বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর গবেষণা
বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে কক্ষতাপমাত্রায় কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ
সম্প্রতি বিসমাথভিত্তিক এক ধরনের টপোলজিক্যাল পদার্থে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার ম্যাটেরিয়ালস-এর অক্টোবর সংখ্যায়। শুধু তা-ই নয়, গুরুত্ব অনুযায়ী এটি জায়গা পেয়েছে প্রচ্ছদে। বোঝাই যাচ্ছে, বিজ্ঞানীদের জন্য এ এক দারুণ সাফল্য। গুরুত্বপূর্ণ এ গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানের ইউজিন হিগিনস অধ্যাপক ও গবেষক এম জাহিদ হাসান। সেই গবেষণার বিবরণ...
সম্প্রতি বিসমাথভিত্তিক এক ধরনের টপোলজিক্যাল পদার্থে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার ম্যাটেরিয়ালস-এর অক্টোবর সংখ্যায়। শুধু তা-ই নয়, গুরুত্ব অনুযায়ী এটি জায়গা পেয়েছে প্রচ্ছদে। বোঝাই যাচ্ছে, বিজ্ঞানীদের জন্য এ এক দারুণ সাফল্য। গুরুত্বপূর্ণ এ গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানের ইউজিন হিগিনস অধ্যাপক ও গবেষক এম জাহিদ হাসান।
দীর্ঘদিন বিজ্ঞানীরা টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর বা অপরিবাহী ব্যবহার করে এতে কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করছেন। সাধারণত টপোলজিক্যাল অপরিবাহীতে এ ধরনের প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য পরম শূন্য বা কাছাকাছি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। (পরম শূন্য মানে প্রায় -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ০ কেলভিন।) এই প্রথমবার এসব কোয়ান্টাম প্রভাব কক্ষতাপমাত্রায় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হলো।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টপোলজিক্যাল স্টেট বা দশা পদার্থবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের দারুণ আগ্রহী করে তুলেছে। এ ধরনের গবেষণায় কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানের সঙ্গে প্রয়োজন টপোলজির জ্ঞান। এই টপোলজি তাত্ত্বিক গণিতের একটি শাখা। বাংলায় বলা হয় টপোগণিত। কোনো বস্তুর স্বকীয় বা অন্তর্নিহিত যেসব জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য চাইলে কিছুটা বাড়ানো-কমানো যায়, তবে বদলে ফেলা যায় না—সেগুলো-ই এ শাখার আলোচ্য বিষয়। স্থানের বেঁকে যাওয়া বা রূপ বদল বস্তুর এসব জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রভাব ফেলে না। অতিসরলীকরণ করে এর একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে বোঝার সুবিধার্থে। যেমন বৃত্ত। একটা রবারের বৃত্তকে চাইলে টেনে লম্বা করে পরাবৃত্তে পরিণত করা যাবে। তবে বৃত্তটিকে ছিঁড়ে না ফেললে তার অন্তর্নিহিত ‘বৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য’গুলো বদলে যাবে না।
আগে যেমন বলেছি, কোয়ান্টাম টপোলজির রহস্য ভেদ করে তাতে কোয়ান্টাম প্রভাব দেখার কাজে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন টপোলজিক্যাল অপরিবাহী। এ ধরনের অপরিবাহীর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, এদের ভেতরের অংশটুকু কাজ করে অপরিবাহী হিসেবে। আমরা জানি, তড়িৎ প্রবাহের জন্য ইলেকট্রনের প্রবাহ আবশ্যক। টপোলজিক্যার অপরিবাহীর ভেতরের ইলেকট্রনগুলো মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে না। তাই এর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ হয় না। এটুকু পড়ে যদি ভেবে থাকেন, এ আর অদ্ভুত কী? অদ্ভুত বিষয়টা হলো, এদের ভেতরের অংশটুকু অপরিবাহী হলেও কিনারার দিকের অংশের ইলেকট্রনগুলো মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে। অর্থাৎ এদের মাধ্যমে তড়িৎ প্রবাহিত হতে পারে। আর টপোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের কারণে এ ধরনের পদার্থকে বাঁকিয়ে ফেলে বা আকৃতি বিকৃত করলেও কিনারার এসব ইলেকট্রনের প্রবাহে কোনো পরিবর্তন আসে না। টপোলজিক্যাল অপরিবাহী শুধু যে প্রযুক্তির উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে পারে, তা-ই নয়, পদার্থের বিভিন্ন বিষয় আরও ভালোভাবে জানার জন্যেও এটি দারুণ কাজের জিনিস।
কিন্তু এতদিন বিজ্ঞানীরা এক জটিল হেঁয়ালিতে আটকে ছিলেন। এই সমস্যার কারণে টপোলজিক্যাল কোনো পদার্থকে সত্যিকার অর্থে কোনো কাজে তাঁরা ব্যবহার করতে পারছিলেন না। সমস্যাটা কী, সেটা বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের ভাষাতেই শোনা যাক। ‘টপোলজিক্যাল পদার্থ নিয়ে সবার অনেক আগ্রহ। মানুষ প্রায়ই এর দারুণ সম্ভাবনার কথা বলে। কিন্তু ম্যাক্রোস্কোপিক কোনো কোয়ান্টাম প্রভাব যদি কক্ষতাপমাত্রায় ঘটানো না যায়, তবে এ ধরনের পদার্থকে সত্যিকার কোনো ব্যবহারিক কাজে লাগানো যাবে না। অর্থাৎ এসব আমাদের কোনো কাজেই আসবে না।’
এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান ও তাঁর দল আসলে কী করেছেন। এ ধরনের পদার্থগুলোকে সত্যিকার ব্যবহারিক কাজে লাগানোর পথ বের করেছেন তাঁরা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ‘কক্ষ তাপমাত্রা’র বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এই বিষয়টা এবারে একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।
আমাদের চারপাশে সাধারণ যে তাপমাত্রা, তা অবশ্যই পরম শূন্য নয়। আগেও বলেছি, পরম শূন্য মানে প্রায় -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (প্রায় বলার কারণ, দশমিকের পরের সংখ্যাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে)। আর কক্ষতাপমাত্রা বলতে বোঝানো হয় ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এই তাপমাত্রা বা আরও বেশি তাপমাত্রায় যে সমস্যা দেখা দেয়, পদার্থবিজ্ঞানীরা তাকে বলেন ‘থার্মাল নয়েজ’। বাংলায় বলা যায় ‘তাপীয় গোলযোগ’। ঘটনা হলো, তাপ বাড়লে যেকোনো পদার্থের পরমাণু-ই কাঁপতে শুরু করে। তাপ যত বাড়ে, এই কম্পন তত বাড়তে থাকে। এর ফলে তৈরি হয় তাপীয় গোলযোগ। কোয়ান্টাম ব্যবস্থায় ঝামেলা করে দেয় এই গোলযোগ। ভেঙে পড়ে কোয়ান্টাম দশা।
টপোলজিক্যাল অপরিবাহীর ক্ষেত্রে হয় কী, উচ্চতাপমাত্রার ফলে অপরিবাহীর কিনারা বা পৃষ্ঠের ইলেকট্রনগুলো ভেতরের অংশেও ঢুকে যায়। ফলে ভেতরের বদ্ধ ইলেকট্রনগুলোও প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায় অপরিবাহীর ধর্ম। এর ফলে কোয়ান্টাম প্রভাবও আর দেখা যায় না।
এই সমস্যা থেকে বাঁচার একটি উপায় তো আগেই বলেছি, পরম শূন্য তাপমাত্রা বা কাছাকাছি তাপমাত্রায় এ ধরনের গবেষণা করা। কারণ, পরম শূন্য তাপমাত্রায় অতিপারমাণবিক কণারা আর কাঁপতে পারে না। এর কারণও আমরা জানি। তাপমাত্রা বাড়ালে বস্তু প্রসারিত হয় (কারণ, এর ভেতরের পরমাণুগুলো একে অন্যের থেকে দূরে সরে যায়), আর তাপমাত্রা কমালে বস্তু সংকুচিত হয় (পরমাণুগুলো কাছাকাছি চলে আসে)।
