চুলায় পানি ফোটালে বুদবুদ ওঠে, মাইক্রোওয়েভে ওঠে না কেন

পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গরম হলে টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছবি: গেটি ইমেজ

চায়ের জন্য চুলায় পানি বসিয়ে আমরা কিসের অপেক্ষা করি? পানি ফুটে বুদবুদ ওঠার। কারণ, ওই বুদবুদ উঠলেই আমরা বুঝতে পারি, পানি গরম হয়ে গেছে। পানি যত গরম হতে থাকে, বুদবুদও তত বড় হয়। পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গরম হলে টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। তখন আমরা সেই পানি দিয়ে চা বানাই।

কিন্তু আপনি কি কখনো মাইক্রোওয়েভে পানি গরম করেছেন? কখনো করলে খেয়াল করে দেখবেন, মাইক্রোওয়েভে পানি টগবগ করে ফোটে না। পানি গরম হয়ে সর্বোচ্চ বিন্দুতে চলে যায়, কিন্তু বুদবুদ দেখা যায় না। পানি থাকে শান্ত। কেন এই অদ্ভুত পার্থক্য? এর পেছনে লুকিয়ে আছে দারুণ ও কিছুটা ভয়ঙ্কর বিজ্ঞান!

প্রথমে জানতে হবে, পানি ফুটলে কেন বুদবুদ হয়? আসলে পানি ফুটতে হলে তাকে তরল থেকে বাষ্প বা গ্যাসে পরিণত হতে হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি তরল থেকে বাষ্পে পরিণত হতে চায়। কিন্তু শুধু চাইলেই তো হবে না! পানি ফুটতে হলে প্রথমে তৈরি করতে হয় বুদবুদ বা বাবল। এই বুদবুদ তৈরি করতে বেশ ভালোই শক্তি খরচ হয়।

কেন এই শক্তি খরচ হয়? কারণ, বুদবুদ হলো পানি ও গ্যাসের মাঝের একটা সীমানা বা পর্দা। পানির একটা বিশেষ ধর্ম আছে। এর নাম পৃষ্ঠটান। এই পৃষ্ঠটান হলো বুদবুদের জাতশত্রু! পৃষ্ঠটান সবসময় চেষ্টা করে, বুদবুদকে পিষে ফেলতে। মানে বুদবুদকে যতটা সম্ভব ছোট করে আবার তরলে পরিণত করতে। একটা বুদবুদ টিকে থাকতে হলে তার ভেতরের শক্তি দিয়ে এই পৃষ্ঠটানকে হারাতে হয়।

আরও পড়ুন
পানির একটা বিশেষ ধর্ম আছে। এর নাম পৃষ্ঠটান। পৃষ্ঠটান সবসময় চেষ্টা করে, বুদবুদকে পিষে ফেলতে।মানে বুদবুদকে যতটা সম্ভব ছোট করে আবার তরলে পরিণত করতে।

ছোট বুদবুদের আয়তনের তুলনায় পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল অনেক বেশি থাকে। তাই পৃষ্ঠটান জিতে যায় এবং বুদবুদ চুপসে যায়। কিন্তু বুদবুদ যত বড় হয়, এর আয়তন তত বাড়ে এবং সে পৃষ্ঠটানকে হারিয়ে স্থিতিশীল হয়।

এই যুদ্ধের কারণেই পানি প্রায়ই ঠিক ১০০ ডিগ্রিতে ফুটতে পারে না। পানি আরও গরম হতে থাকে। ১০১, ১০২, ১০৩ ডিগ্রি...। পৃষ্ঠটানকে হারানোর জন্য যে বাড়তি শক্তির দরকার, পানি তা সঞ্চয় করতে থাকে। একেই বলে সুপারহিটিং বা অতি-উত্তপ্ত হওয়া।

প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে চুলার পাত্রে এত সহজে বুদবুদ ওঠে কীভাবে? ইতালির বিজ্ঞানী মিরকো গ্যালো বলছেন, চুলার পাত্রে বুদবুদ তৈরির জন্য অনেক সাহায্যকারী থাকে। যেমন, পানিতে দ্রবীভূত গ্যাস, পানির ভেতরের সামান্য কণা বা ময়লা এবং পাত্রের অমসৃণ পৃষ্ঠ বা ধার।

