেষেরটা মাপা যায়। তাই এই দুটি; মানে উচ্চতা আর তাপমাত্রা হলো রাশি। কিন্তু মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর গানের সুর মাপা যায় না, তাই এই দুটি রাশি নয়।

আরও পড়ুন

রাশির আবার একক আছে। একক হলো কোনো কিছু মাপার সেই কাঠি, যার সাহায্যে আমরা রাশিকে প্রকাশ করি। একক ছাড়া কোনো রাশির মান বললে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মানে এর কোনো অর্থই হয় না। যেমন ধরো, আমি যদি বলি, আমার টেবিলটা ৫ লম্বা। তোমরা কি বুঝতে পারবে টেবিলটা আসলে কতটা লম্বা? নিশ্চয়ই না! কারণ আমি বলিনি এটা ৫ মিটার নাকি ৫ সেন্টিমিটার নাকি ৫ কিলোমিটার। আমি যখন বলব, আমার টেবিলটা ৫ মিটার লম্বা, তখনই তোমরা টেবিলের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবে। এই যে ‘মিটার’ শব্দটা বললাম, এটাই হলো দৈর্ঘ্যের একক। বাজারে কিছু কিনতে গেলে কিন্তু বলতে হয়, আমাকে ২ কেজি চিনি দেন বা ১ লিটার তেল দেন। এখানে কেজি ও লিটার হলো পরিমাপের একক। একক না থাকলে কিন্তু আমাদের বেশ মুশকিলেই পড়তে হতো!

যাহোক, এই যে এতক্ষণ রাশি নিয়ে আলোচনা করলাম, এই রাশি আবার ২ ধরনের। ভৌত রাশি ও লব্ধ রাশি। দুই ধরনের রাশি বৈশিষ্ট্য দুই রকম। চলো সেগুলোও একটা জেনে নিই।

টেবিলের নির্দিষ্ট মাপ আছে

১. ভৌত বা মৌলিক রাশি

যেসব রাশিকে আমরা সরাসরি মাপতে পারি এবং প্রকৃতির বিভিন্ন নিয়ম ও ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারি, সেগুলো হলো ভৌত রাশি। এদের একটা নির্দিষ্ট একক থাকে। যেমন, দৈর্ঘ্যের একক মিটার, ভরের একক কিলোগ্রাম বা সময়ের একক সেকেন্ড। পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে মোট সাতটি ভৌত রাশি আছে। এগুলো একটা অন্যটার ওপর নির্ভর করে না। দৈর্ঘ্য, ভর, সময়, তড়িৎ প্রবাহ, তাপমাত্রা, আলোর তীব্রতা ও পদার্থের পরিমাণ হলো মোট সাতটা ভৌত রাশি।

দৈর্ঘ্য: কোনো জিনিস কতটা লম্বা, চওড়া বা উঁচু, সেটাই হলো তার দৈর্ঘ্য। তোমরা নিশ্চয়ই স্কেল বা ফিতা দিয়ে জামা, বই বা ঘরের দৈর্ঘ্য মেপেছ। এর আন্তর্জাতিক একক হলো মিটার। ইংরেজি m দিয়ে মিটারকে প্রকাশ করা হয়। যেমন, তোমার কলমটা ১০ সেন্টিমিটার লম্বা। এখানে ১০ হলো কলমের দৈর্ঘ্যের মান এবং সেন্টিমিটার হলো দৈর্ঘ্যের একক।

ভর: কোনো বস্তুর মধ্যে কতটা পদার্থ আছে, সেটাই হলো তার ভর। তোমরা যখন দোকানে চাল বা ডাল কিনতে যাও, তখন দোকানদার কিলোগ্রাম বা গ্রামে মেপে তা দেন। এই কিলোগ্রাম হলো ভরের আন্তর্জাতিক একক। একে kg দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন, একটা বইয়ের ভর ২৫০ গ্রাম।

আরও পড়ুন
কোনো তারের মধ্যে দিয়ে কতখানি বিদ্যুৎ যাচ্ছে, সেটাই হলো তড়িৎ প্রবাহ। এটা আমরা অ্যামিটার দিয়ে মাপি।