সবই ঠিক আছে। সমস্যা হলো, এ ধরনের পরম শূন্য তাপমাত্রা বা অত্যল্প তাপমাত্রার পরিবেশ তৈরি করা এবং সেটা ওভাবেই ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন প্রচুর শক্তি। এটি একদিকে যেমন প্রচণ্ড খরুচে, তেমনি ঠিক বাস্তব চিন্তাও না।
বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান তাই এর বিকল্প ভাবলেন। একদল অভিজ্ঞ সহকর্মীকে নিয়ে তিনি বানিয়েছেন বিসমাথ ব্রোমাইডে তৈরি নতুন ধরনের টপোলজিক্যাল অপরিবাহী (রাসায়নিক সংকেত, α-Bi4Br4)। এটি এক ধরনের অজৈব কেলাসিত যৌগ।
গবেষকদলের একজন বিজ্ঞানী নানা সুমিয়া বলেন, ‘এরকম একটি পদার্থ যে আমরা প্রচন্ড চাপ বা অত্যুচ্চ চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব ছাড়াই তৈরি করতে পেরেছি, এটা দারুণ ব্যাপার। কারণ, এখন পরবর্তী প্রজন্মের কোয়ান্টাম প্রযুক্তি গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা যানে এ ধরনের পদার্থ। আমার ধারণা, আমাদের এ গবেষণা কোয়ান্টাম প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রাখবে।’
বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান বলেন, ‘আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দীর্ঘদিন খুঁজে বেড়ানো এক গুপ্তধন পদার্থের এই টপোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য। শুধু মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেই নয়, ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম প্রকৌশল এবং ন্যানোপ্রযুক্তিতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই গবেষকদলটি এখন দুটো বিষয় নিয়ে ভাবছে। এক, অন্য আর কোন টপোলজিক্যাল পদার্থগুলো কক্ষতাপমাত্রায় কাজ করে, সেটা বের করার চেষ্টা করা। পাশাপাশি অন্যান্য বিজ্ঞানীদেরও এ ধরনের পদার্থগুলো শনাক্ত করার উপায় জানিয়ে দেওয়া ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা। আর দুই, কক্ষতাপমাত্রায় এখন যেহেতু কোয়ান্টাম প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, তাই এই পদ্ধতিতে পদার্থের কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরও জানার চেষ্টা করা। এর সত্যিকার সম্ভাবনা বোঝার জন্য নতুন ধরনের বেশ কিছু যন্ত্র ও কৌশল গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। তবে আমি জটিল ও দারুণ সব কোয়ান্টাম পরিঘটনা আরও ভালোভাবে বোঝার অমিত সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। এই গবেষণা আমাদের এক্ষেত্রে দারুণ সাহায্য করবে। পাশাপাশি আরও এনার্জি-সেভিং বা শক্তিবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি তৈরিতে সাহায্য করবে।’
বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের নেতৃত্বাধীন গবেষকদলের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান ও সাবেক অনেক গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী। এর মধ্যে রয়েছেন নানা সুমিয়া, ম্যাকসিম লিৎসকেভিক, ইয়ু-শি জিয়াং, ঝি-জিয়া চেং, টাইলার কোখরান এবং ড্যানিয়েল মাল্টার। এ ছাড়াও একই বিভাগের বর্তমান ও সাবেক পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সহকারীদের মধ্যে রয়েছেন শাফায়াত হোসাইন, জিয়া-জিন য়িন এবং কি ঝ্যাং। গবেষণাটি নেচার ম্যাটেরিয়ালে প্রকাশিত হয়েছে ‘এভিডেন্স অব আ রুম টেম্পারেচার কোয়ান্টাম স্পিন হল এজ স্টেট ইন আ হায়ার-অর্ডার টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর’ নামে।
সূত্র: প্রিন্সটন ডট এডু, নেচার ম্যাটেরিয়ালস ও উইকিপিডিয়া
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা