হিগস ও আমাদের মহাবিশ্ব - ২য় পর্ব

আরও পড়ুন

আমরা আসলে হিগস বোসনের পাশাপাশি এর সাথে সম্পর্কিত অন্য কোনো নতুন কণা বা নতুন কোন ঘটনার অপেক্ষায় ছিলাম। বিজ্ঞানীরা নতুন কিছু আশা করলেও লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের পরীক্ষা থেকে এ ধরনের নতুন কোনো কণা বা ঘটনা পাওয়া যায়নি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে—এটাই চূড়ান্ত রায় নয়। এজন্য আমাদের আরও বেশি শক্তিমাত্রায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। আরও অনেক ডেটা সংগ্রহ করতে হবে। আশার কথা হলো, এজন্য আমাদের হয়ত খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। দুই বছর ধরে উন্নতি ঘটানোর পর ২০১৫ সালের ২০ মে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়েছে। এই শক্তিতে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ ঘটিয়ে আমরা আরও নতুন নতুন কণা ও ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে পারব। আর সেসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।

লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার থেকে হিগস সম্পর্কিত নতুন তথ্য পেতে আমাদের কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের গাণিতিক বিশ্লেষণ থেকে হিগস ফিল্ড সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু চমৎকার তথ্য পেয়েছি। হিগস ফিল্ডকে বলা হয় স্কেলার ফিল্ড। ফিল্ড থিওরি অনুসারে—ফিল্ড একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। হিগস ফিল্ডের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ ফিল্ড দুটি অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ বর্তমানে আমরা হিগস ফিল্ডকে যে অবস্থায় দেখছি, এরও আরও একটি অবস্থা রয়েছে। পানি যেমন কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় এই তিন অবস্থায় থাকতে পারে, ঠিক তেমনি হিগস ফিল্ডও দুটি ভিন্ন অবস্থায় থাকা সম্ভব। হিগস ফিল্ডের অন্য অবস্থাটি বর্তমান অবস্থার থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন গুণ বেশি ঘনত্বের। এখন প্রশ্ন আসতে পারে—হিগস ফিল্ডও কি সাধারণ পানির মতো তার অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে? হ্যাঁ, পারে।

আমরা যদি তরল পানিকে গ্যাসীয় অবস্থায় নিয়ে যেতে চাই, তাহলে বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি সংগ্রহ করতে পারলে একটি পানির অণু বন্ধন ছিন্ন করে বাতাসে মিশে যাবে। আমরা যখন হাঁড়িতে পানি ফোটাই, তখন ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটে। অতিরিক্ত শক্তি পেয়ে পানির অণুগুলো প্রথমে প্রচণ্ড বেগে ছুটাছুটি করে। তাপ বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে তারা বুদবুদের মতো সৃষ্টি করে। এবার যেসব অণু পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি সংগ্রহ করতে পারে, সেগুলো পানির বুদবুদ থেকে ছিন্ন হয়ে বাতাসে মিশে যায়।

তেমনি, হিগস ফিল্ড এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হতেও অনেক শক্তি প্রয়োজন। কিন্তু পানির মতো হিগস ফিল্ডকে তো আর কেউ বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ করা যায় না। তাহলে হিগস ফিল্ডের অবস্থাও কি পরিবর্তন হতে পারে? হ্যাঁ, বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ না করলেও হিগস ফিল্ড তার বর্তমান অবস্থা পরিবর্তন করে বিলিয়ন বিলিয়ন গুণ ঘন অবস্থায় যেতে পারে। আর সেটা সম্ভব হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এক অদ্ভুত নিয়মের কারণে।

কোয়ান্টাম জগত চলে সম্ভাব্যতার নিয়ম অনুসারে। দুটি অবস্থার মধ্যে বিশাল শক্তির বাধা থাকলেও এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার খুব সামান্য সম্ভাব্যতা থাকে। এই ঘটনাকে বলা হয় কোয়ান্টাম টানেলিং। একটি ইলেকট্রনকে যদি আমরা একটি লোহার বাক্সে রেখে দিই, তবে সেটি এই বাক্সকে ভেদ করে বাক্সের বাইরে চলে যাওয়ার সামান্য একটা সম্ভাবনা থাকে। আমরা যদি কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকে হিসেবে না ধরি, তবে ইলেকট্রনটি কখনই বাক্সের বাইরে চলে যেতে পারবে না। কারণ এই বাক্স ভেদ করার মতো শক্তি ইলেকট্রনটির নেই। কিন্তু আমাদের কাছে অবাস্তব এই ঘটনা ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ ইলেকট্রনের মতো কোয়ান্টাম কণারা আক্ষরিক অর্থেই দেয়াল ভেদ করে বাক্স থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। আর এই বিষয়টি কাজে লাগিয়েই টানেল ডায়োড তৈরি করা হয় (এই ডায়োড ব্যাবহার করেই স্টেরিও হেডফোনসহ আরও অনেক ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরি করা হয়)।

কোয়ান্টাম টানেলিং প্রক্রিয়ায় আমাদের মহাবিশ্বের হিগস ফিল্ডে ছোট ছোট বুদবুদ তৈরি হয়। একটু আগে আমারা দেখেছি, পানিকে তাপ দেওয়া হলে অণুগুলোর শক্তি বেড়ে যায়, তারপর এরা বুদবুদ তৈরি করে আর একদম শেষ ধাপে শক্তিশালী পানির অণুগুলো বুদবুদ থেকে ছিন্ন হয়ে গ্যাসীয় অবস্থায় চলে যায়। হিগস ফিল্ডের বিষয়টিকে পানির এই ঘটনার সাথে তুলনা করা যায়। কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের কারণে হিগস ফিল্ডে যেসব বুদবুদ তৈরি হয়, সেগুলোর বিভব শক্তি থাকে অনেক বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বুদবুদগুলোর শক্তি এতটাই বেড়ে যায়, সেগুলো আলোর গতিতে প্রসারিত হতে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বের সমস্ত স্থান-কাল জুড়ে। আর এই ঘটনা ঘটা মানেই হিগস ফিল্ড বর্তমান অবস্থা থেকে অতি-ঘন অবস্থায় রুপান্তরিত হওয়া।

এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, মহাবিশ্ব যদি হিগস ফিল্ডের সেই অতিঘন অবস্থায় পৌঁছে, তাহলে কি ঘটবে? আসলে হিগস ফিল্ডের শক্তি ঘনত্ব কয়েকগুণ কমলে বা বাড়লেই মহাবিশ্ব আর চেনাজানা কোন অবস্থায় থাকবে না। কারণ ইলেকট্রনের মতো মৌলিক কণাদের ভর নির্ভর করে এই হিগস ফিল্ডের ঘনত্বের ওপর। এর ঘনত্ব যত কমতে থাকবে, ইলেকট্রনের ভরও তত কমতে থাকবে। আর ইলেকট্রনের ভর যত কমবে, পরমাণুর আকার তত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। হিগস ফিল্ডের ঘনত্ব যদি সামান্য একটুও কমে, তবে একটি পরমাণুর আকার হবে টেনিস বলের মত। এই ঘনত্ব আরও কমালে একটি পরমাণুর আকার হবে পৃথিবী, সৌরজগৎ, একসময় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো। ফলে পুরো মহাবিশ্বই দানব আকৃতির পরমাণুতে ভর্তি হয়ে যাবে। অণু বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না।

ফিল্ডের ঘনত্ব যখন আরও অনেক কমে যাবে তখন আসলে পরমাণু বলেই কিছু থাকবে না। বিভিন্ন মৌলিক কণিকা তখন মহাবিশ্বের জুড়ে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে ছোটাছুটি করতে থাকবে। আর হিগস ফিল্ডের মান যদি শূন্য হয়ে যায়, তবে আরও সূক্ষ্ম কিছু ঘটনা ঘটবে। যেমন, ইলেকট্রন, মিউওন ও টাও কণিকা বলে আলাদা কিছু থাকবে না। কারণ এই তিনটি কণাই মূলত- ইলেকট্রন। আমরা ধরে নিতে পারি, এদের সম্পর্ক কিছুটা কাজিন ভাইবোনের মতো। এদের চার্জ, স্পিন ইত্যাদি সব বৈশিষ্ট্য একই; পার্থক্য শুধু ভরে। যদি হিগস ফিল্ডের মান শূন্য হয়ে যায়, তবে এদের আর আলাদা করে চিহ্নিত করা যাবে না। ঠিক একই ঘটনা ঘটবে আপ, চার্ম ও টপ কোয়ার্কের ক্ষেত্রে। এদের ক্ষেত্রেও একমাত্র পার্থক্য হলো ভর। অর্থাৎ হিগস ফিল্ড না থাকলে (মান শূন্য হলে) কাজিন কণিকাগুলোকে আর আলাদা করে চেনা যাবে না।

অন্যদিকে হিগস ফিল্ডের ঘনত্ব যদি সামান্য একটুও বাড়ে, তবে ইলেকট্রনের মতো কণাদের ভর বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ফলে পরমাণুর আকারও নাটকীয়ভাবে কমতে শুরু করবে। নিউট্রনগুলো ক্ষয় হতে শুরু করবে নিউক্লিয়াসের ভেতর। আর হিগস ফিল্ডের মান মাত্র কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলে নিউক্লিয়াস বলে কোন কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না। ফলে সম্ভব হবে নাহাইড্রোজেন ছাড়া আর কোন পরামাণু তৈরি হওয়া। কিন্তু হিগস ফিল্ডের অতি-ঘন অবস্থটি বর্তমান অবস্থা থেকে কয়েক গুন নয়, বরং বিলিয়ন বিলিয়ন গুন ঘন। ফলে ওই অবস্থায় মহাবিশ্বের বেশিরভাগ বস্তুই ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। আমাদের চেনা জানা মহাবিশ্বের কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। প্রাণের বিলুপ্তি ঘটবে!

এসব শুনে আমাদের আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাহলে কি হিগস ফিল্ডের ফেজ ট্রানজিশনের মাধ্যমেই আমাদের মহাবিশ্বের প্রাণের বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে হিগস বোসনের ভরের মধ্যে। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে—হিগস বোসনের ভর প্রায় ১২৫.৩ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট। এই ফলাফল থেকে সার্নের বিজ্ঞানীরা হিগস ফিল্ড বর্তমান অবস্থা থেকে অতি-ঘন অবস্থায় পরিবর্তিত হবার সম্ভাবনা হিসেব করে দেখেছেন। তাঁদের পাওয়া ফলাফল সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর। তাঁদের হিসেব অনুযায়ী- আমাদের পরিমাপ করা হিগস বোসনের ভর একটি বিশেষ অবস্থানে আছে। অর্থাৎ এর থেকে একটু বেশি-কম হলেই আমাদের মহাবিশ্ব একটি ফেজ ট্রাঞ্জিশনের মধ্য দিয়ে যাবে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন। আমাদের অবস্থা অনেকটা, মাঝারি উচ্চতার পর্বতের চূড়ায় ক্যাম্প করার মতো। একটু এদিক-ওদিক হলেই আমরা অনেক নিচের কোন গর্তে পড়ে যাব। তবে ভয় পাবার কিছু নেই। এই অবস্থা চূড়ান্ত রকমের অস্থিতিশীল হলেও আগামী কয়েক শ কোটি বছরের মধ্যে হিগস ফিল্ডের ফেজ ট্রানজিশন করার কোন সম্ভাবনা নেই। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী হিগস ফিল্ড ফেজ ট্রানজিশন করতে আরও ১০১০০ বছর সময় লাগবে। এটি আসলেই অনেক দীর্ঘ সময়।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক

সূত্র:

১. Gian Giudice, Ted Talk, Why our universe might exist on a knife-edge

২. Sean carrol, The particle at the end of the universe, Chapter eight, A world without higgs