কে পাবেন ২০২৫ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল
অক্টোবর শুরু হয়ে গেছে। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহজুড়ে ঘোষণা করা হয় পাঁচটি বিষয়ে নোবেলজয়ীদের নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানিত এই পুরস্কার কাদের হাতে যাবে, তা নিয়ে সবার মধ্যেই কমবেশি কৌতূহল থাকে।
নোবেল পুরস্কারের পুরো প্রক্রিয়াটিই সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় ঢাকা। কোন কোন বিজ্ঞানী মনোনীত হয়েছেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় বহু বছর। তবু আমাদের কৌতূহল তো থেমে থাকে না। সে জন্যই এই লেখা। এ লেখায় অনুমান করার চেষ্টা করব সম্ভাব্য কাদের হাতে যেতে পারে এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।
পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ যে কাজগুলো এখনো নোবেল জেতেনি, সেগুলো মোটামুটি প্রতিবারই সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই গত বছরের তালিকার প্রায় সবাই-ই থাকবেন এবারও। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার, যেমন উল্ফ প্রাইজ, ব্রেকথ্রু প্রাইজ, ডিরাক মেডেল, নিউটন মেডেল ইত্যাদি পুরস্কারও ভবিষ্যত নোবেলজয়ী হওয়ার ভালো পূর্বাভাস দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেওয়া ২৬টি উল্ফ প্রাইজ বিজয়ীদের ১৪ জনই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আবার গবেষণা পত্রের সাইটেশন, এইচ-ইনডেক্স ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বোঝার একটি ভালো উপায়। তবে অনেক বছরেই দেখা যায়, আলোচনার বাইরে কোনো একটা পুরাতন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে নোবেল দেওয়া হয়েছে। আরেকটি মজার ট্রেন্ড গত দুই দশক ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে দুই-এক বছর বাদে একবার মহাবিশ্ব (জ্যোতির্বিজ্ঞান/পার্টিকেল ফিজিকস), অন্যবার আলো ও পদার্থ (Light-Matter)—এভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তবে সব আলোচনা ও সম্ভাব্য হিসাবের বাইরে গিয়ে গত বছর ২০২৪ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল দেওয়া হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) তথা কম্পিউটিং সিস্টেমের ওপর। এই সিদ্ধান্ত পদার্থবিজ্ঞান কমিনিটিতে যথেষ্ট বিস্ময় ও বিতর্কের জন্ম দেয়। তবে আমার ধারণা। এবার আবার পদার্থবিজ্ঞানের অধিকতর প্রতিষ্ঠিত শাখাগুলোর মধ্য থেকেই নোবেল বিজয়ী নির্বাচন করা হবে।
কোয়ান্টাম মেকানিকস: ইয়াকির আহারোনভ, মাইকেল বেরি
কোয়ান্টাম মেকানিকসের বেশ মৌলিক দুটি বিষয় হলো আহারোনভ-বোহম ইফেক্ট এবং বেরি ফেইজ। যদি তড়িৎ ও চুম্বক দুই ক্ষেত্রই শূন্য হয়, তবে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা বলে, আধানযুক্ত কণার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিকস বলে, যদি তড়িৎচুম্বকীয় বিভব শূন্য না হয়, তবে ওই বিভবের সঙ্গে আধানযুক্ত কণার কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশন কাপলিংয়ের মাধ্যমে কণার ওপর প্রভাব দেখা যাবে। পরীক্ষায়ও তা-ই প্রমাণিত হয়।
