প্রকৃতির মৌলিক বল এবং তাদের ঐক্যের সন্ধান-২
আগের পর্বে আমরা মহাকর্ষ বল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এবার তেমনই আরেকটি মৌলিক বল— বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বল—নিয়ে খানিকটা আলাপ করা যাক। ‘তেমনই’ বলতে আবার একই রকম বুঝলে চলবে না। এদের মধ্যে পার্থক্য অনেক। যেমন ধরুন, দুটো ভরবিশিষ্ট বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বল কাজ করে, কিন্তু বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বল কাজ করতে প্রয়োজন দুটো চার্জিত বস্তুর বা দুটো চার্জিত কণার (যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন)। মহাকর্ষ বল শুধু আকর্ষণধর্মী কিন্তু বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বল আকর্ষণ-বিকর্ষণ দুই ধর্মই প্রদর্শন করে। দুটো চার্জ যদি একই ধরনের হয় (যেমন দুটোই ধনাত্মক বা দুটোই ঋণাত্মক) তাহলে তাদের ভেতরে বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বলটি হবে বিকর্ষণধর্মী আর যদি চার্জ দুটো বিপরীতধর্মী হয় (একটি ধনাত্মক আরেকটি ঋণাত্মক) তাহলে বলটি হবে আকর্ষণধর্মী।
আরেকটা পার্থক্যের কথা বলি। মহাকর্ষ খুব দুর্বল বল, ভর খুব বেশি না হলে এর অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না, যে কথা আগেই বলেছি। বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বল ততটা দুর্বল তো নয়ই বরং মহাকর্ষের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী। উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি পরমাণুর ভেতরের একটি প্রোটন এবং একটি ইলেকট্রনের মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ এবং বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বলের তুলনা করেন, দেখবেন বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বলটি মহাকর্ষ বলের চেয়ে প্রায় ১০৪০ গুণ শক্তিশালী! ভাবা যায়? ব্যাপারটা আরো সহজে বোঝা যাবে একটা উদাহরণ দিলে। ধরা যাক, আপনার হাতে একটা চুম্বক ও একটা লোহার পেরেক (বা নিদেনপক্ষে একটা আলপিন) আছে। আলপিনটা কি আপনি বিনা চেষ্টায় শূন্যে ভাসিয়ে রাখতে পারবেন? না, পারবেন না। পৃথিবীর মহাকর্ষিক টানে সেটি নিচে পড়ে যাবে। কিন্তু আলপিনটি যদি আপনি চুম্বকের কাছাকাছি আনেন তাহলে দেখবেন সেটি চুম্বকের সঙ্গে লেগে আছে, নিচে পড়ে যাচ্ছে না। এর মানে কী দাঁড়ায়?
পৃথিবীর মতো বিপুল ভরবিশিষ্ট এক গ্রহ আলপিনটিকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ করছে তার চেয়ে ওই চুম্বকের আকর্ষণ বল অনেক বেশি। হ্যাঁ, বেশি। কারণ দুটো একই ধরনের বল নয়। একটি মহাকর্ষ আরেকটি বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বল এবং দ্বিতীয় বলটি তুলনামূলকভাবে অনেক শক্তিশালী।
যাহোক, একটি চার্জিত কণা চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে কী ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হবে, তা বোঝা যায় এই বল দিয়ে। এই বলের কারণেই পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার বস্তুর ভেতরকার পাশাপাশি পরমাণুগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে রাখছে। আলোর শোষণ-বিকিরণ ইত্যাদিও ঘটছে এই বলের কারণে। বিদ্যুত্ ও চুম্বকের ব্যবহার তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনিবার্য অংশ, সেখানেও এই বলের খেলা।
মহাকর্ষ বল গণনার জন্য নিউটন যেমন একটি সূত্র প্রতিপাদন করেছিলেন, এর প্রায় এক শ বছর পর, ১৭৮৫ সালে, বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বল গণনার জন্য ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস কুলম্ব একটি সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন। সূত্র দুটো অনেকটা একই রকম। এই সূত্রের দ্বারা দুটো চার্জিত কণার ভেতরকার বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল নির্ণয় করা যায়। এ বল চার্জ দুটোর গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যেকার দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক। সূত্রটির গাণিতিক রূপ এ রকম:
