সূর্য কেন ধীরে জ্বলে

আমরা অনেক সময় ভুলে যাই যে আমরা বাস করি একটি তারার পাশেই। বলা বাহুল্য, পৃথিবীর প্রায় সব জীবনই এই তারাটির ওপর নির্ভর করে—আমাদের আবহাওয়া, উদ্ভিদ জীবন, শস্য—সবই। আমরা জানি এই আলোর উৎস হচ্ছে সূর্যের গভীরে কেন্দ্রীন সংযোজন বা নিউক্লিয়ার ফিউশন। এই ফিউশন বিক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ আছে, যাকে প্রোটন-প্রোটন অনুসৃত শৃঙ্খল (chain) বলা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যার ফলাফল হলো হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তর করা—

এই সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে চারখানা প্রোটন বা চারটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস একসঙ্গে হয়ে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস, দুটি পজিট্রন, দুটি ইলেকট্রন নিউট্রিনো ও দুটি গামা ফোটন সৃষ্টি করছে। ফোটন হলো আলোক কণিকা, কিন্তু গামা ফোটন দৃশ্যমান আলোর থেকে, এমনকি এক্স-রে থেকেও শক্তিশালী। আমরা গামা রশ্মিকে চোখে দেখতে পাই না। আর এই বিক্রিয়ায় যে পজিট্রন সৃষ্টি হয়, যাকে প্রতি–ইলেকট্রন বলা যায়, সেটি ইলেকট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে আরও গামা রশ্মি তৈরি করে। পজিট্রনের বৈদ্যুতিক চার্জ ধনাত্মক, ইলেকট্রনের ঋণাত্মক। এই দুটি চার্জ একে অপরকে ধ্বংস করে শক্তি বা গামা ফোটন সৃষ্টি করে। সূর্যের কেন্দ্র থেকে গামা ফোটনের এই শক্তি বিকিরণ (radiation) ও পরিচলনের (convection) মাধ্যমে সূর্যপৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে এক লাখ বছরের ওপর সময় লেগে যায়। আর এই সময়টুকুতে গামা রশ্মি তার শক্তি খুইয়ে মূলত দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়। এরপর এই দৃশ্যমান আলোক মাত্র ৫০০ সেকেন্ড সময় নেয় আমাদের কাছে পৌঁছাতে। কাজেই আমরা আজ যে সূর্যালোক পাচ্ছি তা সূর্যের কেন্দ্রে সৃষ্টি হয়েছিল লাখো বছর আগে, পৃথিবীতে বর্তমান মানুষের আবির্ভাবের আগে। এই আলোর উজ্জ্বলতা হলুদ-সবুজ রঙের কম্পাঙ্কে সবচেয়ে বেশি, তাই আমাদের চোখও হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে ওই কম্পাঙ্কে সবচেয়ে সংবেদনশীল।।

সুড়ঙ্গ প্রক্রিয়ার জন্য ১০ বিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রার বদলে ১৫ মিলিয়ন কেলভিনই যথেষ্ট। সুড়ঙ্গ প্রক্রিয়া, যাকে ইংরেজিতে quantum tunneling বলা হয়, শুধু যে নিম্ন তাপমাত্রায় কেন্দ্রীন সংযোজন কার্যকর করে তা–ই নয়, এটি সূর্যকে শতকোটি বছর উজ্জ্বল করে রাখতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন

আবার ফিরে যাই সূর্যের কেন্দ্রে, যাকে সূর্যের অন্তস্তল বলা যেতে পারে। সেখানকার তাপমাত্রা হলো ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটি কেলভিন আর চাপ হলো পৃথিবীপৃষ্ঠে বায়ুমণ্ডলের চাপের চেয়ে ২৫০ বিলিয়ন বা ২৫ কোটি গুণ বেশি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এত পরিমাণ তাপে আর চাপেও দুটি প্রোটনকে একীভূত (কেন্দ্রীন সংযোজন বা ফিউশন) করে হিলিয়াম সৃষ্টি করার কথা নয়। কেন? কারণ, প্রোটন ধনাত্মক আধান (পজিটিভ চার্জ) বহন করে, দুটি একই প্রকারের আধান একে অপরকে বিকর্ষণ করে। যত তাদের কাছাকাছি আনা যায় তত বিকর্ষণ বল বাড়ে। একে আমরা কুলম্ব বিকর্ষণ বা আকর্ষণ (যখন আধানের চিহ্ন বিপরীত হয়) বল হিসেবে জানি, যা কিনা আধান দুটির মধ্যে দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতের ওপর নির্ভর করে। এই বিকর্ষণ বলকে অতিক্রম করে দুটি প্রোটনের একীভূত হতে প্রায় ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি কেলভিন তাপমাত্রার প্রয়োজন। কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা মাত্র ১৫ মিলিয়ন কেলভিন, তাহলে সেখানে কেন্দ্রীন সংযোজন কীভাবে সম্ভব?

