রিঅ্যাক্টরের ইতিকথা
শক্তির নানা রুপ
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর। এতে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। রিঅ্যাকটর কী, কীভাবে কাজ করে তা ছোটদের জন্য খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে রিঅ্যাকটরের ইতিকথা বইয়ে। আলেক্সেই ক্রিলোভের লেখা এই বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বিজয় পাল। মস্কোর ‘রাদুগা’ প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে…
আগেই তোমাকে জানিয়ে দিই, কেউ কখনো শক্তি দেখেনি। এর কোনো রং নেই, স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। শক্তিকে দেখার একমাত্র উপায় হলো তাকে কাজ করতে বাধ্য করা।
আজ মানুষ এই অদৃশ্য বস্তুটির প্রায় সব রহস্য জেনে ফেলেছে। শক্তি হয় পাঁচ ধরনের—রাসায়নিক শক্তি, তাপ শক্তি, যান্ত্রিক শক্তি, বৈদ্যুতিক ও পারমাণবিক শক্তি।
তবে আপাতত আমরা এসব শক্তির স্বভাব ও চরিত্র নিয়ে বিশদ আলোচনা করব না। এ সম্পর্কে কথাবার্তা হবে পরে। বইটি এ জন্যই লেখা হয়েছে। এখন শুধু শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম ও ক্ষমতা সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলব।
প্রথম ও প্রধান ধর্ম আমরা ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছি। সব ধরনের শক্তি কাজ করতে পারে। প্রসঙ্গত, শক্তি কথাটি আবিষ্কৃত হয়েছে খুব সম্প্রতি, গত শতাব্দীতে। তার আগে তা পরিচিত ছিল কাজ বলে।
শক্তির দ্বিতীয় ধর্মটি যেন ঠিক ধর্ম নয়, একেবারে জাদু আরকি! শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। রাসায়নিক শক্তি রূপান্তরিত হতে পারে তাপ শক্তিতে, আর তাপ শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে...
মানুষ বহুকাল থেকেই এই চমৎকার ধর্মটি নিজের কাজে লাগাচ্ছে। তারা বিভিন্ন ধরনের মেশিন গড়েছে শক্তির রূপ পরিবর্তন করে।
প্রায়ই এমনটি ঘটে যে প্রয়োজনীয় রূপ পরিবর্তনের জন্য কেবল একটি মেশিন যথেষ্ট নয়। তখন লোকে মেশিনের সারি বসায়।
মেশিনগুলো পরস্পরকে শক্তি দেয়; অনেকটা রিলে-রেসের দণ্ড হস্তান্তরের মতো। সত্যি যে খেলায় দণ্ডের কোনো পরিবর্তন হয় না, বদলায় কেবল মেশিন। আর আমাদের রিলে-রেসে মেশিন বদলায়, ‘দণ্ডও’ (শক্তি) বদলায়। আগের থেকে প্রতিটি মেশিন একধরনের শক্তি গ্রহণ করে, পরেরটিকে দেয় অন্য ধরনের শক্তি।
মেশিনের এমন সারি পৃথিবীতে আছে অনেক। তা আছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে, জাহাজে-স্টিমারে এবং অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে।
প্রায় সব ধরনের শক্তিকেই মানুষ পরিণত করে যান্ত্রিক শক্তিতে। এটাই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শক্তি। রেলপথে ট্রেন চালায়, আকাশে বিমান তোলে, শার্ট সেলাই করে, মোটর গাড়ি আর খনন যন্ত্র প্রস্তুত করে। আমাদের হৃদয়ের যান্ত্রিক শক্তি শিয়ার শিরায় রক্ত পরিচালিত করে, আর মাংসপেশির শক্তি আমাদের চলার, লেখার ও কাজ করার সুযোগ দেয়।
তা ভালো কথা। কুঁদযন্ত্রে আমরা কোনোকিছু পালিশ করলাম কিংবা মেশিনে একটি শার্ট সেলাই করে নিলাম। কিন্তু যে শক্তি আমাদের এ কাজে সাহায্য করল, তা গেল কোথায়? কীসে পরিণত হলো? কোনো যন্ত্রাংশে, শার্টে বা আর কিছুতে? না, এগুলোর কোনোটাতেই পরিণত হয়নি।
আমরা শক্তি দিয়ে যা-ই করি না কেন, শক্তি সর্বদা শক্তিই থেকে যায়। তার বিলুপ্তিও নেই, সৃষ্টিও নেই। তা কেবল রূপ পরিবর্তন করে।
মানুষের সেবা করার পর—যেমন ইস্পাত গলানো, মাল পরিবহন বা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান প্রদর্শনের পর—তা অবশ্যই রূপান্তরিত হয় তাপে, তাপ শক্তিতে।
এই তো দেখো না, একখানি ডিজেল ইঞ্জিন ছুটছে। তার পেছনে অনেকগুলো ওয়াগনের বিরাট একটি লেজ…প্রতিকুল বাতাস ইঞ্জিনের কপালে আঘাত করছে। যা পাচ্ছে, তা-ই আঁকড়ে ধরছে—ওয়াগনগুলোর দেয়ালে ও ছাদে ঘষে যাচ্ছে। ট্রেনকে চলতে বাধা দিচ্ছে। ওয়াগনগুলোর তলায় রেলের ওপর চাকার কট-কট ঘট-ঘট শব্দ হচ্ছে এবং তা-ও রেলে ঘষা খাচ্ছে। এই ঘর্ষণেই চলে যাচ্ছে ইঞ্জিনের প্রায় সব শক্তি।
আর ঘর্ষণের ফলে যেকোনো জিনিসই গরম হয়। তা যাচাই করা খুব সহজ। নিজের হাতের তালু দুটি একটু ঘষে দেখো, সঙ্গে সঙ্গেই টের পাবে তা গরম হয়ে উঠছে।
এর মানে কি ডিজেল ইঞ্জিন তার কাজ দিয়ে রেল ও বাতাস গরম করে? ঠিক তা-ই। পরে এই তাপ চলে যায় বায়ুমণ্ডলে এবং তারপরে আরও দূরে—মহাকাশে।
একই ব্যাপার ঘটে মোটর গাড়ির ক্ষেত্রে। দূর পথ পাড়ি দেওয়ার পর তার চাকাগুলো একবার ছুঁয়ে দেখো না। জানো, কী গরম লাগবে!
তাহলে এ থেকে কী দাঁড়াচ্ছে? পৃথিবী গরম করছে মহাশূন্যকে? অবশ্যই।
তবে মহাকাশ যে কেবল পৃথিবীর কাছ থেকে শক্তি নেয়, তা নয়। তা আমাদের কাছে নিজস্ব শক্তিও পাঠায়—সেটা হলো সৌরশক্তি। ওই শক্তি সঞ্চিত হয় উদ্ভিদে এবং পরিণত হয় রসায়নিক শক্তিতে। আগে হোক পরে হোক গাছপালা একদিন মরে যায়, আর তাদের ধ্বংসাবশেষ রূপান্তরিত হয় তেল, গ্যাস, পাথুরে কয়লা ও পীটে।
আজ পৃথিবীতে জ্বালানি হচ্ছে শক্তির প্রধান উৎস। ঠিক করে বললে, আপাতত প্রধান উৎস।
তা জ্বালিয়ে লোকে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব শক্তি প্রস্তুত করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বয়লারে, মোটর গাড়ি, জাহাজ আর বিমানের ইঞ্জিনে, লোহা গালাইয়ের ব্লাস্ট ফার্নেসে এবং রকেটে প্রতি বছর যে পরিমাণ জ্বালানি জ্বলে, তার তাপ দিয়ে অনায়াসে ফুটানো যাবে কৃষ্ণ সাগরের সব পানি।