নীল আর্মস্ট্রংদের চাঁদে হাঁটার ভিডিও নিশ্চয়ই দেখেছেন? দেখে মনে হয়, তাঁরা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছেন। বেশ কেতাদুরস্ত ভাব। পৃথিবীতে মানুষ এক লাফে এত দূর যেতে পারে না। মনে হয়, একটু চেষ্টা করলেই তাঁরা চাঁদে উড়তে পারবেন!
কেন এমনটা হলো?
ভাববেন না, চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই বলেই এক লাফে এত দূর যেতে পেরেছিলেন! বায়ুমণ্ডল আপনার চলাফেরায় বাধা দেয়, কিন্তু ওজনে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না। সত্যি সত্যি চাঁদে ওজন কমে যায়। আজকালকার স্কুলের ছেলেমেয়েরা জানে, পাহাড়ে উঠলে কিংবা খনির ভেতর মানুষের ওজন কমে যায়। তেমনি পানিতে ভাসলে কমে ওজন। সেটা পানির ঊর্ধ্বমুখী চাপের কারণেই। যেখানকার পানির ঘনত্ব যত বেশি, তার ঊর্ধ্বমুখী চাপ তত বেশি। তাই সুইমিংপুলে সাঁতার কাটার চেয়ে নদীতে সাঁতার কাটা অনেক সহজ। সাগরে আরও সহজ। ডেড সি বা মৃতসাগরের ঘনত্ব পৃথিবীর সব জলমগ্ন অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এতটাই বেশি, আপনি সাঁতার না জেনেও সেখানে নির্ভয়ে লাফিয়ে পড়তে পারেন।
ঠিক এমনটাই ঘটে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। গ্রহভেদে আপনার ওজন বাড়ে কিংবা কমে। ঠিক কতটা বাড়ে–কমে, সেটা জানার আগে আরেকটা তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে আপনাকে। স্কুলের ছাত্ররাও জানে তথ্যটা, আবার অনেক বড় মানুষও হয়তো জানেন না। সেটা হলো, ভর আর ওজনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলি আমরা অনেকেই। ভর হলো, আমার গোটা দেহে কতটা পদার্থ আছে, তার একটা পরিমাপ। চাইলেই একে পরিবর্তন করতে পারবেন না আপনি—সে চাঁদেই যান আর এন্ড্রোমিডার কোনো গ্রহেই যান। অন্যদিকে ওজন স্থানভেদে আলাদা মান দেবে। আমরা বস্তুকে বা নিজেকে ভারী বা হালকা বলি, এর কারণ কিন্তু ভর নয়। ওজনের কারণেই হালকা বা ভারীর অনুভূতি হবে আপনার।
এখন আসা যাক ওজনের কথায়। ভর মহাকর্ষ বলের ওপর নির্ভর করে না। এটা বস্তুর জন্য ধ্রুব একটা ব্যাপার, কিন্তু ওজন নির্ভর করে মহাকর্ষ বলের ওপর। অর্থাৎ, আপনি যে গ্রহে বা উপগ্রহে পা রাখছেন, তার মহাকর্ষ টানের ওপর। যদিও বস্তুর ওজন তার ভরের ওপর নির্ভর করে। নির্ভর করে মহাকর্ষীয় ত্বরণের ওপর। বস্তুর ওজন হলো তার ভর আর মহাকর্ষ ত্বরণের গুণফল। বস্তুর ভর যদি হয় m, মহাকর্ষীয় ত্বরণ g হলে ওজন W=mg।
মহাকর্ষীয় ত্বরণ আবার নির্ভর করে গ্রহ-উপগ্রহের কেন্দ্র থেকে বস্তুটির দূরত্বের ওপর। পাহাড়ে উঠলে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে আপনার দূরত্ব বাড়ছে। তাই মহাকর্ষীয় ত্বরণও কমছে। এ জন্য ভূপৃষ্ঠের তুলনায় এভারেস্টের চূড়ায় আপনার ওজন কমবে, কিন্তু যদি পৃথিবীতে খুব গভীর কুয়া কেটে নিচে নামেন, তাহলে কি বাড়বে আপনার ওজন? উত্তর হলো ‘না’! না কেন? কারণ, যখন আপনি কুয়ার ভেতরে নামছেন, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে আপনার দূরত্ব কমছে। সাদাচোখে মনে হবে, এর ফলে বাড়ছে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় টান। কিন্তু বাদ সাধে পৃথিবীর কার্যকরী ভর। কার্যকরী ভর হলো, পৃথিবীর কতটুকু ভর মহাকর্ষীয় টানে অংশ নিচ্ছে, সেটা। ধরুন, আপনি ২০০ মিটার গভীর একটা কুয়ায় (ছবি ১) নেমেছেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে সেই ২০০ মিটার গভীর পর্যন্ত পৃথিবী আয়তনের যে অংশ, তা থেকে বাদ যাবে সেই আয়তনে পৃথিবীর যতটুকু ভর। সেই ভর আপনার ওপর মহাকর্ষীয় টানে অংশ নেবে না। অর্থাৎ, পৃথিবীর ভরের বিশাল একটা অংশ বাদ দিতে হবে হিসাব থেকে। ছবি ১-এর দিকে একটু নজর বুলিয়ে নিন। অর্থাৎ, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গাতেই আপনার ওজন আলাদা পাচ্ছেন, তাহলে গ্রহান্তরে আপনার ওজন একই থাকে কী করে?
সৌরজগতের বাইরের কথা বাদ দিলাম, আমাদের পরিবারে যে আট গ্রহ, তার হিসাবটা দেখে নেওয়া যাক। উপগ্রহ হলেও শুরুটা হোক চাঁদ দিয়েই। চাঁদের ভর কম। হিসাবের সুবিধার জন্যই ধরে নিন পৃথিবীতে আপনার ওজন ১০০ কেজি। চাঁদে তাহলে কত হবে? চাঁদের ব্যাসার্ধ পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ৪ ভাগের ১ ভাগ, ভর পৃথিবীর ভরের ৮২ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। এসব হিসাব মিলিয়ে চাঁদের মহাকর্ষীয় ত্বরণ ১.৬২ মিটার/সেকেন্ড২। অর্থাৎ, পৃথিবীর মহাকর্ষীয় ত্বরণের মাত্র ৬ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। তাই পৃথিবীতে আপনার ওজন যদি ১০০ কেজি হয়, চাঁদে আপনার ওজন হবে মাত্র ১৬ কেজি!
এবার আসা যাক মঙ্গলের কথায়। এই শতাব্দীর ত্রিশের দশকেই মঙ্গলে যাবে মানুষ। নামবে এর লাল মাটিতে। মঙ্গলে কলোনি বানিয়ে সেখান স্থায়ী বসবাসের ইচ্ছাও মানুষের আছে। সে চেষ্টা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু আপনাকে যদি মঙ্গলের মাটিতে নামিয়ে দেওয়া হয় তো কেমন বোধ করবেন? আপনার ওজন তখন পৃথিবীর তুলনায় অনেক কম হবে, কিন্তু চাঁদের চেয়ে অনেক বেশি হবে। দ্বিগুণের বেশি। মঙ্গলের ভর পৃথিবীর ভরের ১০ ভাগের ১ ভাগ। এর মহাকর্ষীয় ত্বরণ ৩.৭২০৭৬ মিটার/সেকেন্ড২। তাই সেখানে আপনার ওজন হবে পৃথিবীর ৩ ভাগের ১ অবশ্য নয়, কিছুটা বেশি। পৃথিবীতে আপনার ওজন ১০০ কেজি হলে মঙ্গলে ৩৭.৮৩ কেজি।
সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধে গিয়ে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন না। প্রচণ্ড তাপে জ্বলে-পুড়ে ছাই হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। তারপরও টিকে গেলে সুপারম্যানের মতো ওড়াউড়ি করতে পারবেন।