এটার ব্যাখ্যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় ক্ষুদ্র কণার তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য আছে, তাতে প্রতিটি প্রোটনকে একটি তরঙ্গ প্যাকেট হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে। যখন দুটি প্রোটন খুব কাছাকাছি আসে তাদের তরঙ্গের কিছুটা (বা শেষ অংশটা) একে অপরের ওপর সমাপতিত হয়। আমরা বলতে পারি সেই সময় ওই তরঙ্গের যেকোনো জায়গায় একটি প্রোটন কণা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, শুধু সেই আবির্ভাবের সম্ভাব্যতা এক এক জায়গায় এক এক রকম হবে, তরঙ্গের শেষ প্রান্তে কম হবে। তাই দুটি প্রোটনের একটি, অন্য প্রোটনের কুলম্ব বিকর্ষণের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ করে সেই প্রোটনের সঙ্গে মিলিত (ফিউশন) হতে পারে। সুড়ঙ্গ প্রক্রিয়ার জন্য ১০ বিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রার বদলে ১৫ মিলিয়ন কেলভিনই যথেষ্ট। সুড়ঙ্গ প্রক্রিয়া, যাকে ইংরেজিতে quantum tunneling বলা হয়, শুধু যে নিম্ন তাপমাত্রায় কেন্দ্রীন সংযোজন কার্যকর করে তা–ই নয়, এটি সূর্যকে শতকোটি বছর উজ্জ্বল করে রাখতে সাহায্য করে। একটি প্রোটনের সুড়ঙ্গে করে আর একটি প্রোটনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। মনে করা হয় গড়ে একটি প্রোটনকে কয়েক শ কোটি বছর অপেক্ষা করতে হবে সুড়ঙ্গিত হতে, কিন্তু সূর্যে প্রোটনের অভাব নেই, তাই বহু প্রোটন প্রতি সেকেন্ডে সংযোজিত হচ্ছে। এই সুড়ঙ্গ প্রক্রিয়ায় সূর্য ধীরে জ্বলে, দ্রুত পুড়ে যাওয়ার বদলে।

কিন্তু কেন্দ্রীন সংযোজন বা ফিউশন প্রক্রিয়াকে শ্লথ করার জন্য আর একটি পদ্ধতি বিদ্যমান। মনে রাখতে হবে হিলিয়াম পরমাণু দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন দিয়ে গঠিত, তাই প্রোটন-প্রোটন সংযোজন ও অনুসৃত শৃঙ্খলে সংযোজিত প্রোটনকে নিউট্রনে রূপান্তরিত হতে হয়।

ফোটন হলো আলোক কণিকা, কিন্তু গামা ফোটন দৃশ্যমান আলোর থেকে, এমনকি এক্স-রে থেকেও শক্তিশালী। আমরা গামা রশ্মিকে চোখে দেখতে পাই না। আর এই বিক্রিয়ায় যে পজিট্রন সৃষ্টি হয়, যাকে প্রতি–ইলেকট্রন বলা যায়, সেটি ইলেকট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে আরও গামা রশ্মি তৈরি করে।
আরও পড়ুন

