ফিশন বিক্রিয়ার জননী লিজ মাইটনার

নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ার জননী বলা হয় লিজ মাইটনারকে। তিনিই প্রথম লিকুইড ড্রপলেট মডেলের মাধ্যমে এ বিক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন। অথচ পাননি যথার্থ স্বীকৃতি। আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে ৯ম ইন্টারন্যশনাল ডে অব ওমেন অ্যান্ড গার্লস ইন সায়েন্স। এই দিনে চলুন তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

লিজ মাইটনারকে বলা হয় ফিশন বিক্রিয়ার জননী। লিকুইড ড্রপলেট মডেলের মাধ্যমে তিনি ফিশন বিক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন ১৯৩৯ সালে। তার আগে পাঁচ বছর পেছনে ফিরে যাওয়া যাক।

১৯৩৪ সাল। ফিশন নিয়ে কাজ করছেন এনরিকো ফার্মি। মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা তাঁর নামে পরিচিত! কী করলেন তিনি? সহজ করে বললে, তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াসের দিকে ছুঁড়ে দিলেন নিউট্রন। সেই আঘাতের ফলে ভেঙ্গে গেল মৌলটি, তৈরি হলো তার তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। এটিই ফিশন। কিন্তু তখনও এর নাম ফিশন হয়নি। এদিকে, ইউরেনিয়ামের ফিশন নিয়ে ঝামেলা লেগে গেল। এত বড় ও ভারী কোনো মৌলের নিউক্লিয়াসকে যে নিউট্রনের টোকায় দুই ভাগ করে ফেলা যায়, সেটা অনেক বিজ্ঞানীরাই মানতে পারছিলেন না।

কেন এমন হয়, সে ব্যাখ্যাই দেন মাইটনার, ১৯৩৯ সালে। লিকুইড ড্রপলেট মডেলের মাধ্যমে। সহজ ভাষায়, লিকুইড ড্রপলেট মডেল বলে, নিউক্লিয়াস আসলে পানির ফোঁটার মতো। পানির ফোঁটার কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠটানের জন্য ফোঁটাটার ভেতরের অণুগুলো একসঙ্গে থাকে।

একই জিনিস যদি নিউক্লিয়াসের জন্য ভাবি, সমধর্মী চার্জগুলোকে একসঙ্গে ধরে রাখে একটি বল (Force)। উত্তপ্ত কোনো নিউট্রন যখন এই নিউক্লিয়াসে আঘাত করে, তখন সেটাসহ একসঙ্গে জটিল গড়নের এক নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। বাড়তি নিউট্রনের জন্য এই নিউক্লিয়াসের ভেতরে কিছু বাড়তি শক্তি জমা হয়। এই শক্তির কারণে নিউক্লিয়াসের ভেতরে তৈরি হয় দ্রুতগতির কম্পন। ফলে নিউক্লিয়াসটা কাঁপতে কাঁপতে ডাম্বেল বা বেলনাকার ধারণ করে, ভাঙ্গতে থাকে সেই বলের বাঁধন। তারপর নিউক্লিয়াসটা মাঝখান থেকে দুই ভাগ হয়ে যায়, পরিণত হয় দুটো ভিন্ন ফোঁটায়, মানে ভিন্ন নিউক্লিয়াসে।

অনেক বিজ্ঞানী মানতে পারছিলেন না, ইউরেনিয়ামের মতো ভারী নিউক্লিয়াস নিউট্রনের টোকায় দুইভাগ হয়ে যেতে পারে। এটা মানতে না পারলেও অনেক বিজ্ঞানী মেনে নিয়েছিলেন, ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করলে ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল তৈরি হয়। এদের মধ্যে মাইটনার যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আইরিন জুলিয়ট কুরিও।

আইরিন দেখলেন, নতুন তৈরি হওয়া মৌলটি রাসায়নিকভাবে রেডিয়ামের মতো আচরণ করে। এই রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন তার মা, মেরি কুরি। এখানে ঘটনা হলো, ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক ভর ২৩৫। আর রেডিয়ামের ভর ২২৬। মাইটনার ভাবলেন, উৎপন্ন মৌলটা যদি রেডিয়াম হয়, তাহলে হিসেব মেলে না। ঘটনাটাকে কোনো নিয়মে ঠিকভাবে বাঁধা যাচ্ছে না, ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।

কথা হলো, কিছু একটার হিসেব না মিললে সমস্যা কী? জিনিসটা যে হচ্ছে, সেটাই যথেষ্ট না? উত্তর, না, যথেষ্ট না। যতক্ষণ জিনিসটা কী এবং কীভাবে কাজ করে, সেটা জানা না যায়, ততক্ষণ ওই ব্যাপারটাকে কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাহলে, সেটাকে কী হিসেবে ধরা হয়? সমস্যা। এরকম অনেক সমস্যা এখনো রয়ে গেছে, যেগুলো আজো সমাধান করা যায়নি। প্রসঙ্গে ফিরি।

মাইটনার ভাবলেন, লিকুইড ড্রপলেট মডেল দিয়ে এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে, যদি উৎপন্ন জিনিসটা এত ভারী কোনো মৌল না হয়। কেন? কারণটা সহজ ভাষায় বললে এমন: পানির ফোঁটা ভাঙলেও এর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকতে হবে। নতুন উৎপন্ন ফোঁটা দুইটার একটা অনেক বেশি ভারী, আরেকটা অতিরিক্ত হালকা হবে না। তেমনি, নতুন উৎপন্ন মৌলের একটা রেডিয়াম হলে ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক ভর ২৩৫ এর ২২৬ই সে নিয়ে নেয়। বাকি অংশটা বেশি হালকা হয়ে যায়।

সমস্যার সমাধানও ভাবলেন তিনি। রেডিয়াম না হয়ে ওটা যদি বেরিয়াম হয়, তাহলে এর ভর হবে অনেকটা কম, ১৩৫। এদিকে, রেডিয়ামের সঙ্গে বেরিয়ামের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যেরও অনেক মিল। তার মানে, ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস পানির ফোঁটার মতোই দুইভাগ হয়ে যাচ্ছে।

সবই বুঝলেন, কিন্তু প্রমাণ করবেন কীভাবে? অটো হান নামে নিজের এক বন্ধু বিজ্ঞানীকে চিঠি দিলেন মাইটনার, দেখা করতে চান কোপেনহেগেনে। মাইটনার তখন হিটলারের ভয়ে নিজের দেশ জার্মানি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন সুইডেনে। তাঁরা দেখা করলেন। মাইটনার হানকে বললেন, উৎপন্ন জিনিসটাকে বেরিয়ামের সঙ্গে মিলিয়ে দেখ। বাকিটা আমি সাধারণ পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করে দিচ্ছি!

ফিরে গেলেন হান। পরীক্ষা করে দেখলেন, মাইটনারই ঠিক। হান এই পরীক্ষাটা করেছিলেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্ট্র্যাসম্যানকে সঙ্গে নিয়ে। এদিকে, মাইটনার কাজ করেছিলেন ভাইপো ফ্রিস্কের সাথে। হান আর স্ট্র্যাসম্যান তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে গবেষণাপত্র লিখে পাঠালেন জার্মান বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচারওয়াইজেনস্কাফতেন-এ। এটা প্রকাশিত হয় ৬ জানুয়ারি, ১৯৩৯-এ। এদিকে মাইটনার আর ফ্রিস্ক প্রক্রিয়াটার নাম রাখেন নিউক্লিয়ার ফিশন, এবং গবেষণাপত্র পাঠান নেচার-এ। সেটা প্রকাশিত হয় মাসখানেক পরে, ১১ ফেব্রুয়ারিতে।

১৯৪৪ সালে এ গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান অটো হান। কিন্তু মাইটনার কোনো স্বীকৃতিই পাননি। নোবেল কমিটির এ অন্যায় ঢাকতে গিয়ে অনেকে একটা অদ্ভুত অজুহাত দেন

কিন্তু এখানে মাইটনারের প্রতি একটা বড় ধরনের অন্যায় করেন হান। তিনি যে পরীক্ষা করেছিলেন, সেটা করেছিলেন মাইটনারের কথায়। কিন্তু তাঁর গবেষণাপত্রে মাইটনারের কোনো উল্লেখই ছিল না! মাইটনার একে তো ছিলেন নারী, তার ওপর ইহুদি। হান বুঝেছিলেন, এমন কারো কথা গবেষণাপত্রে রাখলে সেটা ঠিক মূল্য পাবে না। কিংবা হয়তো হিটলারের রোষের আশঙ্কায়।

আরও পড়ুন

১৯৪৪ সালে এ গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান অটো হান। কিন্তু মাইটনার কোনো স্বীকৃতিই পাননি। নোবেল কমিটির এ অন্যায় ঢাকতে গিয়ে অনেকে একটা অদ্ভুত অজুহাত দেন। তারা বলেন, মাইটনার আর হান দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেননি। যেহেতু হানের গবেষণাপত্রে মাইটনারের কথা ছিল না, কাজেই তাঁর অবদান নোবেল কমিটি বুঝতেই পারেননি।

মজার ব্যাপার হলো, হানের গবেষণাপত্রে ফিশন শব্দটা ছিলই না! ছিল না কোনো ব্যাখ্যাও যে, কী কারণে তিনি বেরিয়ামের কথা ভাবলেন; আর উৎপন্ন মৌল দুটোকে আলাদা করে বেরিয়ামের সাথে তুলনা করে দেখলেন।

এই তো গেল একদিক। আরেকদিক হলো, বিজ্ঞানী ভন লাউয়ে নোবেল কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন মাইটনারকে পুরস্কার দিতে। এমনকি ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাতে সম্মতও হয়েছিলেন। তাতেও চোখ-কান খোলেনি নোবেল কমিটির।

মাইটনারের পেপারের গুরুত্ব বুঝেছিলেন আইনস্টাইনও। আবশ্য তাঁকে বিষয়টা আরও ভালোভাবে বুঝিয়েছিলেন লিও জিলার্ডসহ আরও কজন বিজ্ঞানী। তাদের কথা আমলে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লিখলেন আইনস্টাইন। চিঠিতে বললেন, এই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা হিটলারের হাতে পড়লে সব শেষ হয়ে যাবে। সেই চিঠির সূত্র ধরেই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা বানানোর গোপনীয় ম্যানহাটন প্রজেক্ট।

মাইটনারের আত্মজীবনীকার রুথ সিমে লিখেছেন, মাইটনারকেও এই প্রজেক্টে কাজ করতে বলা হয়। কিন্তু মাইটনার তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর যুক্তি, মানুষ মারার জন্য তো তিনি বিজ্ঞানে আসেননি! অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাঁকে ফিশন নয়, আখ্যায়িত করা হয় পারমাণবিক বোমার জননী হিসেবে।