আলবার্ট আইনস্টাইন: সেরা বিজ্ঞানী

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। আবিষ্কার করেছিলেন আপেক্ষিকতা, একাই আমূলে বদলে দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারা। তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন। আজ ১৮ এপ্রিল, তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে চলুন, জেনে নেওয়া যাক জার্মান এই বিজ্ঞানীর জীবনের নানা দিক...

পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম কী? এ প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ মানুষই যে বিজ্ঞানীর নাম নেন, তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন। বিজ্ঞানের মানুষ তো বটেই, যে মানুষ বিজ্ঞানের ধারেকাছেও কোনো দিন থাকতে চান না, তিনিও আইনস্টাইনের নাম জানেন। আর জানবেন নাই-বা কেন? আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ এবং সাধারণ তত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর সারা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমে আইনস্টাইনের নাম এত বেশি প্রচারিত হয়েছে যে তিনি সিনেমার সুপারস্টারদের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।

১৯৩১ সালে হলিউড সিনেমার সুপারস্টার চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা সিটি লাইটস-এর উদ্বোধনী শোতে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন। তখন দর্শকেরা চার্লি চ্যাপলিনকে দেখে যতটা আপ্লুত হয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি আপ্লুত হয়েছিলেন আইনস্টাইনকে দেখে। আইনস্টাইন চার্লি চ্যাপলিনের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘আপনি এত বড় শিল্পী যে আপনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না, অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ সবকিছু বুঝে যায়।’

উত্তরে চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, ‘কিন্তু আপনার ক্ষমতা তো আমার চেয়েও বেশি। আপনার বিজ্ঞান কেউ বুঝতে পারে না, অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ আপনাকে পছন্দ করে।’

ব্যাপারটা অনেকটাই সত্যি। আইনস্টাইনের সূত্রগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু ভীষণ দুর্বোধ্য। আইনস্টাইন একাই আমূল বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর মূল বিজ্ঞানের ধারা। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। অথচ শৈশবে এই মানুষটি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাথামোটা।

আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম জার্মানিতে। দানিউব নদীর তীরে ছোট্ট ছিমছাম শহর উল্‌ম। রেলস্টেশন রোড–বানহফস্ট্রাসের ২০ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলার ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ শুক্রবার পলিন ও হেরমান আইনস্টাইনের প্রথম সন্তান আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। জন্মের সময় থেকেই আলবার্টের মাথাটা অস্বাভাবিক বড়। মাথার পেছন দিকে কেমন যেন উঁচু হয়ে আছে। আক্ষরিক অর্থে মাথামোটা ছেলেটার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হবে কি না, তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন তাঁর মা পলিন। মায়ের চিন্তা আরও বাড়ল যখন দেখলেন যে আইনস্টাইন আড়াই বছর বয়সেও কথা বলতে শিখলেন না।

আইনস্টাইনের সূত্রগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়, কিন্তু ভীষণ দুর্বোধ্য। আইনস্টাইন একাই আমূল বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর মূল বিজ্ঞানের ধারা। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। অথচ শৈশবে এই মানুষটি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাথামোটা

আলবার্ট আইনস্টাইনের স্কুলজীবন শুরু হলো ১৮৮৫ সালের ১ অক্টোবর মিউনিখে বাড়ির কাছের ক্যাথলিক স্কুলে। ৭০ জনের ক্লাসে আইনস্টাইন ছিলেন একমাত্র ইহুদি। স্কুলে তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে প্রতিদিনই তাঁকে সহপাঠীদের কাছে অপমানিত হতে হতো। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সহপাঠীরা তাঁকে মারধরও করত। স্কুলে কোনো বন্ধু ছিল না তাঁর। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেন না ঠিকমতো। স্কুলের পড়াশোনার পদ্ধতি ভালো লাগে না আলবার্টের। কিন্তু বাড়িতে চাচা জ্যাকবের কাছে অঙ্ক কষতে দারুণ লাগে। চাচার কাছে বীজগণিতের চর্চা শুরু হয়েছে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই। ১৮৮৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে শুরু হলো লুটপোল্ড জিমনেসিয়ামের ক্লাস। এটি হাইস্কুলের সমতুল্য। এখানেও ভালো লাগেনি তাঁর। বিশেষ করে শিক্ষকেরা যখন মিলিটারি স্টাইলে পড়ানো শুরু করেন এবং যুক্তিহীন মুখস্থ করার ওপর গুরুত্ব দেন, ভালো লাগে না তাঁর। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের তাঁর মনে হয়েছিল ড্রিল সার্জেন্ট, এখন হাইস্কুলের শিক্ষকদের মনে হচ্ছে লেফটেন্যান্ট। স্কুলের পড়াশোনার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ সৃষ্টি না হলেও বাড়িতে লেখাপড়ার একটি নতুন পথ খুলে যায় আলবার্টের। মিউনিখ ইউনিভার্সিটির মেডিকেলের ছাত্র ২১ বছর বয়সী ম্যাক্স ট্যালমুডের সঙ্গে ১০ বছর বয়সী আলবার্ট আইনস্টাইনের জ্ঞানবিজ্ঞানের যোগসূত্র তৈরি হয়। গরমের ছুটিতে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির একটি বই হাতে পেয়ে ভীষণ ভালো লেগে গেল আলবার্টের। জ্যামিতিক সমস্যাগুলোর ভিন্ন রকম সমাধান করা যায় কি না, চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই দেখা গেল অনেক সমস্যার সমাধান তিনি নিজে নিজে করে ফেলেছেন। পরবর্তী সময়ে আইনস্টাইন জ্যামিতির এই বইটার নাম দিয়েছিলেন ‘পবিত্র জ্যামিতি বই’।

১৮৯৪ সালে আইনস্টাইনের বাবার ব্যবসা লাটে ওঠে। দেউলিয়া হয়ে তাঁকে মিউনিখের পাট গুটিয়ে চলে যেতে হয় ইতালির মিলানে। মা-বাবা আর বোন ইতালিতে চলে গেলেও আইনস্টাইনকে থেকে যেতে হয় মিউনিখের স্কুলে। কিন্তু সেখানে মোটেও ভালো লাগে না তাঁর। একদিন স্কুল থেকে পালিয়ে মিলানে চলে যান তিনি। তাঁর মা-বাবা খুব রেগে যান তাতে। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। কিন্তু আলবার্টের ইচ্ছা দর্শনের শিক্ষক হওয়ার। মা-বাবা অনেক বুঝিয়ে জুরিখের সুইস পলিটেকনিক্যালে পড়ার ব্যাপারে রাজি করান তাঁকে। কিন্তু পলিটেকনিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় ১৮৯৫ সালে পাস করতে পারলেন না আইনস্টাইন। পরের বছর ১৮৯৬ সালে আবার পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে সুইস পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হলেন আলবার্ট। পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ভালোবাসার শুরু এখানেই।

১৮৯৬ থেকে ১৯০০—এই চার বছরের কোর্স পাস করে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন আইনস্টাইন। কিন্তু পলিটেকনিক্যালের অধ্যাপকদের পড়ানোর পদ্ধতি খুব একটা ভালো লাগেনি তাঁর। তিনি নিয়মিত ক্লাসেও যেতেন না। তবে সেখানে দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু পেয়েছেন আইনস্টাইন—মার্সেল গ্রোসম্যান ও অ্যাঞ্জেলো বেসো। এই দুজনের সঙ্গে তাঁর সারা জীবন বন্ধুত্ব ছিল। গ্রোসম্যান প্রতিটি ক্লাসে যেতেন, আর আইনস্টাইন গ্রোসম্যানের ক্লাসনোট পড়ে পরীক্ষা দিতেন। পাস করার পর দীর্ঘদিন বেকার ছিলেন আইনস্টাইন। বিজ্ঞাপন দিয়ে টিউশনি জোগাড় করার চেষ্টাও করেছেন সেই সময়। আইনস্টাইনের বাবাও অনেক চেষ্টা করেছেন ছেলের জন্য একটা চাকরি জোগাড় করার। অনেক অধ্যাপকের কাছে তিনি নিজে চিঠি লিখেছেন চাকরি ভিক্ষা করে। কিছুদিন অস্থায়ীভাবে একটি স্কুলেও শিক্ষকতা করেছিলেন আইনস্টাইন।

১৯০২ সালে বন্ধু মার্সেল গ্রোসম্যানের বাবার সুপারিশে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন শহরের পেটেন্ট অফিসে তৃতীয় শ্রেণির টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে চাকরি পান আলবার্ট আইনস্টাইন। ১২ জনের দলে একজন নিম্নপদের কেরানি ছিলেন তিনি। অফিসের কাজ শেষ করার পরও হাতে সময় থাকত তাঁর। সেই সময়টাতে তিনি নিজস্ব গবেষণা করতেন। অফিসে একটু অবসর পেলেই তিনি কাগজ–কলম নিয়ে বসেন। অবশ্য সেখানে একেবারে ধ্যানমগ্ন হতে পারেন না। বসের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। ডিরেক্টর আসার আগেই নিজের গবেষণা লুকিয়ে ফেলতে হয়। অফিসে বসে নিজের গবেষণা করতে দেখলে বস নিশ্চয় খুশি হবেন না। তবে পেটেন্ট অফিসের কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন আইনস্টাইন। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির পেটেন্ট পরীক্ষা করতে করতে নানা রকম নতুন যন্ত্র দেখতে দেখতে বেশ অভিজ্ঞ পরীক্ষক হিসেবে নাম করেছেন তিনি। ১৯০৩ সালে তিনি বিয়ে করলেন তাঁর সহপাঠী বান্ধবী মিলেভা মেরিককে। ১৯০৪ সালে তাঁদের প্রথম পুত্র হ্যান্সের জন্ম হয়। অফিস থেকে ফিরে হ্যান্সকে কোলে নিয়ে বসেন আইনস্টাইন। বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে কাগজ–পেনসিল নিয়ে লিখতে শুরু করেন। প্রচণ্ড হট্টগোলের মধ্যেও গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন তিনি। অনেক সময় দেখা যায়, কোলের ওপর বাচ্চা কাঁদছে অথচ তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন।

স্ত্রী মিলেভা মেরিকের সঙ্গে আইনস্টাইন
ছবি: নেচার

পরের বছর ১৯০৫ সাল ছিল আইনস্টাইনের জীবনের একটি বিস্ময়কর বছর। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় এ বছর তিনি যে অবদান রাখেন, তাতেই তিনি হয়ে ওঠেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন। এ বছর তিনি চারটি মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যার জন্য পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, এ বছর সংবাদপত্রের জন্য ২৩টি সমালোচনা প্রবন্ধ লেখেন এবং এ বছর তিনি তাঁর পিএইচডির থিসিস লিখে জমা দেন। এর সবই তিনি করেছেন অফিসের কাজের পর তাঁর নিজস্ব সময়ে।

১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের প্রথম গবেষণাপত্রটি ছিল: On a Heuristic Point of View Concerning the Production and Transformation of Light. Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭ (১৯০৫), পৃষ্ঠা ১৩২-১৪৮। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন আলোর কণা ফোটনের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। আলো তরঙ্গের আকারে যেমন থাকতে পারে, তেমনি থাকতে পারে গুচ্ছ গুচ্ছ কণার শক্তির আকারে। এই ধারণা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। আলোর এ রকম গুচ্ছাকার শক্তিকে আলোর কোয়ান্টা বলা হয়। আলোর কোয়ান্টা বা ফোটনের ধারণার ওপর ভিত্তি করে আইনস্টাইন দেখান যে কোনো বস্তুর ওপর আলো প্রতিফলিত হওয়ার পর সে বস্তু থেকে কিছু ইলেকট্রন নির্গত নয়। অবশ্য এ ইলেকট্রন বেরিয়ে আসার জন্য কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির দরকার হয়। আলো যেহেতু বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ, বস্তুর ওপর আলোকপাতের ফলে বস্তু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হওয়ার ঘটনাকে বলা যায় একধরনের বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বিকিরণ। এই বিশেষ ধরনের বিকিরণের নাম ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের শক্তির বিকিরণের সূত্র অনুযায়ী পদার্থের ভেতর ইলেকট্রনগুলোকে পদার্থ একধরনের আকর্ষণ বল দিয়ে ধরে রাখে। পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের করতে আনতে হলে এই আকর্ষণ বলের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। আইনস্টাইন হিসাব করে দেখান যে এই শক্তির পরিমাণ আলোর কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলা যায়, শক্তি = প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক x কম্পাঙ্ক। এই আবিষ্কারের জন্য আইনস্টাইনকে ১৯২১ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। অবশ্য এই পুরস্কার ঘোষিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে কোয়ান্টাম মেকানিকসের অনেক উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। বিশেষ করে বোরের পরমাণু তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয় আইনস্টাইনের ফোটন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে আইনস্টাইন ও বোরের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে, আইনস্টাইন কখনোই কোয়ান্টাম মেকানিকসের সূত্র মেনে নেননি। আইনস্টাইন বিশ্বাস করেছেন, বিশ্বের সব ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতি থাকে। আর কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুসারে, পৃথিবীর সব ঘটনাই সম্ভাবনার সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

১৯০৫ সালের মার্চ মাসে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের পেপারটি পাঠানোর পরই পিএইচডির থিসিস নিয়ে আবার চিন্তা শুরু করেছেন আইনস্টাইন। আরেকটি থিসিস লিখতেই হবে তাঁকে। কিন্তু কোন বিষয়ে? এ নিয়ে দুবার থিসিস লিখেছেন তিনি। দুবারই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁর সুপারভাইজার অধ্যাপক ক্লেইনার। একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে কফি খাচ্ছেন আইনস্টাইন ও বেসো। কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বেসোর সঙ্গে কথা বলছেন আইনস্টাইন, ‘কফিতে চিনি মেশানোর পর কফির ভিসকোসিটি (সান্দ্রতা) বদলে যাচ্ছে। আরও কিছু চিনি মেশালে আরও বদলে যাবে। তার মানে চিনির কণার আয়তনের সঙ্গে ভিসকোসিটির সম্পর্ক আছে। এখন যদি ভিসকোসিটি জানা থাকে, তাহলে আমরা চিনির অণুর আয়তন পরিমাপ করতে পারব।’

আলবার্ট আইনস্টাইন

আণুবীক্ষণিক কণার আয়তন বের করার পদ্ধতি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করলেন আইনস্টাইন। কয়েক দিন একটানা কাজ করে তিনি ডিফিউশন কনস্ট্যান্ট ও ভিসকোসিটির সম্পর্ক ব্যবহার করে কণার আয়তন নির্ণয়ের সমীকরণ বের করে ফেললেন। কয়েক দিনের মধ্যেই আরেকটি থিসিস লিখে এপ্রিলের শুরুতে পাঠিয়ে দিলেন প্রফেসর ক্লেইনারের কাছে। আইনস্টাইন জানেন, ক্লেইনার অনেক সময় নিয়ে থিসিসটি পড়বেন। তারপর ধীরেসুস্থে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু আইনস্টাইনকে অবাক করে দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই ক্লেইনার তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। ক্লেইনার থিসিসটি প্রত্যাখ্যান করছেন, কারণ থিসিসটি পিএইচডি থিসিস হিসেবে খুবই সংক্ষিপ্ত। থিসিসটি ছিল মাত্র ১৭ পৃষ্ঠা। আইনস্টাইন আবারও রেগে গেলেন। থিসিসের দৈর্ঘ্যের ওপর কিছুই নির্ভর করে না। তিনি আবার থিসিসটি পড়ে দেখলেন। কোথাও কোনো ভুল পেলেন না। থিসিসের শেষে আর একটিমাত্র লাইন যোগ করে থিসিসটি আবার পাঠিয়ে দিলেন ক্লেইনারের কাছে। এবার অবাক হবার পালা ক্লেইনারের। তিনি দেখলেন আইনস্টাইন কিছুই পরিবর্তন করেননি থিসিসের, দৈর্ঘ্য বেড়েছে মাত্র এক লাইন। এত আত্মবিশ্বাসের কারণ কী? তিনি এবার আরও মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখলেন থিসিসটি। বিষয়বস্তু চমৎকার, তবে জটিল গাণিতিক সমীকরণগুলো তিনি বুঝতে পারছেন না। ক্লেইনার থিসিসটি পাঠিয়ে দিলেন গণিত বিভাগের হেড হেনরিখ বার্কহার্ডকে। বেশ কয়েক দিন পর বার্কহার্ড তাঁর মন্তব্যসহ থিসিসটি ফেরত পাঠালেন ক্লেইনারের কাছে। বার্কহার্ড লিখেছেন, ‘থিসিসে যে পদ্ধতিতে গাণিতিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তা নির্ভুল এবং অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা ছাড়া এ রকম কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’ ক্লেইনার থিসিসটি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গ্রহণ করে আইনস্টাইনকে অফিশিয়াল চিঠি দিলেন। আইনস্টাইন এখন ডক্টর আইনস্টাইন। আনন্দ ও উৎসাহে কয়েক দিনের মধ্যেই থিসিসটিকে গবেষণাপত্রের আকারে লিখে পাঠিয়ে দিলেন অ্যানালেন ডার ফিজিক–এ। এটি ছিল তাঁর ১৯০৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় গবেষণাপত্র: On the Motion of small Particles Suspended in Liquids at Rest Required by the Molecular-Kinetic Theory of Heat, Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭ (১৯০৫), পৃষ্ঠা ৫৪৯-৫৬০। এই প্রথমবারের মতো আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতি সম্পর্কে আলোচনা করলেন। কোনো তরল পদার্থের ওপর খালি চোখে দেখা যায় না, এ রকম ছোট ছোট পদার্থের কণা ভাসতে থাকলে কণাগুলোর গতি কোনো নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের গতি হয় অত্যন্ত অনিয়মিত। ১৮ শতকে স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ব্রাউন এ গতি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এ গতির নাম দেওয়া হয়েছে ব্রাউনিয়ান গতি। আইনস্টাইন এই গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেন যে ১ মিলিমিটারের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগের সমান বা তার চেয়েও ছোট কণাগুলো তরল পদার্থে ও রকম বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করার কারণ হলো তাদের থার্মাল ডায়নামিকস। বোল্টজম্যানের সূত্র ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন এবং গ্যাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুগুলোর গতির গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আইনস্টাইনের এ পেপার থেকে পরবর্তী সময়ে তাপের আণবিক গতিতত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। আইনস্টাইনের পেপারগুলোর মধ্যে এই পেপারটিই এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখিত হয়েছে গবেষকদের গবেষণাপত্রে।

ব্রাউনিয়ান গতিসম্পর্কিত পেপারটি জার্নালে পাঠিয়ে দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন আইনস্টাইন। আসলে এ সমস্যাটি নিয়ে আইনস্টাইন ভাবছেন অনেক দিন থেকে। ১৬ বছর বয়সে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আলোক রশ্মির সঙ্গে সমবেগে ছুটতে পারলে কেমন হতো? স্থান ও সময়ের মধ্যে সম্পর্কের কথা মাথায় আসে তাঁর। প্রায় ২০০ বছর আগে আইজ্যাক নিউটন ধারণা দিয়ে গেছেন যে স্থান ও কাল পরম। অর্থাৎ মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গাতেই স্থান ও কালের পরিমাপ একই হবে। কিন্তু আইনস্টাইনের কাছে ব্যাপারটি সন্দেহযুক্ত। আর্নস্ট মাখ ও হেনরি পয়েনকেয়ারও একই সন্দেহ পোষণ করেছেন। আইনস্টাইন ভাবছেন সময়ের কথা। দুটো ঘড়ি যদি একই স্থানে সমান সময় দেয়, তবে একটি ঘড়িকে অন্য একটি গ্রহে নিয়ে গেলেও কি সমান সময় দেবে? আইনস্টাইন দেখলেন, যদি গ্যালিলিয়ান ট্রান্সফরমেশন বিবেচনা করা হয়, তবে দুটো ঘড়ি সব সময়ই সমান সময় দেবে। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হলো সব ট্রান্সফরমেশন কিন্তু গ্যালিলিয়ান নয়। সে ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য নতুন ধরনের ট্রান্সফরমেশনের ধারণা দরকার। আইনস্টাইন লরেঞ্জের জ্যামিতি ব্যবহার করে সৃষ্টি করলেন লরেঞ্জ-আইনস্টাইন ট্রান্সফরমেশন সূত্র। নতুন এই সূত্রের সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। তিনি দেখালেন, গতি হিসাব করার সময় ডপলারের ইফেক্ট হিসাব করতে হবে। নিউটনের পরম গতির সমীকরণ এখানে খাটবে না। কারণ পরম গতি বলে কিছু নেই। সব গতিই আপেক্ষিক। পৃথিবীর ভেতরে আমরা তা বুঝতে পারি না, কারণ এখানে গতি হিসাব করার সময় আমরা আসলে কোনো বস্তুর সাপেক্ষেই গতি হিসাব করি। পৃথিবীর নিজের গতির কথা বিবেচনায় না রেখে আমরা পৃথিবীকে স্থির ধরেই অন্য বস্তুর গতি হিসাব করি। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে গেলে রেফারেন্স হিসেবে একটা ফ্রেম রাখতেই হবে গতি হিসাব করার জন্য এবং সে গতি হবে আপেক্ষিক গতি। এখান থেকেই আপেক্ষিকতার সৃষ্টি হচ্ছে, রূপ নিচ্ছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। আইনস্টাইন হিসাব করে দেখলেন, আলোর গতির চেয়ে বেশি কোনো গতি হতে পারে না। তিনি আরও দেখলেন, আলোর প্রবাহের জন্য ইথারের কোনো প্রয়োজন নেই। পয়েনকেয়ারও একই কথা বলেছেন ইথার সম্পর্কে। আলো বা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গপ্রবাহের জন্য কোনো ধরনের মাধ্যমের দরকার নেই। আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে করতে দেখলেন গতিশীল বস্তুর ভরও স্থির নয়। গতির সঙ্গে বস্তুর ভর বেড়ে যায়। আইনস্টাইনের সূত্রমতে, কোনো বস্তু যদি আলোর বেগে চলে, তবে তার ভর অসীম হয়ে যায়। আইনস্টাইন ধারণা দিলেন, আলো ছাড়া আর কোনো কিছুই আলোর বেগে চলতে পারে না। এখান থেকেই তৈরি হলো তাঁর ১৯০৫ সালের তৃতীয় গবেষণাপত্র ‘অন দ্য ইলেকট্রোডাইনামিকস অব মুভিং বডি’, অ্যানালেন ডার ফিজিক, সংখ্যা ১৭ (১৯০৫), পৃষ্ঠা ৮০১-৯২১। ১২১ পৃষ্ঠার বিশাল এই গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিশেষ সূত্র ব্যাখ্যা করেন। একই বেগে চলমান সব পর্যবেক্ষকের কাছে আলোর বেগ স্থির ধরে নিয়ে আইনস্টাইন প্রমাণ করে দেন যে স্থান (space) এবং কাল (time) পরস্পর স্বাধীন নয়, বরং স্থান ও কাল একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এখান থেকেই জন্ম হলো স্পেস টাইম বা স্থান–কালের ধারণার। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতাকে x, y, z ধরে ত্রিমাত্রিক জগতের প্রচলিত ধারণা ভেঙে শুরু হলো চতুর্মাত্রিক জগৎ। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার সঙ্গে যোগ হলো চতুর্থ মাত্রা—সময়।

আরও পড়ুন

আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের গবেষণাপত্র জার্নালে পাঠিয়ে দিলেন জুনের ৩০ তারিখে। সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে পেপারটি প্রকাশিত হয়। পেপারটি জার্নালে পাঠিয়েই আইনস্টাইন সেটার একটি সম্পূরক পেপার লিখে ফেললেন। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সম্পূরক চার পৃষ্ঠার এই ছোট পেপারে আইনস্টাইন দেখিয়েছেন বস্তুর ভরের সঙ্গে শক্তির সম্পর্ক। সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণ E = mc2। এটাই ছিল ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের চতুর্থ গবেষণাপত্র ‘ডাজ দ্য ইনারশিয়া অব আ বডি অন ইটস ডিপেন্ডস অন?’ অ্যানালেন ডার ফিজিক, সংখ্যা ১৮ (১৯০৫), পৃষ্ঠা ৬৩৯-৬৪১।

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ধারণাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আইনস্টাইন দেখালেন, বস্তু থেকে যে শক্তি নির্গত হয়, তা বস্তুর ভরের পরিবর্তনের সমানুপাতিক। প্রাথমিকভাবে সূত্রটি ছিল: m = E/c2। প্রথমবারের মতো পদার্থের ভরের সংজ্ঞা দিলেন তিনি, ‘বস্তুর ভর হলো তার ভেতরের শক্তির পরিমাণ।’ আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এত দিন ধরে প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিল। এখন থেকে যেকোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে স্থান ও কালের ধারণা অপরিহার্য হয়ে উঠল।

ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক জগতে আইনস্টাইন উল্লেখযোগ্য স্থান পেতে শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ আসতে লাগল। ১৯০৯ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন তিনি। ১৯১০ সালে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান এডওয়ার্ডের জন্ম হয়। ১৯১১ সালে তিনি যোগ দেন প্রাগ ইউনিভার্সিটিতে। ১৯১২ সালে যোগ দেন সুইস পলিটেকনিক্যালে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে। ১৯১৪ সালে যোগ দেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে আইনস্টাইন নিজেকে প্রশ্ন করছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সব তত্ত্বই প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে আপেক্ষিক। সে ক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণও কেন আপেক্ষিক হবে না? কাজের ফাঁকে হঠাৎ তাঁর মনে হলো, কেউ যদি মুক্তভাবে ওপর থেকে নিচের দিকে পড়তে থাকে, তাহলে সে কোনো ধরনের ওজন অনুভব করবে না। কারণ লোকটির সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশের সবকিছুও তো পড়ে যাচ্ছে মনে হবে, সে ক্ষেত্রে সে কীভাবে বুঝবে যে সে মাধ্যাকর্ষণ বলের ভেতরে আছে কি নেই। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রেফারেন্স পয়েন্ট নেই। এ ক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে সে স্থির আছে, কিন্তু বাকি সবকিছু চলে যাচ্ছে ওপরের দিকে। তার মানে মাধ্যাকর্ষণও আপেক্ষিক। পরবর্তী সময়ে তাঁর এ ধারণা থেকেই জন্ম নেয় আপেক্ষিকতার সার্বিক বা সাধারণ তত্ত্ব (জেনারেল থিওরি রিলেটিভিটি)। আইনস্টাইন তাঁর এ ধারণাকে বর্ণনা করেছেন জীবনের আনন্দময় ধারণা হিসেবে। জেনারেল থিওরিতে আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যার সব নিয়মকে গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যার প্রস্তাব করেন। ১৯১৫-১৬ সালে প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব। বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব নিয়ে। এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তবে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে নক্ষত্রের আলোও বেঁকে যাবে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া এই তত্ত্ব তো কেউ মেনে নেবেন না। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করে বুধের অনুসূর নিয়ে দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধান করা সম্ভব হয়। এরপর ১৯১৯ সালের জুন মাসে আইনস্টাইনের সাধারণ তত্ত্ব প্রমাণিত হয় একেবারে হাতেনাতে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি অবজারভেটরির পরিচালক, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন সূর্যের অভিকর্ষ ক্ষেত্রের টানে তারার আলো যে বেঁকে যায়, তা পর্যবেক্ষণ করেন। সূর্যের পূর্ণগ্রহণের ছবি থেকে প্রমাণিত হয় যে অভিকর্ষ ক্ষেত্রের টানে আলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়।

আরও পড়ুন

নভেম্বর মাসে রয়েল সোসাইটি এডিংটনের পরীক্ষালব্ধ ফল প্রকাশ করলে আইনস্টাইন রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যান। কারণ আইনস্টাইনের তত্ত্বটি সাধারণ মানুষের কাছে এতই দুর্বোধ্য যে সাধারণের কাছে মনে হচ্ছে একমাত্র আইনস্টাইনই অন্য রকম একটি পৃথিবীকে দেখার ক্ষমতা রাখেন, একমাত্র আইনস্টাইনই পারেন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বুঝতে। আইনস্টাইনকে নিয়ে অনেক মিথের জন্ম হতে লাগল এবং তা লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকল। এর কয়েক বছর পর ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক সত্যেন বসুর কাজের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস। আইনস্টাইন সত্যেন বসুর সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে কাজ করলেন। সত্যেন বসু একধরনের নতুন কণার ধারণা দিয়েছেন, যা ভরহীন হওয়াতে যেকোনো স্বাধীন সংখ্যায় হতে পারে এবং সব কণাই একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করবে। সত্যেন বসুর নাম অনুসারে এই কণাগুলোর নাম দেওয়া হলো বোসন। আইনস্টাইন বোসন নিয়ে গবেষণা করে দেখলেন যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে সব বোসনই একই শক্তিস্তরে থাকবে এবং সে শক্তিস্তর হলো সর্বনিম্ন শক্তিস্তর। পরে এই অবস্থার নাম হয়েছে বোস-আইনস্টাইন কনেডনসেট বা বি-ই-সি। ২০০১ সালে পরীক্ষাগারে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট সৃষ্টি করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন উলফগ্যাং কেটেরেল, এরিক কর্নেল ও কার্ল উইম্যান ।

এরপর আইনস্টাইন গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি বা একটি সমন্বিত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইতিমধ্যে ইউরোপে নাৎসিদের উত্থান ঘটায় আইনস্টাইনকে জার্মানি ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজে অধ্যাপক হিসেবে কাটিয়ে দেন বাকি জীবন। ১৯৫২ সালে আইনস্টাইনকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। আইনস্টাইন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল আইনস্টাইনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরও আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে আরও অনেক নতুন বিজ্ঞানের শাখা–প্রশাখা বিকশিত হচ্ছে। আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা ‘বিয়ন্ড আইনস্টাইন’ প্রকল্পের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্মরহস্য, ব্ল্যাক হোল, ডার্ক এনার্জি ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাচ্ছে। আইনস্টাইন কোনো ধরনের পরীক্ষাগার ছাড়াই যে গবেষণা-তত্ত্ব দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনো কাজ করছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক হিসেবে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া