মাইক্রোওয়েভে পানি গরম হয়ে সর্বোচ্চ বিন্দুতে চলে যায়, কিন্তু বুদবুদ দেখা যায় না। পানি থাকে শান্ত
ছবি: পেটিশেফ

এই সাহায্যকারীরা বুদবুদ তৈরির শক্তি একদম কমিয়ে দেয়। পাত্রের তলায় বুদবুদ তৈরি করা অনেক সহজ। কারণ তখন বুদবুদকে পুরো গোল হতে হয় না, অর্ধেক গোল হলেই চলে। তাই শক্তিও কম লাগে। এ কারণেই বুদবুদ সবসময় পাত্রের তলা থেকেই উঠতে শুরু করে!

এবার আসা যাক মাইক্রোওয়েভের ঘটনায়। মাইক্রোওয়েভে বুদবুদ না হওয়ার দুটি কারণ আছে। এক, চুলায় যখন পানি গরম হয়, তখন শুরুতে পাত্র গরম হয়, তারপর পানি। অর্থাৎ, পাত্রের তলা থেকে পানি গরম হতে থাকে। নিচের পানি গরম হলে হালকা হয়ে যায়, তাই ওপরে উঠে আসে। ওপরের ঠান্ডা ভারী পানি নিচে চলে যায়। এভাবে সম্পূর্ণ পানি ধীরে ধীরে গরম হয়। কিন্তু মাইক্রোওয়েভ বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে পুরো পানিকে একসঙ্গে, সমানভাবে গরম করে। তাই বুদবুদ শুরু করার মতো কোনো নির্দিষ্ট তলা থাকে না।

আরও পড়ুন
ইতালির বিজ্ঞানী মিরকো গ্যালো বলছেন, চুলার পাত্রে বুদবুদ তৈরির জন্য অনেক সাহায্যকারী থাকে। যেমন, পানিতে দ্রবীভূত গ্যাস, পানির ভেতরের সামান্য কণা বা ময়লা এবং পাত্রের অমসৃণ পৃষ্ঠ বা ধার।

দ্বিতীয় কারণ হলো, মাইক্রোওয়েভে সাধারণত মসৃণ পাত্র ব্যবহার করা হয়। অনেকে আবার সিরামিকের তৈরি জিনিসও ব্যবহার করেন। সেখানেও বুদবুদ তৈরির জন্য কোনো অমসৃণ ধার বা ময়লা থাকে না।

এই সাহায্যকারীদের অভাবে পানি টগবগ করে ফুটতে পারে না। ধীরে ধীরে পানি গরম হতে হতে ১০০ ডিগ্রি পেরিয়ে ১১০, এমনকি ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যেতে পারে! পানি তখন অনেক শক্তি জমা থাকে।

মাইক্রোওয়েভে সাধারণত কোনো অমসৃণ ধার বা ময়লা থাকে না। এই সাহায্যকারীদের অভাবে পানি টগবগ করে ফুটতে পারে না।
ছবি: কুকিস্ট

ঠিক সেই মূহূর্তে যদি আপনি কাপটা নাড়া দেন বা তাতে এক চামচ কফি বা চিনি ফেলেন, তাহলে ওই জমানো শক্তি এক মুহূর্তে বিস্ফোরকের মতো একটা বিশাল বুদবুদ হয়ে ফেটে বের হবে। এ কারণেই মাইক্রোওয়েভে গরম করা পানি হঠাৎ ছিটকে এসে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

এই ঘটনা যেকোনো তরলের ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে পানির পৃষ্ঠটান খুব বেশি হওয়ায় এর প্রভাবটাও বেশি নাটকীয় হয়। তাই মাইক্রোয়েভে পানি গরম করতে চাইলে ১০০ ডিগ্রির বেশি গরম করা ঠিক নয়।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন