আজকের দিনে ‘টেসলা’ নামটা শুনলে অনেকের মাথায় হয়তো বৈদ্যুতিক গাড়ির কথা আসে। ইলন মাস্কের কল্যাণে এই নাম এখন অনেকেরই পরিচিত। তবে গাড়িটির নাম রাখা হয়েছে বিখ্যাত এক বিজ্ঞানীর সম্মানে। তিনি নিকোলা টেসলা। মানুষটিকে অনেকে বিদ্যুৎ বিপ্লবের স্থপতিও বলেন। অল্টারনেটিং কারেন্ট (Alternating Current, AC); অর্থাৎ আমরা বাসা-বাড়িতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, তার পেছনে রয়েছে এই বিজ্ঞানীর অবদান। প্রথম এসি মোটর, এসি কারেন্ট উৎপাদন ও সরবরাহের পদ্ধতি তিনিই উদ্ভাবন করেন। পাশাপাশি ইন্ডাকশন বা আবেশিত মোটর, ট্রান্সফরমার, টেসলা কয়েল, রিমোট কন্ট্রোল বা দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিসহ দৈনন্দিন জীবনের আরও নানা ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর অবদান।
১৮৫৬ সালের ১০ জুলাই বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার স্মিলিয়ান নামে একটি ছোট্ট গ্রামে জন্ম নেন এই বিজ্ঞানী। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা যাজক বাবার কাছে। তবে ক্রোয়েশিয়ার কারলোভাচ শহরের কারলোভাচ উচ্চ বিদ্যালয়ের (মূল উচ্চারণ: গিমাজিয়া কারলোভাচ) এক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের অনুপ্রেরণায় তড়িৎ-বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
জটিলকে সহজ চোখে দেখার চেষ্টা ছিল টেসলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী এবং দারুণ পরিশ্রমী। এমনকি টেসলার বাবা নিজে টেসলার অধ্যাপককে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘অতিরিক্ত পরিশ্রম করার ফলে টেসলা মারা যেতে পারে। সেরকম অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে তাঁকে যেন বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়।’
এ সময় টেসলার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। ১৮৮২ সালে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে কন্টিনেন্টাল এডিসন কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। সেখানেই হাতে-কলমে কাজ করার সুযোগ পান বিদ্যুৎ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে।
এত প্রতিভা ও পরিশ্রমের পরও টেসলার প্রতি ভাগ্যদেবতা যেন সর্বদাই রুষ্ট ছিলেন। জুয়ায় আসক্ত হয়ে ৩য় বর্ষে ভর্তি, বৃত্তিসহ সব সুবিধা হারান তিনি। এভাবে ইতি হয় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার। এ সময়, পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পর মাঝখানে বেশ কিছুদিন তাঁর সঙ্গে পরিবারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি মারা গেছেন!
তবে টেসলা যাঁর নাম, তাঁকে থামানো কি এত সহজ? ১৮৮১ সালে দেখা গেল, তিনি হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে পাড়ি জমিয়েছেন। সেখানে বুদাপেস্ট টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কাজ করার সময় তিনি টেলিফোন রিপিটার বা অ্যামপ্লিফায়ারের উন্নতি করেন। এ যন্ত্রের কাজ টেলিফোনের সিগন্যাল শক্তিশালী করে তোলা। ফলে বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে সিগন্যাল বহুদূর যেতে পারে। কিন্তু এ কাজের জন্য তিনি পাবলিক কোনো কৃতিত্ব দাবি করেননি বা প্যাটেন্ট করেননি।
এ সময় টেসলার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। ১৮৮২ সালে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে কন্টিনেন্টাল এডিসন কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। সেখানেই হাতে-কলমে কাজ করার সুযোগ পান বিদ্যুৎ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে। কর্তৃপক্ষ প্রকৌশল ও ব্যবহারিক কাজে টেসলার জ্ঞান দেখে অবাক হয়। তারা তাঁকে নিজেদের কোম্পানির ডায়নামো ও মোটরের ডিজাইন উন্নত করার সুযোগ দেয়। জার্মানি ও ফ্রান্সে এ কোম্পানির বিভিন্ন প্ল্যান্ট বা কারখানার নানা কৌশলগত সমস্যা সমাধানে তাঁকে পাঠানো হতো এ সময়। তিনি সেসব কাজ করতেন যথাযথভাবে। কিন্তু এ কাজ করে তাঁর ঠিক চলত না। পকেট ফাঁকা। তাতে কি টেসলা দমে যাবেন? মানুষটা যে টেসলা!
ফলে মাত্র ৪ সেন্ট আর একটা সুপারিশপত্র হাতে নিয়ে তিনি ১৮৮৪ সালের জুনে নিউইয়র্ক পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে কোম্পানির হেড অফিসে কাজ করা। এডিসনের প্রাক্তন নিয়োগকর্তা চার্লস ব্যাচেলরের সুপারিশে কাজ করার সুযোগ টেসলা পান ঠিকই, কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে ক্রমেই তাঁদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এ সময় তিনি এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে দেন। এডিসনের ডিসি বা ডিরেক্ট কারেন্ট ও টেসলার এসি কারেন্টের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে যায় এ সময়। এই যুদ্ধে যে টেসলাই জয়ী হয়েছেন, তা আমাদের আজকের বাসা-বাড়ির দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
কিছুদিন পর, ১৮৮৬ সালের শেষ দিকে মি. ব্রাউন নামে এক ব্যাংকার ও মি. পেক নামে এক অ্যাটর্নির সঙ্গে মিলে টেসলা ইলেকট্রিক কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এটি পরের বছরের এপ্রিলে কাজ শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল মোটর, জেনারেটর ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ ও গবেষণা করা। এসব কাজ করতে করতেই কিছুদিন পর তিনি বিদ্যুৎ-চালিত ইনডাকশন বা আবেশিত মোটর উদ্ভাবন করেন। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপের নানা দেশেও দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অদম্য টেসলার এই পর্যায়ক্রমিক তড়িৎ মোটর ও ইন্ডাকশন মোটর উদ্ভাবনের ঘটনা ইলেকট্রিক ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ১৮৮৮ সালে। ওয়াশিংটন হাউজের তড়িৎ-প্রকৌশলীদের চোখেও পড়ে এটি। কিন্তু এডিসন-টেসলা দ্বৈরথে এই প্রকল্প আশার মুখ দেখেনি।
ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন তথা তারহীন শক্তি সঞ্চালনায় ছিল টেসলার বিশেষ আগ্রহ। এ নিয়েও তিনি বেশ কিছু দিন কাজ করেন। টেসলা দাবি করেন, গুয়েলিয়েমো মার্কনির আগেই তিনি রেডিও উদ্ভাবন করেছিলেন।
১৮৯১ সালের ৩০ জুলাই টেসলা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। সাউথ ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে একটি গবেষণাগার তৈরি করেন তিনি। পরে আরেকটি গবেষণাগার তৈরি করেন ৪৬ই হিউস্টন রোড, নিউইয়র্কে। দুটো গবেষণাগারে তারহীন শক্তিশালী ট্রান্সমিশন ও তারের মাধ্যমে দুই জায়গাতেই বাতি বসান তিনি। সেই সময়ে এটা ছিল বিস্ময়কর কাজ। একই বছর তিনি টেসলা কয়েল উদ্ভাবন করেন। পাশাপাশি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (বর্তমানে আই ইইই-ইনস্টিটিউট অব রেডিও ইঞ্জিনিয়ারস) সহকারী প্রধান হন (১৮৯২-১৮৯৪)।
এ সময়, কথিত আছে—তাঁর কিছু কিছু জীবনীতে পাওয়া যায়—১৮৯৪ সালে টেসলা গবেষণাগারে নষ্ট ফিল্মের মধ্যে প্রতিপ্রভা রশ্মি দেখতে পান। পরে এটি এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি নামে পরিচিত হয়। তিনি মেতে ওঠেন এই নতুন গবেষণায়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই টেসলার এই কাজের সব গবেষণা, মডেল, তথ্য ও ছবিসহ ৫০ হাজার ডলার সমমূল্যের জিনিস ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের গবেষণাগার থেকে হারিয়ে যায় বলে শোনা যায়।
ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন তথা তারহীন শক্তি সঞ্চালনায় ছিল টেসলার বিশেষ আগ্রহ। এ নিয়েও তিনি বেশ কিছু দিন কাজ করেন। টেসলা দাবি করেন, গুয়েলিয়েমো মার্কনির আগেই তিনি রেডিও উদ্ভাবন করেছিলেন। ততদিনে মার্কনি রেডিওর পেটেন্ট পেয়ে গেছেন। টেসলা এ ব্যাপারে মামলা করেন। বেশ কবছর চলে পেটেন্ট যুদ্ধ। ১৯৩৭ সালে মার্কনি মারা যান। টেসলার মৃত্যু হয় ১৯৪৩ সালে। এর প্রায় ৬ মাস পর, মার্কনি এই পেটেন্ট পাওয়ার প্রায় ৬৪ বছর পর, ইউএস সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে রায় দেয়। নিকোলা টেসলার অবদান এ ক্ষেত্রে খারিজ করে দেওয়া হয়নি, বরং কোর্ট মার্কনির পাশাপাশি টেসলা ও জন স্টোনের গুরুত্বও তুলে ধরে রেডিওর উদ্ভাবক হিসেবে।
যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা নিকোলা টেসলাকে শুধু জিনিয়াস বললে কম হয়। মানুষের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এই কারিগর ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি নিউইয়র্কের একটি হোটেলে মারা যান।
১৮৯৯ সালের ১৭ মে টেসলা কলোরাডোতে চলে আসেন। এ সময় তিনি কৃত্রিম বজ্রপাত, ফ্লাইং সসার (ডিস্ক আকৃতির আকাশযান) থেকে শুরু করে অদ্ভুত বিভিন্ন জিনিস নিয়ে গবেষণা করেন। এর কিছু কিছুর জন্য পেটেন্টের আবেদনও করেছিলেন তিনি! তবে এসবই খারিজ করে দেওয়া হয়—অনেকে বলেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জন্য, যদিও এসব দাবির পক্ষে প্রমাণ মেলে না।
এত কিছুর পরও টেসলা তাঁর গবেষণা থামাননি। কিছুদিন পর টেসলার নজরে আসে কানাডার অন্টারিওতে অবস্থিত নায়াগ্রা ফলস বা জলপ্রপাত। জর্জ ওয়েস্টিংহাউজের সঙ্গে মিলে তিনি নায়াগ্রা ফলস ক্যাটারাক্ট কনস্ট্রাকশন কোম্পানির জন্য নায়াগ্রা জলপ্রপাতের এখানে বৈদ্যুতিক পাওয়ার কোম্পানি তৈরি করেন। এটি নিউইয়র্কের বাফেলো শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। এ কাজের সম্মাননা ও স্বীকৃতি হিসেবে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের পাশে একটি ভাস্কর্য রয়েছে নিকোলা টেসলার।
যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা নিকোলা টেসলাকে শুধু জিনিয়াস বললে কম হয়। মানুষের কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এই কারিগর ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি নিউইয়র্কের একটি হোটেলে মারা যান। নিকোলা টেসলা সেই অর্থে সফলতা না পেলেও তাঁর জীবন ও কর্ম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর একাধিক জীবনীকার দাবি করেছেন, এই বিজ্ঞানীর অনেক প্যাটেন্ট চুরি হয়ে গেছে। প্রায় এক হাজারের বেশি উদ্ভাবন করেছেন তিনি, কিন্তু বর্তমানে তাঁর ২৭৮টির মতো প্যাটেন্টের খবর পাওয়া যায়। এই সংখ্যাটি যে নিতান্ত কম নয়, তা বলা বাহুল্য।
বর্তমানে এই বিজ্ঞানীর বিভিন্ন গবেষণা, সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সার্বিয়ার বেলগ্রেডে অবস্থিত নিকোলা টেসলা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।