এখানে q1 ও q2 হচ্ছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বস্তর চার্জ এবং r হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব। আর শ হলো একটি ধ্রুবক। এর মান k = 8.988 x 109 Nm2C-2|
আগেই বলেছি, মহাকর্ষ বল খুব দুর্বল হলেও বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল তুলনামূলকভাবে বেশ শক্তিশালী। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এ বলটি শুধু চার্জিত বস্তুর মধ্যেই কাজ করে, চার্জ-নিরপেক্ষ বস্তুর ক্ষেত্রে এই বলের কোনো প্রভাব নেই, আর সে জন্যই এই শক্তিশালী বলটি আমরা অনুভব করি না।
যাহোক, বিদ্যুত্চুম্বকীয় ঘটনাবলি ব্যাখ্যার জন্য কুলম্বের সূত্রটি ছিল প্রথম প্রচেষ্টা। এরপর এ নিয়ে আরও বহু কাজ হয়েছে। ১৮১৯ সালে ড্যানিশ পদার্থবিদ হ্যান্স ক্রিশ্চান ওয়েরস্টেড আবিষ্কার করেন যে বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে। তিনি দেখান—বৈদ্যুতিক কারেন্ট চৌম্বকীয় বল উত্পাদনে সক্ষম। ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ মাইকেল ফ্যারাডে দেখান ঠিক উল্টোটা, অর্থাত্ চুম্বকের আছে বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা। ১৮৬০-এর দশকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তিনি বিদ্যুত্চুম্বকীয় তরঙ্গের ব্যাখ্যা হাজির করেন, এর গতিবেগ নির্ণয় করেন (যা আলোর বেগের সমান), বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন এবং চারটি সূত্রের সমন্বয়ে ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ প্রণয়ন করেন। অর্থাত্ বিদ্যুত্চুম্বকীয় ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব হাজির করেন।
মহাকর্ষ এবং বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক মুহূর্তের জন্যও আমরা এদের প্রভাব এড়াতে পারি না। কিন্তু প্রকৃতির আরও দুটো মৌলিক বল আছে—একটি সবল নিউক্লিয় বল, আরেকটি দুর্বল নিউক্লিয় বল, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্বন্ধে আমরা একেবারেই উদাসীন থাকি। এবার তাদের নিয়ে কথা বলা যাক।
শুরু করা যাক সবল নিউক্লিয় বল দিয়ে। আমরা তো ইতিমধ্যে পরমাণুর গঠন জেনে ফেলেছি। জেনেছি যে, পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস আর তার চারদিকে ইলেকট্রন ঘুরে বেড়ায়। নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন নামক দুই ধরনের কণা। নিউট্রন চার্জ-নিরপেক্ষ হলেও প্রোটন ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট কণা, এও আমরা জানি। কিন্তু একই ধরনের চার্জবাহী কণা তো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, যার কথা বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের আলোচনায় আমরা বলেছি। এই বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকর্ষণের মানও খুব সামান্য নয়, অন্তত মহাকর্ষের তুলনায় অনেক বেশি। তাহলে এত বিকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও একটা অতিক্ষুদ্র জায়গার মধ্যে (নিউক্লিয়াসের আকার প্রায় ১০-১৫ মিটার) প্রোটনগুলো জড়ো হয়ে থাকে কীভাবে? সেটা কি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে? মোটেই না। আগেই বলেছি, মহাকর্ষ খুবই দুর্বল বল। তা ছাড়া প্রোটন এতই ক্ষুদ্র কণা ও তাদের ভর এতই কম যে মহাকর্ষ বল এ ক্ষেত্রে প্রায় শূন্য বলেই ধরে নেওয়া যায়। তাহলে কী ঘটে? এমন কোনো শক্তিশালী আকর্ষণ বল নিশ্চয়ই আছে যা বিদ্যুত্চুম্বকীয় বিকর্ষণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রোটনকে শক্ত করে বেঁধে রাখে! হ্যাঁ, যে বলটি এই কাজটি করে তার নামই সবল নিউক্লিয় বল। ১৯৩৫ সালে জাপানি পদার্থবিদ ইয়োকাওয়া এই বলটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। সময়টি মনে রাখুন, ১৯৩৫। এটিই সবল নিউক্লিয় বলের প্রথম ব্যাখ্যা। এর বছর বিশেক পর অন্য বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যাটি আরও গভীরভাবে দিতে সক্ষম হন। সেটি জানার আগে আসুন ইয়োকাওয়ার ব্যাখ্যাটি জেনে নেওয়া যাক। তবে বলটি কীভাবে কাজ করে সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে এ পর্যায়ে একটি কথা না বললেই চলছে না। বিজ্ঞানীরা এসব বলের আলোচনার সময় এগুলোকে ‘বল’ না বলে ‘মিথস্ক্রিয়া’ (ওহঃবত্ধপঃরড়হ) বলে ডাকেন। শব্দটি নিঃসন্দেহে হূদয়গ্রাহী। মিথস্ক্রিয়া মানে পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া, অনেকটা পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অনুরাগ বা বিরাগের মতো ব্যাপার আরকি! এই নামে ডাকার হয়তো একটি কারণ আছে। একবার ভাবুন তো—দুটো বস্তু কীভাবে পরস্পরকে (মহাকর্ষিক) আকর্ষণ করে? বা কীভাবে ‘জানতে পারে’ যে পরস্পরকে আকর্ষণ করতে হবে? কিংবা ভেবে দেখুন—একটা প্রোটন কীভাবে ‘বোঝে’ যে একটা ইলেকট্রনকে (বিদ্যুত্চুম্বকীয়) আকর্ষণ করতে হবে, কিন্তু আরেকটি প্রোটনকে করতে হবে বিকর্ষণ? মজার ব্যাপার হলো এই আকর্ষণ-বিকর্ষণ ঘটে একধরনের কণা বিনিময়ের মাধ্যমে। অর্থাত্ এক জোড়া ইলেকট্রন-প্রোটন, অথবা প্রোটন-প্রোটন, কিংবা ইলেকট্রন-ইলেকট্রন যখন বিদ্যুত্চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় তখন তাদের ভেতরে ফোটন নামের এক ধরনের কণার বিনিময় ঘটে। কিংবা বলা যায়—ফোটন নামের কণাটিই তাদের ভেতরে এই মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। ফোটনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে যেন অনেকটা ঘটকের মতো। সে জন্য তাকে বলা হয় বিদ্যুত্চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যম কণা? একইভাবে ধারণা করা হয়—দুটো বস্তুর ভেতরে মহাকর্ষিক মিথস্ক্রিয়া ঘটায় গ্রাভিটন নামের একধরনের কণা। গ্রাভিটনকে অবশ্য এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি, এটা এখনো ধারণা-আকারেই আছে। ফোটন-গ্রাভিটনের মতোই আরেক ধরনের কণা, যার নাম মেসন, সবল নিউক্লিয় মিথস্ক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে (এটা কিন্তু ইয়োকাওয়ার মতামত, আমরা এখনো সেটি নিয়েই কথা বলছি)। এই মেসন কণাকে কখনো কখনো পায়োন নামেও ডাকা হয়। তিন ধরনের মেসন কণা আছে, যথাক্রমে—পাই প্লাস (ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট), পাই মাইনাস (ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট) এবং পাই জিরো (চার্জ-নিরপেক্ষ)। এই কণাগুলোর বিনিময়ের মাধ্যমে প্রোটন-প্রোটন, প্রোটন-নিউট্রন এবং নিউট্রন-নিউট্রন কণার মধ্যে সবল নিউক্লিয় মিথস্ক্রিয়া ঘটে। নিউট্রন ভেঙে প্রোটন এবং পাই মাইনাস উত্পন্ন হয়, আবার প্রোটনটি পাই মাইনাস শোষণ করে নিউট্রনে পরিণত হয়। উল্টোটাও ঘটে। প্রোটন ভেঙে নিউট্রন এবং পাই প্লাস উত্পন্ন হয়, আবার নিউট্রনটি পাই প্লাস শোষণ করে প্রোটনে পরিণত হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম :
n→ p + π-
এবং p + π-→n
এর উল্টো রূপান্তরটি এরকম: p→n + π+
এবং n + π+→ p
এখানে হ হলো নিউট্রন, ঢ় হলো প্রোটন, π- হলো পাই মাইনাস আর π+ হলো পাই প্লাস। অর্থাত্ প্রোটন ক্রমাগত নিউট্রনে এবং নিউট্রন ক্রমাগত প্রোটনে পরিণত হতে থাকে। খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই রূপান্তর যদি সত্যিই ঘটে তাহলে কখনোই ভরের পার্থক্য দেখা যায় না কেন? প্রোটন ও নিউট্রনের ভর তো সমান নয়! তাহলে নিউট্রন যদি প্রোটনে পরিণত হয় কিংবা প্রোটন পরিণত হয় নিউট্রনে তাহলে ভরের একটা পার্থক্য ঘটে যাওয়ার কথা নয়? হ্যাঁ, যাওয়ার কথা। কিন্তু এই রূপান্তরের ঘটনাগুলো এত দ্রুত গতিতে ঘটে (এক মাইক্রোসেকেন্ডেরও কম সময়ে) যে, এই ভর-পার্থক্য কখনোই ধরা পড়ে না। আবার উভয় ধরনের কণাই ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্যে থাকে বলে বিদ্যুত্চুম্বকীয় নিয়ম অনুযায়ী নিজেদেরকে যে বিকর্ষণ করার কথা তা তাদের মনেই থাকে না। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই যখন টানাটানি তখন কি আর এত নিয়ম-কানুনের কথা মনে রাখা সম্ভব? (কথাটা মজা করে বললাম, নিউট্রন-প্রোটনের ‘মন’ আছে, এ-কথা বললে তো পদার্থবিদেরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন!) যাহোক, সবল নিউক্লিয় বলকে আরেকটু ভালোভাবে বোঝার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা কণা-ত্বরকযন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হলেন। এই যন্ত্র দিয়ে যখন পরমাণু ও নিউক্লিয়াস ভেঙে ফেলতে পারলেন বিজ্ঞানীরা, তখন পায়োনের অস্তিত্বও পেলেন। মানে ইয়োকাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হলো। একই সঙ্গে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন—প্রোটন ও নিউট্রন আসলে মৌলিক কণা নয়, এগুলো কোয়ার্ক নামের আরেক ধরনের কণা দিয়ে তৈরি। (এই কোয়ার্ক আবার বিভিন্ন ধরনের, যেমন: আপ, চার্ম, টপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, বটম। সেই আলোচনায় আর না গেলাম)। যখন এটা জানা গেল যে, প্রোটন বা নিউট্রন আদৌ মৌলিক কণা নয়, তখন তাদের ভেতরে ক্রিয়াশীল সবল নিউক্লিয় বলের মাধ্যম-কণা হিসেবে মেসন বা পায়োন কণার ব্যাপারেও সংশয় দেখা দিল। প্রশ্ন উঠল, মেসন কি ফোটনের মতো মৌলিক কণা? না, মেসন বা পায়োন মৌলিক কণা নয়, এরাও কোয়ার্ক-অ্যান্টিকোয়ার্ক দিয়ে গঠিত। অর্থাত্ কোয়ার্কই মৌলিক, প্রোটন-নিউট্রন-মেসনের মতো কণাগুলোকে তারাই গড়ে তোলে। সবল নিউক্লিয় বল এই কোয়ার্কগুলোকেই একসঙ্গে বেঁধে রাখে এবং এই বেঁধে রাখার জন্য মাধ্যম-কণা হিসেবে কাজ করে গ্লুয়োন নামক আরেক ধরনের মৌলিক কণা। কণাটির নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, আঠার মতো কাজ এর, নইলে আর তার নাম গ্লুয়োন হবে কেন? বিজ্ঞানীদের রসবোধও কিন্তু মন্দ নয়, নামকরণের ব্যাপারে সেটির পরিচয় মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়। যাহোক, গ্লুয়োন কীভাবে কাজ করে সেটি বলতে গেলে আবার কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স নামক এক বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সেটি অন্য কোনো লেখায় করা যাবে, আপাতত মৌলিক বলের আলোচনাতেই থাকি।
একটু আগে বলছিলাম যে সবল নিউক্লিয় বল বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, মহাকর্ষের চেয়ে তো বটেই। সত্যি বলতে কি এটিই প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী বল। তবে এটি কাজ করে ক্ষুদ্র দূরত্বের মধ্যে—একটা নিউক্লিয়াসের আকার যতটুকু, এই বল কাজ করার সীমাও ততটুকু। যেহেতু এই শক্তিশালী বল দিয়ে প্রোটন-নিউট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের ভেতরে বাঁধা থাকে, তাই যখন দুই বা ততোধিক হালকা নিউক্লিয়াস যুক্ত হয় (যাকে ফিউশন প্রক্রিয়া নামে অভিহিত করা হয়) অথবা একটি ভারী নিউক্লিয়াস ভেঙে যায় (এর নাম ফিশন প্রক্রিয়া) তখন নিউক্লিয়াস থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। সূর্য বা তারাদের শক্তির উত্সও এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, যার পেছনে রয়েছে সবল নিউক্লিয় বলের একচ্ছত্র অবদান।
এখনো কিন্তু সবগুলো মৌলিক বল নিয়ে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। বাকি রইল দুর্বল নিউক্লিয় বল।
এ বলগুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্কসূত্র আছে কি না, কোনোভাবে তাদের ঐক্যবদ্ধ রূপ আমরা দেখতে পাব কি না, সেই আলোচনাও তোলা রইল আগামী পর্বের জন্য।
লেখক: অধ্যাপক, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
এই সিরিজের আগের লেখা: প্রকৃতির মৌলিক বল ও তাদের ঐক্যের সন্ধান- ১