এই এক্সপেরিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত আরও মৌলিক একটি বিষয় জিওমেট্রিক ফেজ। পঞ্চাশের দশকেই এ বিষয়ে গবেষণাপত্র ছিল (পঞ্চরত্নম, লংগুয়ে-হিগিন্স)। তবে ১৯৮৪ সালে মাইকেল বেরি এই ধারণাকে সাধারণ গাণিতিক রূপ দেন এবং ‘বেরি ফেইজ’ হিসেবেই বিষয়টি পরিচিত হয়। এই দুই আবিস্কারের সঙ্গে যুক্ত বাকিরা মারা গেছেন। আহারোনভ ও বেরি ১৯৯৮ সালে একসঙ্গে উল্ফ প্রাইজও পেয়েছিলেন এবং অনেক বছর ধরেই নোবেল পুরস্কারের ফেভারিটের তালিকায় ছিলেন। এরকম অনেক বছর ধরে নোবেল না পাওয়া বেল ইনেকুয়ালিটির প্রমাণ অবশেষে ২০২২ সালে এসে স্বীকৃত হওয়ায় এ বছর আহারোনভ ও বেরিকে নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়। আহারোনভের বয়স বর্তমানে ৯৩ বছর, বেরির ৮৪ বছর। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব খুশি হব এই দুই কিংবদন্তীতুল্য পদার্থবিজ্ঞানী তাঁদের কাজের স্বীকৃতি পেলে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: চার্লস এইচ বেনেট, জিলে ব্রাসা, পিটার শর, ডেভিড ডয়েচ, ইগ্নাসিও সিরাক, পিটার জোলার
গত দশক ও সামনের কয়েক দশকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হতে যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। চার্লস বেনেট ও জিলে ব্রাসা মিলে আবিষ্কার করেন কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির বিবি৮৪ (BB84) প্রোটোকল। দুজন মিলে ২০১৮ সালে পেয়েছেন উল্ফ প্রাইজ।
২০১৭ সালে বেনেট পান ডিরাক মেডেল। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পিটার শর ও ডেভিড ডয়েচ। পিটার শর তাঁর শর অ্যালগরিদমের জন্য বিখ্যাত। এই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক অনেক গুণ দ্রুত ক্রিপ্টোগ্রাফি ভাঙতে পারে। ডেভিড ডয়েচ কোয়ান্টাম ট্যুরিং মেশিন ও বেল ইনেকুয়ালিটি নিয়ে কাজ করেছেন। এই চারজন একসঙ্গে পেয়েছেন ২০২৩ সালের ফান্ডামেন্টাল ফিজিকস ব্রেকথ্রু প্রাইজ। এই চারজনের মধ্যে দুই বা তিনজনকে (সর্বোচ্চ তিনজনকে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে দেওয়া হয়) একসঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেতে দেখা যেতে পারে।
এদের বাইরে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্রাক্টিক্যাল দিক নিয়ে চিন্তা করলে ইগ্নাসিও সিরাক ও পিটার জোলারকে যুগ্মভাবে বিবেচনা করা হতে পারে। তাঁরা যৌথভাবে আয়ন, কোল্ড অ্যাটম সিস্টেম ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও সিমুলেটর তৈরির থিওরি ও এক্সপেরিমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই দুজন যৌথভাবে পেয়েছিলেন ২০১৩ সালের উল্ফ প্রাইজ। জোলার পেয়েছেন ডিরাক মেডেলও।
ফ্র্যাকশনাল কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট: জয়নেন্দ্র জৈন, মরদেহাই হেইব্লুম এবং জেমস আইসেনস্টাইন
দ্বিমাত্রিক ইলেকট্রন সিস্টেমে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে ফ্র্যাকশনাল কোয়ান্টাম হল ইফেক্টের ব্যখ্যা ও পরীক্ষালব্ধ প্রমাণের জন্য এই তিন পদার্থবিজ্ঞানীকে এবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতে পারে। জয়নেন্দ্র জৈনের প্রস্তাবিত কম্পোজিট ফার্মিয়ন তত্ত্বের মাধ্যমে ফ্র্যাকশনাল কোয়ান্টাম হল ইফেক্টের ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে আইজেনস্টাইন ও হেইব্লুম পরীক্ষার মাধ্যমে এসব ফ্র্যাকশনাল চার্জ ও হল ইফেক্টের প্রমাণ দেখিয়েছেন।
তাঁদের কাজ তত্ত্ব ও পরীক্ষা—দুই দিক দিয়েই কোয়ান্টাম মেকানিকসের মৌলিক ধারণার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তাঁদের এই অবদানের জন্য তাঁরা যৌথভাবে এ বছরের উল্ফ প্রাইজ পেয়েছেন। তাই বলা বাহুল্য, এই ত্রয়ীকেও এবারের নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় রাখতেই হবে।