আমাদের আরেক প্রতিবেশী শুক্র গ্রহে আপনার ওজনবিষয়ক অনুভূতি খুব এদিক-ওদিক হবে না। শুক্রের আয়তন পৃথিবীর ৯৫ শতাংশ। মানে খুব কাছাকাছি। ভর কাছাকাছি—পৃথিবীর ৮১ শতাংশ। তাই আপনার ওজনও সেখানে কাছাকাছি হবে। অর্থাৎ, আপনার ওজন দাঁড়াবে ৯০ কেজি।
সূর্যের নিকটতম গ্রহ বুধে গিয়ে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন না। প্রচণ্ড তাপে জ্বলে-পুড়ে ছাই হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। তারপরও টিকে গেলে সুপারম্যানের মতো ওড়াউড়ি করতে পারবেন। বেশ স্বচ্ছন্দে লাফাতে পারবেন। বুধের ভর পৃথিবীর ১৮ ভাগের ১ ভাগ। আয়তনও অনেক কম। তাই এর মহাকর্ষীয় ত্বরণও খুব বেশি নয়, মাত্র ৩.৭ মিটার/সেকেন্ড২। তাই বুধ গ্রহে আপনার ওজন দাঁড়াবে মাত্র ৩৮ কেজি।
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। সমস্যা হবে তখন, যদি আপনি মহাকাশযানে চেপে শনি, কিংবা বৃহস্পতিতে যান। শনির ভর ৯৫টি পৃথিবীর সমান। আর ৩১৭টি পৃথিবীর ভর একত্র করলে বৃহস্পতির সমান হবে। তাই বলে ভাববেন না এই দুই গ্রহে আপনার ওজন বেড়ে নীল তিমির সমান ভারী হবে। কারণ, এই দুই গ্রহের ভর বেশি, কিন্তু আয়তন আরও বেশি। আয়তন খুব বেশি বলে এদের ভরের তুলনায় মহাকর্ষীয় ত্বরণ বেশ কম। শনির ৮.৯৬ মিটার/সেকেন্ড২। তাই শনিতে আপনার ওজন বাড়বে তো নয়ই, বরং কিছুটা কমবে। বৃহস্পতিতে মহাকর্ষীয় টানটা অবশ্য বেশি। ২৪.৭৯ মিটার/সেকেন্ড২। তাই আপনার ওজন বৃহস্পতি গ্রহে দাঁড়াবে ২৩৫ কেজি! কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই দুই গ্রহের কোনোটিতেই আপনি হাঁটতে পারবেন না। কারণ, এদের কোনো জমাট ভূপৃষ্ঠ নেই। দুটিই গ্যাসীয় গ্রহ। তবে গ্যাসের ওপর ভেসে চলা কোনো মহাকাশযানে চড়ে অবশ্য নিজের ওজনের তারতম্যটা বুঝতে পারবেন।
শনি আর বৃহস্পতির মতো ইউরেনাস ও নেপচুনও গ্যাসীয় গ্রহ। ১৪টি পৃথিবীর ভরের সমান ইউরেনাসের মহাকর্ষীয় ত্বরণ ৮.৬৯ এবং নেপচুনের ১১.১৫ মিটার/সেকেন্ড২। তাই ইউরেনাসে আপনার ওজন হবে ৮৮ কেজি, অন্য দিকে নেপচুনে কিছুটা বেড়ে দাঁড়াবে ১১৪ কেজি!
সদ্য গ্রহের খেতাব হারানো প্লুটো কিন্তু গ্যাসীয় গ্রহ নয়। কঠিন শিলাপাথরে তৈরি এই বামন গ্রহ। ভরে এই পুঁচকে গ্রহ পৃথিবীর ২৮ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। মহাকর্ষীয় টান এত কম যে আপনার ১০০ কেজি ওজনের দেহটি মাত্র ৬ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনে পরিণত হবে। চাইলেই এক লাফ দিয়ে সুপারম্যানের মতো বড় বড় বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে পড়তে পারবেন!
লেখক : সাংবাদিক
সূত্র: প্লানেট ডট কম