গ্রহাণু কি দিতে পারবে পঞ্চম বলের সন্ধান

ওসাইরিস-রেক্স নভোযানের ক্যাপসুলছবি: নাসা

পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত মডেলে চারটি মৌলিক বল দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো হলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং মহাকর্ষ বল। আমাদের চেনা জগতের সব কারবার, মানে মহাবিশ্বের সব বস্তুর গতি-প্রকৃতি থেকে শুরু করে গঠন পর্যন্ত সবকিছুর পেছনেই এই চারটি বল। কিন্তু মহাবিশ্বে কি শুধু চারটা মৌলিক বলই আছে? নাকি লুকিয়ে আছে আরও কোনো রহস্যময় বল?

এখানেই শুরু আসল রহস্যের। কারণ, এই পঞ্চম মৌলিক বলের গল্পটা শুধু নতুন তত্ত্ব নয়, এর পেছনে আছে একের পর এক চমকপ্রদ আবিষ্কারের ইতিহাস। শুরুটা হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানীরা সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন, হয়তো আরেকটা মৌলিক বল মহাবিশ্বে আছে। কেন এ সন্দেহ হলো বিজ্ঞানীদের? কারণ, আমাদের পরিচিত তত্ত্বগুলো দিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছিল না। মানে এমন কিছু ঘটনা মহাবিশ্বে ঘটে, চারটা মৌলিক বল দিয়ে যার ব্যাখ্যা মেলে না।

পঞ্চম মৌলিক বল তো হাতের নাগালেই আছে, তাহলে আপনাদের একটু সাবধান করে দিই। পদার্থবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ মনে করেন, পঞ্চম বল বলে কিছু নেই। এখন পর্যন্ত যেহেতু এই বল তাত্ত্বিক অবস্থায় রয়েছে, তাই জোর দিয়ে কিছু বলাও যায় না।

এরপর অনেক বিজ্ঞানীই পঞ্চম মৌলিক বল আবিষ্কারের দাবি করেছেন! যেমন ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, অ্যান্টিগ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষবিরোধী কোনো বল হয়তো এই পঞ্চম বল। ২০০০ সালের দিকে আরেক দল বিজ্ঞানী দাবি করলেন, ‘কুইনটেসেন্স’ নামে এক অদৃশ্য শক্তিই হলো পঞ্চম বল। এর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় ডার্ক এনার্জি। এরপর ২০১৫ সালে হাঙ্গেরির একদল বিজ্ঞানী এমন এক কণার সন্ধান পান, যার ভর ইলেকট্রনের ৩০ গুণ! তাঁরা ধারণা করেন, এই কণাই পঞ্চম বলের আভাস দিতে পারে। এমনকি ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মিল্যাব ঘোষণা দেয়, তারা এই রহস্যময় বলের সন্ধানের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

আরও পড়ুন

এটুকু জেনে যদি ভেবে বসেন, পঞ্চম মৌলিক বল তো হাতের নাগালেই আছে, তাহলে আপনাদের একটু সাবধান করে দিই। পদার্থবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ মনে করেন, পঞ্চম বল বলে কিছু নেই। এখন পর্যন্ত যেহেতু এই বল তাত্ত্বিক অবস্থায় রয়েছে, তাই জোর দিয়ে কিছু বলাও যায় না। তবে আশা ছাড়ছেন না একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা মহাকাশে পঞ্চম মৌলিক বলের সন্ধান পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। তাঁদের ধারণা, গ্রহাণুতে মিলবে পঞ্চম বলের সন্ধান।

বেণু গ্রহাণু
ছবি: নাসা

গ্রহাণুর কথা বললে সামনে আসবে বেণু গ্রহাণুর নাম। বিজ্ঞানীরা এক নতুন উপায় বের করেছেন এই পঞ্চম বলের অস্তিত্ব খুঁজতে। তাঁরা ভাবলেন, যদি সত্যিই কোনো পঞ্চম বল থাকে, তাহলে সেটা হয়তো গ্রহাণুর গতিপথে কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। গ্রহাণুটিও আমাদের খুব পরিচিত। ১৯৯৯ সালে এটি আবিষ্কারের পর থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। চোখে দেখা পর্যবেক্ষণ ছাড়াও রাডার, রেডিও তরঙ্গ, এবং মহাকাশযানের ট্র্যাকিং ডেটার মাধ্যমে এর গতি ও কক্ষপথ নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওসাইরিস-রেক্স নামে একটি মহাকাশযান সম্প্রতি বেণু গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। সেই নমুনা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

যা-ই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। বেণু গ্রহাণুর সাহায্যে পঞ্চম বলের সন্ধান কি সত্যিই পাওয়া যাবে? সত্যি বলতে, বেণু গ্রহাণুর গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে এখনো তেমন কোনো সম্ভাবনা মেলেনি। তবু বিজ্ঞানীরা আশা ছাড়ছেন না।

বেণু গ্রহাণুকে পর্যবেক্ষণে রাখার উদ্দেশ্য একটাই—এর গতিপথে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তা দেখা। যদি গ্রহাণুটির গতিপথে সামান্য ব্যতিক্রমও ধরা পড়ে, তবে তা হতে পারে কোনো অজানা বলের কাজ। হতে পারে সেটাই পঞ্চম বল!

নেচার কমিউনিকেশন ফিজিকস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে একদল বিজ্ঞানী বলেছেন, বেণুর গতিপথ বিশ্লেষণ করে আমরা মহাবিশ্বের মূল কাঠামো সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পারি। এই গবেষণার প্রধান লেখক ইউ-দাই চাই বলেন, ‘অনেক সময় মহাজাগতিক বস্তুগুলোর গতিপথে অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার দেখা যায়। এগুলোই হতে পারে পদার্থবিদ্যার নতুন কোনো সূত্রের ইঙ্গিত।’

আরও পড়ুন

এমন পদ্ধতি আগেও কাজে লেগেছে। নেপচুন আবিষ্কারের কথাই ধরুন। এই গ্রহ কিন্তু কোনো টেলিস্কোপে দেখে আবিষ্কার করেননি বিজ্ঞানীরা। বরং ইউরেনাসের কক্ষপথে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, সেখানে আরও একটি গ্রহ আছে। পরে সেই ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়। তবে এ পদ্ধতি সব সময় কাজে লাগে না। যেমন একসময় সূর্য আর বুধের মাঝে ভালকান নামে একটি গ্রহ থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন একদল বিজ্ঞানী। এ ধারণা পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। তাই এমন ভবিষ্যদ্বাণী সব সময় সত্যি না হলেও সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়।

যা-ই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। বেণু গ্রহাণুর সাহায্যে পঞ্চম বলের সন্ধান কি সত্যিই পাওয়া যাবে? সত্যি বলতে, বেণু গ্রহাণুর গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে এখনো তেমন কোনো সম্ভাবনা মেলেনি। তবু বিজ্ঞানীরা আশা ছাড়ছেন না। ওসাইরিস-রেক্সের পর বিজ্ঞানীদের নতুন মিশন ওসাইরিস-অ্যাপেক্স। এই মিশনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নজর রাখবেন অ্যাপোফিস নামে আরেকটি গ্রহাণুর দিকে। ২০২৯ সালে এটি পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে যাবে। তখন এই গ্রহাণুকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা গেলে হয়তো আরও নিখুঁত তথ্য পাওয়া যাবে।

পরমাণুর গঠন বোঝার সময় কেউ জানত না যে একদিন পারমাণবিক শক্তি আমাদের হাতে আসবে। তাই পঞ্চম বল যদি সত্যিই আবিষ্কৃত হয়, তাহলে হয়তো এটা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাই পাল্টে দেবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই পঞ্চম বল যদি সত্যিই থাকে, তাহলে তা আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? আসলে এর উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিহাস বলে, পদার্থবিজ্ঞানের যেকোনো নতুন আবিষ্কার শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রযুক্তিগত জীবনে বিপ্লব এনে দেয়। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল আবিষ্কারের সময় কেউ ভাবেনি যে একদিন আমরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করব। পরমাণুর গঠন বোঝার সময় কেউ জানত না যে একদিন পারমাণবিক শক্তি আমাদের হাতে আসবে। তাই পঞ্চম বল যদি সত্যিই আবিষ্কৃত হয়, তাহলে হয়তো এটা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাই পাল্টে দেবে। হয়তো ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির রহস্য ভেদ হবে। স্থান-কালের প্রকৃতি সম্পর্কেও হয়তো জানা যাবে নতুন কিছু।

পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করছে অনেক গ্রহাণু
রয়টার্স

এই মুহূর্তে বেণুর ডেটায় পঞ্চম বলের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকই, তবে হতে পারে পঞ্চম বল এত সূক্ষ্ম যে আমাদের বর্তমান যন্ত্রপাতিতে তা ধরা পড়ছে না। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। একের পর এক গবেষণা, ব্যর্থতা, তারপর হঠাৎ একদিন নতুন আবিষ্কার, এমনটা আগে বহুবার হয়েছে।

আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন মহাবিশ্বের সবচেয়ে গভীর রহস্যগুলো উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমরা জানতে পারব, সত্যিই পঞ্চম বল আছে কি না। আর যদি থাকে, তাহলে সেটা হবে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর একটি।

সূত্র: পপুলার মেকানিকস

আরও পড়ুন