সাক্ষাৎকার
‘অক্টোবরে যে নোবেল দেয়, তা মনেই ছিল না’—পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী মিশেল দ্যভোরে
ফরাসি বিজ্ঞানী মিশেল দ্যভোরে চলতি বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ গবেষক জন ক্লার্ক ও মার্কিন বিজ্ঞানী জন মার্টিনিস। ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং ইলেকট্রিক সার্কিটে এনার্জি কোয়ান্টাইজেশন গবেষণার জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
মিশেল দ্যভোরে ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮২ সালে প্যারিস-সুড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেন পিএইচডি। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর মিশেল দ্যভোরে তাঁর প্রাথমিক অনুভূতি জানান। তিনি বলেন, ‘গবেষণার ফল বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখার চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। পুরস্কার ঘোষণার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, বিশ্বজুড়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে অক্টোবর মাস যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়, তা আমার মনেই ছিল না!’ নোবেল জয়ের পর তিনি অ্যাডাম স্মিথকে একটা সাক্ষাৎকার দেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন জিনাত শারমিন।
মিশেল দ্যভোরে: হ্যালো…
অ্যাডাম স্মিথ: হ্যালো, আমি অ্যাডাম স্মিথ, নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ থেকে বলছি। আমি কি মিশেল দ্যভোরের সঙ্গে কথা বলছি?
মিশেল দ্যভোরে: হ্যাঁ, তবে মনে হচ্ছে কিছু গন্ডগোল হয়েছে—নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ নামে কি আপনাদের আর কোনো সংস্থা আছে?
অ্যাডাম স্মিথ: না না, আমিই নোবেল প্রাইজ ডটঅর্থ থেকে ফোন করেছি।
মিশেল দ্যভোরে: তাহলে একটু আগে কার সঙ্গে কথা বললাম? আচ্ছা যা-ই হোক…
অ্যাডাম স্মিথ: গত দুই দিনে নিশ্চয়ই আপনার জীবনে অনেককিছু ঘটে গেছে। এটুকু বিভ্রান্তি হতেই পারে…
মিশেল দ্যভোরে: হ্যাঁ, বোধহয় নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর যেমনটা হয়, ঠিক তেমনই।
অ্যাডাম স্মিথ: এখন বলুন, খবরটা আপনি কীভাবে জানলেন?
মিশেল দ্যভোরে: আমি মঙ্গলবার সকাল সাতটায় (ক্যালিফোর্নিয়ার স্থানীয় সময়) ঘুম থেকে উঠি। উঠে দেখি, আমার মোবাইল ও কম্পিউটারে প্রচুর নোটিফিকেশন। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো ভুয়া খবর ছড়িয়েছে। কেউ আমাকে নিয়ে মজা করছে। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিইনি। পরে দেখি, ব্যাপারটা বেশ গুরুতর হয়ে উঠছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি আমার মেয়েকে ফোন করি। সে প্যারিসে থাকে এবং আমার চেয়ে নয় ঘণ্টা এগিয়ে। তখনই বুঝলাম, ঘটনা সত্যি!
অ্যাডাম স্মিথ: অর্থাৎ সে অনেক আগেই খবরটা জেনে ফেলেছিল।
মিশেল দ্যভোরে: হ্যাঁ। আসলে আমি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম যে অক্টোবর মাস নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময়।
অ্যাডাম স্মিথ: অর্থাৎ আপনি পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিলেন।
মিশেল দ্যভোরে: হ্যাঁ, পুরোপুরি অপ্রস্তুত! অনেক পদার্থবিদ অক্টোবরের শুরুতে খানিকটা দুশ্চিন্তায় থাকেন, কিন্তু আমি একদমই সেরকম মানসিকতায় ছিলাম না।
অ্যাডাম স্মিথ: সৌভাগ্যবশত আপনি আগের রাতে ভালো ঘুমিয়েছিলেন—ফলে সাংবাদিকদের সামলানোর জন্য তৈরি ছিলেন।
মিশেল দ্যভোরে: হ্যাঁ, হুবহু জন মার্টিনিসের মতোই ঘটনা ঘটেছে আমার সঙ্গেও। তাঁর স্ত্রীও তাঁকে জাগাননি, হয়তো জানেন...
অ্যাডাম স্মিথ: হ্যাঁ। আমাকেও বলেছেন মার্টিনিস। জন মার্টিনিস ও জন ক্লার্ক দুজনেই বলছিলেন, ৪০ বছর আগের বার্কলির ল্যাবের সেই স্বর্ণালি সময়ের কথা। আপনার কাছে সেই সময়টা কেমন ছিল?
মিশেল দ্যভোরে: হ্যাঁ, আমারও একইরকম স্মৃতি। সেই গবেষণাগারে কাজ করার সময়টা আমার কাছে অমূল্য ছিল। আমরা স্বাধীনভাবে পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে কাজ করছিলাম। আমরা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ভাবতাম, বিশ্লেষণ করতাম এবং আলোচনা করতাম। সেটি আমাদের সবার জীবনেরই সেরা সময় ছিল।
অ্যাডাম স্মিথ: মজার ব্যাপার হলো, আপনারা তিনজন ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এসেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলেই কাজ করলেন। এই সপ্তাহে ঘোষিত নয়জন নোবেলজয়ীর মধ্যে ছয়জনই যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে কর্মরত। আপনার কী মনে হয়, এর রহস্য কী?
মিশেল দ্যভোরে: আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল, পশ্চিম উপকূল হলো ‘আমেরিকার আমেরিকা’। এর মানে হলো, এটি দ্বিগুণ আমেরিকা! এখানে এখনও আবিষ্কারের এক ধরনের রোমাঞ্চ আছে। বার্কলিও একটি দারুণ বিশ্ববিদ্যালয়। এর কাজের পরিবেশ খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনি নানা জায়গায় কাজ করেছেন এবং সবসময় বড় চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবেসেছেন। এখন আপনি গুগল কোয়ান্টাম এআইয়ের একজন প্রধান বিজ্ঞানী। কোন বিষয়টি আপনাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে?
মিশেল দ্যভোরে: দেখুন, ৪০ বছর আগে আমরা কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তি নিয়ে একটি মৌলিক প্রশ্ন দিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। পরে আমাদের সেই আবিষ্কার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গুগল এই গবেষণায় সামনের সারিতে রয়েছে। বিশেষ করে, কোয়ান্টাম এরর কারেকশন বা কোয়ান্টাম ত্রুটি সংশোধনের ক্ষেত্রে গুগল নেতৃত্ব দিচ্ছে। বড় আকারের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির জন্য এটি অপরিহার্য। একারণেই আমি গুগলে কাজ করতে আগ্রহী হয়েছি।
অ্যাডাম স্মিথ: অবিশ্বাস্য অগ্রগতি। তবে সময়ও লেগেছে বেশ।
মিশেল দ্যভোরে: অবশ্যই। প্রাথমিক আবিষ্কার থেকে কোনো শিল্পের সূচনায় পৌঁছাতে দশকের পর দশক লাগে।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনি কি নিজের এই যাত্রা দেখে অবাক হন? মানে মৌলিক প্রশ্ন থেকে বাস্তব প্রয়োগের দিকে?
মিশেল দ্যভোরে: একটি মৌলিক আবিষ্কার তখনই সত্যিকারের পূর্ণতা পায়, যখন সেটি কোনো বাস্তব কাজে প্রয়োগ করা যায়। আমাকে এমন বিজ্ঞানীরা অনুপ্রাণিত করেছিলেন, যাঁরা মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা একসঙ্গে করেছেন। এক্ষেত্রে জন ক্লার্কই আমার আদর্শ। আমি তাঁর গবেষণাগারে যোগ দিয়েছিলাম, কারণ তিনি সুপারকন্ডাকটিভিটি নিয়ে মৌলিক গবেষণার পাশাপাশি স্কুইড সেন্সর ডিভাইস নিয়েও কাজ করছিলেন। লর্ড কেলভিনও আমাদের একজন পূর্বসূরি। তিনি তাপগতিবিদ্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। আবার আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম ট্রান্সআটলান্টিক টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনকারী কোম্পানিরও অংশ ছিলেন। অর্থাৎ, তিনিও মৌলিক বিজ্ঞান ও শিল্প—দুটোতেই সমান সক্রিয় ছিলেন।
অ্যাডাম স্মিথ: অসাধারণ উদাহরণ! এই পুরস্কার আপনার কাজের জন্য কতটা পরিবর্তন আনবে বলে আপনি মনে করেন?
মিশেল দ্যভোরে: হ্যাঁ, কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবে বটে। তবে একইসঙ্গে এটি আমাকে তরুণ ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেবে। যোগাযোগের অসংখ্য বন্ধ দুয়ার খুলে দেবে।
অ্যাডাম স্মিথ: আপনি তরুণ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যুক্ত হতে চান, তাদের জন্য কাজ করতে চান শুনে দারুণ লাগল। তরুণদের জন্যও এটা একটা দারুণ সুযোগ।
মিশেল দ্যভোরে: আমরা স্কুলে বিজ্ঞান শিখি। কিন্তু প্রকৃত বিজ্ঞান তখনই জীবন্ত হয়ে ওঠে, যখন আমরা কোনো বিজ্ঞানীকে সরাসরি দেখি। তাঁদের চিন্তার স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা অনুভব করি। এই অভিজ্ঞতা বইয়ের পাতায় পাওয়া যায় না।
অ্যাডাম স্মিথ: একজন বিজ্ঞানীর জীবন্ত উপস্থিতি সবসময় পাঠ্যবইয়ের চেয়ে বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দ পেলাম। আশা করি, সপ্তাহের শেষে আপনি কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
মিশেল দ্যভোরে: দেখা যাক। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।