প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতরা পদার্থের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণার নাম দিয়েছিলেন অ্যাটম বা অবিভাজ্য—যা আর ভাগ করা যায় না। অ্যাটম বলতে তাঁরা আসলে পরমাণুকেই বোঝাতেন। ধরে নিয়েছিলেন পরমাণুকে আর ভাঙা যায় না। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতরা বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণার নাম দিয়েছিলেন পরমাণু। কথাটা ভেঙে বললে দাঁড়ায়, পরম অণু। কিন্তু গ্রিক এবং ভারতীয় পণ্ডিতদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগেনি।
বিশ শতকের আসার আগেই এ ধারণায় আঘাত হানেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জে জে টমসন। ১৮৯৭ সালে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা ইলেকট্রন সনাক্ত করেন তিনি। তাতে দেখা গেল, গ্রিক পণ্ডিতরা যাকে অবিভাজ্য বলেছিল, তা আসলে ভাগ করা যায়। তার কয়েক বছর পর আর্নেস্ট রাদারফোর্ড কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পরমাণুকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য গবেষণা শুরু করেন। গবেষণায় রাদারফোর্ড বুঝলেন, পরমাণুর ভেতর খুব অল্প একটা জায়গায় প্রায় সবটুকু ভর জমে থাকে। একে আমরা নিউক্লিয়াস হিসেবে এখন জানি। পরমাণুর সম্পূর্ণ আকারের তুলনায় নিউক্লিয়াস প্রায় ১০ হাজার ভাগ ছোট। তিনি দেখান, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে পরমাণুর সিংহভাগ ভর দখল করে থাকে প্রোটন নামের আরেকটি ক্ষুদ্র কণা। এরপর একে একে পরমাণুর আরও কণা আবিষ্কৃত হয়। যেমন নিউট্রন কণা।
তাত্ত্বিকভাবে এ কণা নিউট্রন বা প্রোটনের চেয়েও প্রায় ১০ হাজার ভাগ ছোট হতে পারে। মজার বিষয় হলো, আকারে এর চেয়েও ছোট হতে পারে ইলেকট্রন বা অন্য কোনো কণা।
গত শতকের ৬০-এর দশকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা পরমাণুর মধ্যে থাকা অতিপারমাণবিক কণাগুলো (আসলে ইংরেজি সাবঅ্যাটমিক পার্টকেলের বাংলা হওয়া উচিত উপ-পারমাণবিক কণা) সম্পর্কে জানার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। পরমাণুর মধ্যে উচ্চগতির ইলেকট্রন ছুড়ে বোঝার চেষ্টা করেন প্রোটন ও নিউট্রনের বৈশিষ্ট্য। দেখা যায়, প্রোটন ও নিউট্রন কণা এক ধরনের কাঠামো দিয়ে গঠিত। এগুলোর নাম দেওয়া হয় কোয়ার্ক কণা।
তাত্ত্বিকভাবে এ কণা নিউট্রন বা প্রোটনের চেয়েও প্রায় ১০ হাজার ভাগ ছোট হতে পারে। মজার বিষয় হলো, আকারে এর চেয়েও ছোট হতে পারে ইলেকট্রন বা অন্য কোনো কণা। অতিপারমাণবিক কণার আকার সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ধারণা দিতে পারে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কণার কৌণিক ভরবেগ বা স্পিন এবং এদের চৌম্বক ধর্ম থেকে তাত্ত্বিকভাবে আকার বের করা যায় এর সাহায্য। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে, এ বৈশিষ্ট্যগুলো পরিমাপ করে দেখা যায় এটা কোয়ার্কের চেয়েও প্রায় কমপক্ষে ১ হাজার ভাগ ছোট হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে শক্তিশালী কণা ত্বরক যন্ত্রের সাহায্যে প্রোটনের চেয়ে ২ হাজার ভাগ ছোট কণার আকার মাপতে পারেন। কিন্তু তাতে ইলেকট্রন বা কোয়ার্কের আকার নিখুঁতভাবে মাপা সম্ভব হয়নি।
তবে, ভরের দিক থেকে ক্ষুদ্রতম কণার সন্ধান বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ফার্মিল্যাবের জ্যৈষ্ঠ বিজ্ঞানী ডন লিংকনের মতে, প্রকৃতির সবচেয়ে ছোট অশূন্য ভরের কণা হলো, নিউট্রিনো। এর ভর প্রায় শূন্য। ইলেকট্রনের চেয়ে অন্তত ৫ লাখ ভাগ হালকা। মহাবিশ্বে আলোর কণা ফোটনের পরেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় এ কণা। আমরা চোখে দেখতে না পেলেও প্রতিমুহূর্তে কোটি কোটি নিউট্রিনো পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের শরীরের মধ্যে দিয়ে। গবেষণাগারে নিউট্রিনো শনাক্ত করতে পারলেও, এর আকার বা ওজন নিখুঁতভাবে বের করা যায় নি এখনও।
আসলে এসব কণার আকার ও ওজনের পরিমাপটা এতোই ক্ষুদ্র চেয়ে চাইলেও যন্ত্র দিয়ে মাপা যায় না। অন্তত এখন বর্তমানে মানুষের সেই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নেই। আশার কথা হলো প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে নিখুঁতভাবে জানা যাবে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণার নাম, আকারসহ সব বৈশিষ্ট্য।