সময়: কোনো ঘটনা ঘটার আগে, ঘটার সময় এবং ঘটার পরের যে ব্যাপ্তি, সেটাই হলো সময়। আমরা ঘড়ি দিয়ে সেকেন্ড, মিনিট বা ঘণ্টায় সময় পরিমাপ করি। সময়ের আন্তর্জাতিক একক হলো সেকেন্ড। একে s দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন, তোমাদের স্কুলের একটা পিরিয়ড ৪৫ মিনিট দীর্ঘ হয়। কিংবা তোমার বাসা থাকে স্কুলে যেতে ২০ মিনিট সময় লাগে।

তড়িৎ প্রবাহ: কোনো তারের মধ্যে দিয়ে কতখানি বিদ্যুৎ যাচ্ছে, সেটাই হলো তড়িৎ প্রবাহ। এটা আমরা অ্যামিটার দিয়ে মাপি। একে A দিয়ে প্রকাশ করা হয়। তড়িৎ প্রবাহের আন্তর্জাতিক একক অ্যাম্পিয়ার। তোমাদের বাড়িতে যে বাল্ব জ্বলে, তা বিদ্যুতের সাহায্যে। এই বিদ্যুৎ আসে একটা তারের মধ্য দিয়ে। আলো জ্বলার সময় কিছু পরিমাণ তড়িৎ প্রবাহ হয়।

তাপমাত্রা: কোনো বস্তু কতটা গরম বা ঠান্ডা, সেটা আমরা তাপমাত্রা দিয়ে বুঝি। এটা থার্মোমিটার দিয়ে মাপা হয় এবং এর আন্তর্জাতিক একক কেলভিন। K দিয়ে একে প্রকাশ করা হয়। তবে আমরা সাধারণত সেলসিয়াস (°C) স্কেলে তাপমাত্রা মাপি। যেমন, আজকের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আলোর তীব্রতা: কোনো আলোক উৎস কতটা তীব্র আলো দিচ্ছে, সেটা হলো আলোর তীব্রতা। এর আন্তর্জাতিক একক ক্যান্ডেলা। একে প্রকাশ করা হয় cd দিয়ে।

পদার্থের পরিমাণ: কোনো বস্তুতে কতগুলো পরমাণু বা অণু আছে, তা বোঝাতে পদার্থের পরিমাণ ব্যবহৃত হয়। এর আন্তর্জাতিক একক মোল। একে mol দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

এই সাতটি রাশিকে আবার মৌলিক রাশি বলা হয়। কিন্তু এগুলো কেন মৌলিক রাশি? কারণ, এই রাশিগুলো অন্য কোনো রাশির ওপর নির্ভর করে না এবং এদেরকে অন্য কোনো রাশিতে ভাঙা যায় না। এগুলোই হলো পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি!

আরও পড়ুন

২. লব্ধ রাশি

কিছু রাশি আছে যেগুলো সরাসরি মৌলিক রাশি নয়, বরং একাধিক মৌলিক রাশিকে মিলে তৈরি হয়। এগুলোকে বলে লব্ধ রাশি। লব্ধ মানে যা পাওয়া গেছে। মানে এই রাশিগুলো মৌলিক রাশি থেকে পাওয়া যায়। এরকম কয়েকটি লব্ধ রাশি হলো ক্ষেত্রফল, আয়তন, বেগ, ত্বরণ, বল, কাজ ও ক্ষমতা।

ক্ষেত্রফল: তোমরা নিশ্চয়ই জানো, ক্ষেত্রফল মানে দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের গুণফল। দৈর্ঘ্য একটা মৌলিক রাশি। আর প্রস্থও আসলে এক ধরনের দৈর্ঘ্য, তাই এটাও মৌলিক রাশি। এই দুটি মৌলিক রাশিকে গুণ করে আমরা পেলাম ক্ষেত্রফল, যা লব্ধ রাশি। ক্ষেত্রফলের একক বর্গমিটার। একে m² দিয়ে প্রকাশ করা হয়। কারণ, এখানে মিটারকে দুই বার গুণ করা হয়েছে। দৈর্ঘ্য × প্রস্থ = মিটার × মিটার = বর্গমিটার। যেমন, তোমাদের পড়ার টেবিলের ওপরিভাগের ক্ষেত্রফল হয়তো ১ বর্গমিটার।

আয়তন: কোনো ঘনবস্তুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতাকে গুণ করলে আমরা পাই আয়তন। এখানেও তিনটি মৌলিক রাশি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা গুণ করে পাই আয়তন। এর একক হলো ঘনমিটার। একে প্রকাশ করা হয় m³ দিয়ে। এখানে মিটারকে তিনবার গুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, দৈর্ঘ্য × প্রস্থ × উচ্চতা = মিটার × মিটার × মিটার = ঘনমিটার। যেমন, একটা বাক্সের আয়তন হয়তো ০.৫ ঘনমিটার।

সময়ের সাথে সাথে কোনো বস্তুর বেগ কতটা পরিবর্তিত হচ্ছে, সেটাই হলো ত্বরণ।

বেগ: কোনো বস্তু কত দ্রুত চলছে এবং কোন দিকে চলছে, সেটা হলো বেগ। খেয়াল করে দেখ, কত দ্রুত যাচ্ছে তা পরিমাপ করতে দৈর্ঘ্য ও সময় লাগে। যেমন ৫০০ মিটার দৌড়ে গেলে। কিন্তু তা কতটা দ্রুত গিয়েছ, তা বুঝতে জানতে হবে কত সময়ে গিয়েছ। মোট দূরত্বকে সময় দিয়ে ভাগ দিলে পাবো বেগ। এখানে দৈর্ঘ্য আর সময়—দুটিই কিন্তু মৌলিক রাশি। বেগের একক হলো মিটার পার সেকেন্ড। একে m/s বা ms­-1 দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন, একটি গাড়ি ২০ মিটার প্রতি সেকেন্ড বেগে চলছে।

ত্বরণ: সময়ের সাথে সাথে কোনো বস্তুর বেগ কতটা পরিবর্তিত হচ্ছে, সেটাই হলো ত্বরণ। ত্বরণ বের করতে আমরা বেগের পরিবর্তনকে সময় দিয়ে ভাগ করি। যেহেতু বেগ একটি লব্ধ রাশি (যা আবার দৈর্ঘ্য ও সময়ের উপর নির্ভরশীল), তাই ত্বরণও একটি লব্ধ রাশি। এর একক হলো ‘মিটার প্রতি সেকেন্ড স্কয়ার (m/s²)’।

আরও পড়ুন
কাজ কত দ্রুত করা হচ্ছে, সেটাই হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা বের করতে আমরা মোট কাজকে সময় দিয়ে ভাগ করি।

বল: নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র জানো? F = ma। এখানে ভর (m) একটা মৌলিক রাশি এবং ত্বরণ (a) হলো বেগ পরিবর্তনের হার, যা আবার দৈর্ঘ্য ও সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, ভর এবং ত্বরণ—এই দুটি রাশি মিলে তৈরি হলো বল। তাই এটা একটা লব্ধ রাশি। বলের আন্তর্জাতিক একক নিউটন। একে N দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

কাজ: যখন কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে তাকে সরানো যায়, তখন তা কাজ হয়। আমরা কতটা বল প্রয়োগ করেছি (বল) এবং বস্তুটা কতটা সরেছে (দৈর্ঘ্য) তা গুণ করি। যেহেতু বল একটি লব্ধ রাশি এবং দৈর্ঘ্য একটি মৌলিক রাশি, তাই কাজও একটি লব্ধ রাশি। কাজের আন্তর্জাতিক একক জুল এবং একে J দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

ক্ষমতা: কাজ কত দ্রুত করা হচ্ছে, সেটাই হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা বের করতে আমরা মোট কাজকে সময় দিয়ে ভাগ করি। যেহেতু কাজ একটি লব্ধ রাশি এবং সময় একটি মৌলিক রাশি, তাই ক্ষমতাও একটি লব্ধ রাশি। ক্ষমতার আন্তর্জাতিক একক হলো ওয়াট। একে প্রকাশ করা হয় W দিয়ে।

দেখলে তো, মাত্র ৭টা মৌলিক রাশি বা ভৌত রাশি মিলেমিশে কতগুলো লব্ধ রাশি তৈরি করছে। এই লব্ধ রাশিগুলোও আমাদের চারপাশের জগতকে বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। আসলে পদার্থবিজ্ঞানে রাশি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ধারণা। রাশি না থাকলে আমরা কোনো কিছু মাপতে পারতাম না, তুলনা করতে পারতাম না। আর তাতে প্রকৃতির নিয়মগুলোও বুঝতে পারতাম না ঠিকভাবে।

 

লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়, শশিকর, মাদারীপুর