ওপরের সমীকরণটিকে বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা বলি একটি প্রোটন, একটি নিউট্রন, একটি পজিট্রন ও একটি ইলেকট্রন নিউট্রিনোতে ক্ষয়প্রাপ্ত বা রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তর পদ্ধতি সাধিত হয় দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রকৃতির চারটি বলের মধ্যে নিউক্লীয় বা কেন্দ্রীন দুর্বল বল বা মিথস্ক্রিয়া, তড়িৎ-চুম্বকীয় ও কেন্দ্রীন সবল মিথস্ক্রিয়ার তুলনায় অল্প শক্তির এবং এটি খুব ধীরগতিতে অগ্রসর হয়। দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার এই শ্লথ গতি ওপরে বর্ণিত কোয়ান্টাম প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সূর্যের কেন্দ্রে ফিউশন প্রক্রিয়াকে খুব ধীর করে দেয়, যার ফলে কয়েক মিলিয়ন বছরের পরিবর্তে সূর্য কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে জ্বলতে পারে।

দুর্বল বল বা মিথস্ক্রিয়া দুর্বল কেন? সংক্ষেপে এর উত্তর দিতে হলে আমাদের ওপরের যে সমীকরণটি আছে সেটাকে আমরা ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম দিয়ে প্রকাশ করতে পারি।

একটি প্রোটন যা কিনা দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্কের সমষ্টি, সেটি একটি W+ বোসন কণা বিকিরণ করে একটি নিউট্রনে রূপান্তরিত হচ্ছে

নিচের চিত্রে দেখানো হচ্ছে যে একটি প্রোটন যা কিনা দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্কের সমষ্টি, সেটি একটি W+ বোসন কণা বিকিরণ করে একটি নিউট্রনে রূপান্তরিত হচ্ছে। এখানে W+ কণা দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার বাহন, যেমন ফোটন হলো তড়িৎ–চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার বাহন। নিউট্রনটি দুটি ডাউন কোয়ার্ক ও একটি আপ কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত। এই প্রক্রিয়ায় মূলত প্রোটনের একটি আপ কোয়ার্ক একটি ডাউন কোয়ার্কে পরিণত হয় W+ কণার মাধ্যমে। এই W+ কণাটি আবার কিছুক্ষণ পরে একটি পজিট্রন ও একটি ইলেকট্রন নিউট্রিনোতে ক্ষয়িত হয়। কিন্তু একটি প্রোটনের তুলনায় W+এর ভর প্রায় ৮৬ গুণ বেশি। এত ভরের একটি কণা আসে কোনখান থেকে? মূলত শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়াম থেকে। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী শূন্যস্থান থেকে শক্তি নিয়ে একটি কণা খুব অল্প সময়ের জন্য সৃষ্টি হতে পারে, সেই সময়ের পর কণাটি অদৃশ্য হবে আবার শূন্যতে তার সব শক্তি ফেরত দিয়ে। এ ধরনের কণাকে অলীক (virtual) কণা বলা হয়। কণার শক্তি যত বেশি হবে তার স্থায়িত্বকাল তত কম হবে। W+ ১০-২৫ সেকেন্ডেরও কম সময় স্থায়ী হয়। কিন্তু এই বিশাল ভরের W কণাকে অল্প সময়ের জন্য সৃষ্টি করতে বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়, যা কিনা দুর্বল মিথস্ক্রিয়াকে শ্লথ করে দেয়। সূর্য এই সুড়ঙ্গ প্রক্রিয়া কোয়ান্টাম প্রক্রিয়ায় দুটি প্রোটনকে এক করে (যা কিনা একটি সবল মিথস্ক্রিয়ার উদাহরণ) এবং শ্লথ দুর্বল প্রক্রিয়ায় প্রোটনকে নিউট্রনে রূপান্তরিত করে। সূর্য প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি কিলোগ্রাম ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করছে, যে শক্তির একটা অংশকে সূর্যালোক হিসেবে পৃথিবীতে আমরা পাই। এই সংখ্যাটা বেশ বড় মনে হলেও আসলে গত ৪.৫ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি বছরে, যত দিন তার অস্তিত্ব আছে, সূর্য মাত্র তার ০.০৩% ভাগ ভর খুইয়েছে। ওপরে যে দুটি ধীর প্রক্রিয়া আমরা বর্ণনা করেছি, সে দুটি না থাকলে সূর্য বহু আগেই তার জ্বালানি পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিত এবং পৃথিবীর বুকে প্রাণিজগতের বিবর্তনের সুযোগ দিত না।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া

* লেখাটি ২০২০ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন